পুরান ঢাকায় যা যা দেখলাম

সাজেদুর আবেদীন শান্ত
সাজেদুর আবেদীন শান্ত সাজেদুর আবেদীন শান্ত , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০৪:৪৭ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০২২

সেদিন সোমবার। মিরপুর থেকে অনেক যানজট ও গরম পেরিয়ে তিন ঘণ্টায় পৌঁছলাম পুরান ঢাকায়। আগেই পরিকল্পনা করেছিলাম, আমরা পুরান ঢাকায় ঘুরবো। আমরা বলতে, আমি আর কবি ও কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ভাই। সেদিন ভাইয়ের ছুটির দিন। পরিকল্পনা মাফিক তিনি সময়মতো পৌঁছালেও আমার জন্য তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন তিনি।

তিনি বিউটি বোর্ডিংয়ের পাশে চায়ের দোকানে কবি ও প্রকাশক খালেদ রাহী ভাইকে নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি গিয়ে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে ঢুকলাম বিউটি বোর্ডিংয়ের ভেতরে। আমি এবারই প্রথম ঢুকলাম বিউটি বোর্ডিংয়ে। বিউটি বোর্ডিং পুরান ঢাকার একটি ইতিহাস, একটি ঐতিহ্য।

বিউটি বোর্ডিং পলেস্তারা ওঠা, আগাছা জন্মানো পুরোনো দেওয়ালের দোতলা একটা বাড়ি। যা পুরান ঢাকার বাংলা বাজারের ১ নং শ্রীশদাস লেনে অবস্থিত। যার সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস। সেই সাথে বাড়িটি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গুণী মানুষদের আড্ডার একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সেই সময়ে।

jagonews24

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তের আগে এটি ছিল সোনার বাংলা পত্রিকা অফিস। বিখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল এ পত্রিকায়। পরবর্তীতে যখন পত্রিকা অফিসটি কলকাতায় স্থানান্তর করা হয়; তখন ১৯৪৯ সালে দুই ভাই প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা এ বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন বোর্ডিং। সেই থেকে বাড়িটির নাম হয় বিউটি বোর্ডিং।

১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বিউটি বোর্ডিংয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জনকে হত্যা করে। এরপর তার পরিবার ভারত চলে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রহ্লাদ চন্দ্রের দুই ছেলে বোর্ডিংটি আবার চালু করেন। বিউটি বোর্ডিংয়ের শুরু থেকেই এখানে আড্ডা দিয়েছেন অনেক প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

jagonews24

সেই জায়গায় আমি এসেছি ভাবতেই ভালো লাগছে। প্রথমে ঢুকেই বিউটি বোর্ডিংয়ের বিখ্যাত দধি অর্ডার দিলাম। দধি খেয়ে বোর্ডিংটি ঘুরে দেখতে লাগলাম। প্রায় এগারো একর জায়গাজুড়ে বিউটি বোর্ডিং। চারপাশে দোতলা ভবন। থাকার জন্য কক্ষ। নিচতলার পেছনে খাবারের ক্যান্টিন। বাড়ির আঙিনায় বসার সুন্দর জায়গা। অনেক রকম ফুল গাছ দিয়ে সুসজ্জিত। দেখে মনে হচ্ছে, এর জৌলুস এখনো কমেনি।

বিউটি বোর্ডিং ঘুরতে ঘুরতে দুপুর পার হয়ে গেল। খালেদ রাহী ভাই চলে গেলেন। খাবারের সময় হলো। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন ফিচার লেখক ও কবি রায়হান আহমেদ তামীম। আমরা প্যারীদাস রোডের একটি রেস্টুরেন্ট থেকে কাচ্চি খেয়ে নিলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর বিদায় নিলেন তামীম। আমরা হাঁটা শুরু করলাম। পুরান ঢাকা ঘুরে দেখতে হলে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। না হলে সেভাবে কিছুই দেখতে পারবেন না।

চলে গেলাম পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জ এলাকার নর্থব্রুক হল সড়কের লাল কুঠিতে। লাল কুঠি পুরাতন হলেও একটি চমৎকার স্থাপনা। ১৮৭৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুকের ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে একটি টাউন হল নির্মিত হয়। এ টাউন হলটিই হলো লাল কুঠি। এটি বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষে অবস্থিত। টাউন হলটিকে নর্থব্রুকের নামে নামকরণ করা হয়। তবে ভবনটি লাল রঙের হওয়ায় ‘লাল কুঠি’ নামে বেশি পরিচিত।

jagonews24

সেখান থেকে চলে গেলাম সদরঘাট। সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে ঢুকলাম। সারি সারি ছোট, বড়, মাঝারি ধরনের লঞ্চ দেখতে পেলাম। মাঝে মাঝে ছোট ছোট নৌকারও দেখা পেলাম। এসব নৌকায় করে বিভিন্ন খাবারসামগ্রী নিয়ে আসে লঞ্চের যাত্রীদের জন্য। লঞ্চঘাটে ঢুকেই লক্ষ্য করলাম এখানকার ব্যস্ততা। কোলাহল হাকাহাকিতে চারপাশ জমে উঠেছে।

বড় দেখে একটি লঞ্চে উঠে পড়লাম আমরা। লঞ্চে উঠে ছবি তুলতেই একজন কাছে এলেন। বললেন, ‘কোথা থেকে আসছেন? আপনারা কী করেন?’ বললাম, ‘আমরা সাংবাদিক।’ শুনেই তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন তার পরিবারের একটি ছবি তুলতে। তার আবদার মেটালাম। কথার ছলে জানতে পারলাম তার নাম হেলাল। পরিবারের ৭ সদস্য নিয়ে যাবেন বরগুনার আমতলী। পদ্মা সেতু হওয়ার পরও তিনি লঞ্চে যাচ্ছেন কেন? জিজ্ঞাস করলে বলেন, ‘সেতু দিয়েও যাই। কিন্তু এতো মানুষ একসাথে যাবো তাই লঞ্চে যাচ্ছি। ছোট বাচ্চা, জিনিসপত্র নিয়ে বাসে যেতে অসুবিধা হয়। তা ছাড়া ভাড়া তো প্রায় একই।’

লঞ্চ ঘুরে দেখতে দেখতে উপভোগ করলাম নদীর অপরূপ সৌন্দর্য। লঞ্চের ছাদ থেকে নদীর সৌন্দর্য মনে হয় অন্যরকম। লঞ্চে যাত্রী তেমন নেই। অনেক লঞ্চে অলস সময় পার করছেন লঞ্চ সংশ্লিষ্টরা। ঘুরতে ঘুরতে প্রায় বিকেল হয়ে এলো। বাসায় ফেরার জন্য লঞ্চঘাট থেকে বের হলাম।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগোতেই চোখে পড়ল ঘোড়ার গাড়ি। এটাকে টমটমও বলা হয়ে থাকে। পুরান ঢাকার প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য। একসময় গাড়িগুলোর ব্যাপক কদর ছিল। তবে এখন ঐতিহ্য আছে, কদর নেই। চরম অনাদর-অবহেলায় চলছে টিকে থাকার লড়াই। গাড়িচালক শাকিলের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আগে বাপ-দাদারা এই গাড়ি দিয়াই কামাই করতো। এহোন অনেক কঠিন হইয়া গেছে। আগের মতো লোকজন গাড়িতে ওঠে না, কামাইও হয় না।’

ঘোড়ার গাড়ি দেখতে দেখতেই চোখ গেল একধরনের লেগুনার দিকে। এটিও পুরান ঢাকার ঐতিহ্য। লেগুনাগুলো দেখতে অনেকটা মাইক্রোবাসের মতো। একটি গাড়িতে প্রায় ২২ জন যাত্রী বসতে পারেন। পুরান ঢাকা থেকে যাত্রাবাড়ীর দিকে যেতে এ গাড়ি ব্যবহার হয়।

jagonews24

এসব দেখতে দেখতে বাসায় ফেরার জন্য তাড়া দেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ভাই। কিন্তু রওনা দিতেই শুরু হলো বৃষ্টি। সে কী তুমুল বৃষ্টি। যেন দুই-এক ঘণ্টায় থামবেই না। আমরা দৌড়ে আশ্রয় নিলাম জুতা বিক্রিরে একটি শোরুমের ভেতরে।

সেখানে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হলো বৃষ্টি থামার জন্য। বৃষ্টি পুরোপুরি না থামলেও তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার জন্য বৃষ্টিতে ভিজেই রওনা হলাম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছ থেকে উঠে পড়লাম বাসে। পল্টন এসে আমি নেমে পড়লাম। কারণ দুজনের গন্তব্য এখন দুদিকে। তিনি যাবেন বাড্ডা আর আমি যাবো মিরপুর।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।