রোপওয়েতে ভেসে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি

হুসাইন আজাদ
হুসাইন আজাদ হুসাইন আজাদ আসাম (ভারত) থেকে ফিরে
প্রকাশিত: ১২:৫০ পিএম, ৩১ জুলাই ২০২২

আসাম রাজ্য জাদুঘর থেকে বেরোনোর পর গন্তব্য ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর নির্মিত রোপওয়ে। রোপওয়ে হলো এমন যান্ত্রিক পরিবহন পদ্ধতি, যার মাধ্যমে নদী ও পর্বত এলাকায় কেবিনে মানুষ বা জিনিসপত্র পারাপার করা হয়।

চীন, ভারত ও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মিত এই পরিবহন মাধ্যমটি পরিচিত ‘গৌহাটি রোপওয়ে প্রজেক্ট’ হিসেবে। চালু হয়েছে ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট। যুক্ত করেছে উত্তর গৌহাটির সঙ্গে দক্ষিণ গৌহাটিকে। সড়কপথে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যেতে লাগে ঘণ্টাখানেক। অথচ রোপওয়ের কল্যাণে ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার পথ যাওয়া যায় মাত্র আট মিনিটে।

দক্ষিণ গৌহাটির মূল ফটক পেরিয়ে রোপওয়ে স্টেশনে ঢুকতেই মিষ্টি হাসিতে অভ্যর্থনা জানালেন নিয়োজিত কর্মীরা। এই রোপওয়ের দুটি কেবিন। একটি কেবিন আগেই স্টেশনে ছিল। অপেক্ষাকৃত বয়স্করা উঠে গেলেন সেই কেবিনে। যান্ত্রিক দিকগুলো পরখ করে নেওয়ার পর সেই কেবিন চলতে শুরু করলো। কয়েক মিনিটেই চলে গেলো বহু দূরে।

রোপওয়েতে ভেসে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি

খানিক বাদেই বিপরীত দিক থেকে এলো অপর কেবিনটি। এবার অপেক্ষমাণ দর্শনার্থীরা উঠলেন। কেবিনটি প্রথমে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো, এরপর গতি বাড়তে থাকলো। বদ্ধ কেবিনে কিছুটা গরম অনুভূত হলেও নিচে প্রবহমান ব্রহ্মপুত্রকে পাখির মতো করে দেখার সুযোগটা অভাবনীয় উচ্ছ্বাসে ভাসালো দর্শনার্থীদের। দূর থেকে দূরে সবুজ পাহাড়ি চাদরে চোখ আটকে যাচ্ছিল বারবার।

এমন কাব্যিক মুহূর্ত স্মৃতিতে বাঁধতে কেউ কেউ ভিডিও করছিলেন, কেউ তুলছিলেন ছবি। প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে কেউ কেউ ফেসবুক লাইভে গিয়ে বন্ধুদের দেখাচ্ছিলেনও রোপওয়ে পাড়ি দেওয়ার স্মরণীয় মুহূর্ত।

রোপওয়েতে ভেসে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি

রোপওয়ের পথে ব্রহ্মপুত্রের মাঝখানটায় দেখা গেলো গাছগাছালিতে ভরা ছোট্ট এক সবুজ দ্বীপ। সেই দ্বীপে মন্দিরও আছে, জনবসতিও আছে। সঙ্গী আসামিজ গাইড মোশতাক আহমেদ বলছিলেন, এই দ্বীপের নাম ‘উমানন্দ দ্বীপ’। সনাতনী বিশ্বাস মতে, শিব তার স্ত্রী পার্বতীর সুখ-আনন্দের জন্য এই দ্বীপ সৃষ্টি করেন। পার্বতীর আরেক নাম উমা। সেজন্য এই দ্বীপকে উমানন্দ দ্বীপ বলা হয়। এটি নদীর বুকে ক্ষুদ্র জনবসতির দ্বীপগুলোর অন্যতম। আকৃতির কারণে এটির নাম ময়ূর দ্বীপ রাখে ব্রিটিশরা।

উমানন্দ দ্বীপ পার হতেই কেবিনের গতি বেড়ে যায়। এর মধ্যেই পাশের রোপওয়ে দিয়ে ফিরতে দেখা যায় আগে ছেড়ে আসা কেবিনটিকে। দুই কেবিনেরই দর্শনার্থীরা পরস্পরকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন। দেখতে দেখতে উত্তর গৌহাটিতে পৌঁছে যায় কেবিন। এতক্ষণ উপভোগের আনন্দে গরম ভুলে থাকলেও বাইরে বেরোতেই যেন সবাই প্রাণভরে শ্বাস নিতে থাকেন।

রোপওয়েতে ভেসে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি

এ প্রান্তে বসে কেউ কেউ কেবিনের ছবি তুলছিলেন, কেউ কেউ ফেসবুকে এমন মুহূর্তের ফ্রেমবন্দি ছবি পোস্ট করছিলেন। কিছুটা সময় পর ফিরতি কেবিনে চড়ে বসলেন সবাই। প্রবহমান নদীর ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়ার আনন্দে কেউ কেউ গুনগুন স্বরে গান ধরছিলেন। দূরের পাহাড়ে শুভ্র মেঘের ছোটাছুটি দেখছিলেন কেউ কেউ। ফের উমানন্দ দ্বীপ পেরিয়ে দক্ষিণ গৌহাটিতে পৌঁছে যায় কেবিন।

বেরোতে বেরোতে সবার মুখ যেন উচ্ছ্বাসে জ্বলজ্বল করছিল। এ এক ভিন্নরকম আনন্দ, ভিন্নরকম রোমাঞ্চ। বাংলাদেশ থেকে আসা দর্শনার্থী আবু বকর আল আমিন বলছিলেন, গৌহাটি রোপওয়েতে চড়ে ব্রহ্মপুত্র পার হওয়া আসাম ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য একটা ভালো লাগার মুহূর্ত। ব্রিজের ওপর গাড়ি করে কিংবা নৌযানে নদী দেখা আর রোপওয়ের কেবিনে নদী দেখার অভিজ্ঞতা একদমই আলাদা। এর মাধ্যমে পাখির চোখে নদীর আসল সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হলো। এ অভিজ্ঞতা আজীবন মনে থাকবে।

রোপওয়েতে ভেসে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি

রোপওয়ের কর্মীরা জানান, সুইজারল্যান্ডে তৈরি এই কেবিনের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩২ জন দর্শনার্থী/যাত্রী চড়তে পারেন। প্রতিবার চালুর আগে কেবিনগুলোর নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো চেক করা হয়। যদিও জরুরি প্রয়োজনে কেবিন উদ্ধারে রেসকিউ ক্যাপসুল আছে।

প্রতিমাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বৃহস্পতিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এই রোপওয়ে চালু থাকে। টিকিট ইস্যু করতে হয় সোয়া ৮টা থেকে সাড়ে ১২টা এবং দেড়টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে। আসা-যাওয়ার (বোথ ওয়ে) টিকিটের মেয়াদ থাকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত।

রোপওয়েতে ভেসে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি

স্থানীয় যাত্রী বা দর্শনার্থীদের কেবল ওয়ান ওয়ে টিকিটের দাম ১০০ রুপি, বোথ ওয়ে টিকিটের দাম ১৫০ রুপি। তিন বছরের শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন দর্শনার্থীদের টিকিট লাগে না। ৩ থেকে ১২ বছর ও ষাটোর্ধ্বদের টিকিটে ৫০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। বিদেশি পর্যটক বা দর্শনার্থীদের ওয়ান ওয়ে টিকিটের জন্য দিতে হয় ৩০০ রুপি এবং বোথ ওয়ে টিকিট বাবদ গুনতে হয় ৫০০ রুপি।

বাংলাদেশেও আছে রোপওয়ে, তবে বন্ধ
বাংলাদেশেও আছে এমন রোপওয়ে। একমাত্র এই রোপওয়ে সিলেটের ভোলাগঞ্জকে সুনামগঞ্জের ছাতকের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ১৯ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রোপওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, চালু হয় ১৯৭০ সালে। ১১৯টি খুঁটির ওপর নির্মিত রোপওয়ে দিয়ে বাক্সভর্তি পাথর পরিবহন করা হতো। তবে নানান সমস্যা ও জটিলতার কারণে এই রোপওয়ে তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। তবে কিছু বিনোদনকেন্দ্রে ছোট পরিসরে চালু রয়েছে রোপওয়ে।

এইচএ/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।