পর্যটনের ধারণা বদলে দিচ্ছে উটির চা-চকলেট, শ্রীমঙ্গল কেন পিছিয়ে

আসিফ আজিজ
আসিফ আজিজ আসিফ আজিজ , অতিরিক্ত বার্তা সম্পাদক
প্রকাশিত: ১১:২৩ এএম, ২৮ জুলাই ২০২২

বিরূপ আচরণ প্রকৃতি কখনো সহ্য করে না। কোনো না কোনোভাবে সেটা আবার ফিরিয়ে দেয়। প্রকৃতিকে ধ্বংসের মুখে না ফেলে তাই কীভাবে এর উপযুক্ত ব্যবহার করে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়, সেদিকেই ঝুঁকছে পৃথিবী। ভারতের তামিলনাড়ুর শৈল শহরের রানি খ্যাত উটি এমন একটি শহর। প্রায় আড়াই হাজার মিটার উঁচু এ শহরে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। চাইলেই পাহাড় কেটে স্থাপনা বানানো যায় না। তাদের যে স্বল্প সম্পদ রয়েছে সেটাকে যথোপযুক্ত ব্যবহার করে ছবির মতো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে।

উটির মতো এমন সুন্দর পাহাড়, চা বাগান আমাদের বান্দরবান, সিলেটেও রয়েছে। কিন্তু পর্যটনটাকে আমরা গতানুগতিকতার বাইরে ভাবতে পারি না। যে কারণে বিদেশি পর্যটক কম, দেশি পর্যটকরাও সেভাবে আকর্ষণবোধ করেন না।

সিলসিলা, মেনে পেয়ার কিয়া থেকে শুরু করে বহু বলিউড সিনেমার শুটিং হয়েছে উটিতে। পরিচ্ছন্ন, সবুজ একটি শহর। চা বাগান, গোলাপ বাগান, হাতে তৈরি চকলেট, টয় ট্রেন, টোডা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তৈরি বিভিন্ন সরঞ্জাম এখানকার পর্যটনকে এগিয়ে নিচ্ছে। থাকা-ঘোরার খরচও খুব বেশি নয়। এক হাজার বা দেড় হাজার রুপি দিয়ে একটি অটো ভাড়া করলেও গোটা শহর তিন-চার ঘণ্টায় দেখে ফেলা সম্ভব। মানুষ ঠকায় কম। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে, কেনাকাটা করে অন্তত সেই অভিজ্ঞতাই হয়েছে।

jagonews24

উটি শহর থেকে তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত চা জাদুঘর। কিন্তু এটা একেবারেই অন্যরকম। টিকিট ১০ রুপি। ঢুকতে হয় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। ভেতরে ঢুকে দেখা যাবে এ অঞ্চলে চায়ের ইতিহাস সম্বলিত কিছু ছবি, যেটার গোড়াপত্তন হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। ঢুকতেই চায়ের কাঁচাপাতার ঘ্রাণ লাগে নাকে। একটু ঘুরে তাকিয়ে দেখা গেলো চায়ের পাতা একেকটি কনটেইনারে ঝুলে যাচ্ছে মেশিনের মধ্যে। মানে এটি একটি চা কারখানাও। সেটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না প্রথমে। দর্শনার্থীদের কাছে এখন বড় আকর্ষণ এটি। চা উৎপাদন লাইভ দেখা।

আমাদের দেশে চা ফ্যাক্টরি মানেই ধারে কাছে ঘেঁষা বারণ। খুব পরিচিত কেউ না থাকলে সিলেট বিভাগে প্রায় দুইশ চা বাগান থাকার পরও পর্যটকরা সেখানে ঢুকতে পারেন না। ফ্যাক্টরির আশপাশে থাকা বাগানে ছবি তুলেই শেষ হয় চায়ের দেশ ঘোরা। বাগান বা ফ্যাক্টরির আশপাশে সেভাবে চা বেচাকেনারও ব্যবস্থা নেই।

কিন্তু উটি ব্যতিক্রম। এই চা ফ্যাক্টরিটির প্রোডাকশনে মাত্র পাঁচজন শ্রমিক কাজ করেন। বাকি সব অটোমেটিক সিস্টেম। জাদুঘরে ঢোকার পর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। লোহার গ্রিলে ঘেরা পথ ধরে চা তৈরির সবগুলো ধাপ দেখে তবেই নামতে হবে নিচে। কাঁচা পাতা দেখতে দেখতে নিচে নেমে দেখা যাবে তৈরি চায়ের প্যাকিং। চাপ্রেমীদের কাছে যা খুবই উপভোগ্য। নিচে নেমেই আরেক চমক। কারখানার টাটকা চা পাতায় তৈরি গরম গরম এক কাপ চা হাতে দাঁড়িয়ে একজন। এ উষ্ণ অর্ভ্যথনা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। পর্যটকদের অপ্রত্যাশিত আনন্দ দেয় এটা।

jagonews24

কারখানা থেকে বেরিয়েই দেখা যাবে চায়ের দোকান। সেখানেও আছে দারুণ সব প্যাক। ফ্যামিলি প্যাকের পাশাপাশি টিন, কাঠ ও কাগজের সুদৃশ্য বক্স বিক্রি হচ্ছে গিফট প্যাক হিসেবে। উটির স্যুভেনির হিসেবে পর্যটকরা দেদারছে কিনছেন সেটা। দুইশ থেকে নয় হাজার রুপি দামের চা পাতা রয়েছে এখানে। সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয় সিলভার টিপস টি। যেটা দুটি কুঁড়ি রোদে শুকিয়ে হাতে তৈরি হয়।

দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে উঁচুতে এক একর জায়গা নিয়ে তৈরি এই চা ফ্যাক্টরির দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা এক টন।

এই ফ্যাক্টরির ম্যানেজার বর্ধমান রাজ বলেন, প্রতিদিন প্রায় চার হাজার পর্যটক এখানে আসেন। ২০০৫ সালে শুধু পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে এ চা কারখানাটা গড়ে তোলা হয়। লেমন, জিঞ্জার, তুলসি, হানি, এলাচিসহ বিশ ধরনের চা উৎপাদন হয় এ কারখানায়। এছাড়া টি অয়েল থেকে শুরু করে মিলবে বিভিন্ন হারবাল পণ্য।

jagonews24

চমক এখানেই শেষ নয়, চা দেখে বের হওয়া যাবে না। আবার উপরে উঠতে হবে। এবার চকলেট কারখানা দেখার পালা। হাতে তৈরি চকলেট সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানে বিখ্যাত। সেই চকলেট তৈরি দেখা এবং কেনার সুযোগও আছে। দুজন নারীকে দেখা গেলো কাচঘেরা কারখানায় কাজ করতে। এক পাশে বক্সে সারি সারি সাজানো চকো ফল। অন্য পাশে গোল বাঁকানো দুটি বড় ড্রামের ভিতর দেওয়া হচ্ছে সেই ফলগুলো। সেখানেই হচ্ছে গুঁড়া। পাশের আরেকটি মেশিন থেকে বের হচ্ছে তরল চকলেট।

এর পাশের ঘরে আরেকজন নারী সেই তরল চকলেট বিশেষ কাপড়ে মুড়ে হাতের চাপে ফেলছেন বিভিন্ন ধরনের ছাঁচে। সেই ছাঁচে থেকে তুললেই তৈরি হয়ে গেলো জিভে জল আনা চকলেট। শুধু তৈরি দেখা নয়। একটু ঘুরে গিয়ে সেই চকলেট কেনার সুযোগও রয়েছে। ব্যাপক ভিড় দেখা গেলো কেনার জায়গায়।

হ্যাজল নাট, রেজিন, অ্যালমন্ড, কোকোনাট, কেশোনাট, ফ্রুট, ডার্ক, হোয়াইট প্রভৃতি চকলেট পাবেন এখানে। দাম কেজিপ্রতি ৮শ থেকে ২ হাজার রুপি পর্যন্ত। ফ্যাক্টরির বাইরে পরিবেশটাও মন ভোলানো। পর্যটকদের কীভাবে আকর্ষণ করতে হয় এরা তা জানে।

jagonews24

উটি ভ্রমণে এসে সাংবাদিক মহসিন উল হাকিম জাগো নিউজকে বলেন, পর্যটকদের জন্য এখানে আহামরি কিছু নেই। এখানকার চা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, শত বছরের পুরোনো রেলগাড়ি এগুলোই পর্যটকদের আনন্দ দেয়। এগুলোই উপভোগ্য। এখানে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক করে লাভ নেই, কারণ এটা পুরোটাই একটি অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। বাংলাদেশেও এমন অনেক সুন্দর জায়গা আছে। বিষয়টা হলো পর্যটকদের সার্ভিস দেওয়া। পর্যটকরা যেন কষ্ট না পান, জিনিসের দাম যেন বেশি নেওয়া না হয়। এ জিনিসগুলো এখানে নেই। এখানকার মানুষ পর্যটকদের সার্ভিস দেয়, এক হাজার রুপিতে দুই ঘণ্টায় শহর ঘুরে ফেলতে পারছি। এসব বিষয়ই আমার ভালো লেগেছে।

সাংবাদিক শাহানাজ শারমিন বলেন, উটির পাহাড়ে হেঁটে চলে আমার বারবার আমাদের রাঙ্গামাটি-বান্দরবানের পাহাড়ের কথা মনে হচ্ছিল। আমরাও যদি এদের মতো সার্ভিস দিতে পারতাম তাহলে সারা পৃথিবী থেকেই পর্যটকরা আমাদের দেশে আসতো। এরা প্রকৃতি সংরক্ষণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। পশু-পাখি প্রাণী সব যেভাবে আছে সেভাবে রেখেই এরা এগিয়ে যাচ্ছে। এটাই আমাদের দেশের সঙ্গে পার্থক্য।

jagonews24

উটির ফার্ন হিল রিসোর্টের সার্ভিস ম্যানেজার যোগেশ মেহতা জাগো নিউজকে বলেন, উটিতে মানুষ বেড়াতে আসার অন্যতম কারণ এখানকার আবহাওয়া। সব সময় সহনীয় তাপমাত্রা থাকে। দেশের অন্য জায়গায় যত গরম পড়ুক উটির তাপমাত্রা কম থাকে। দক্ষিণের তিন রাজ্যের সংযোগ হওয়ায় এখানে দক্ষিণের লোকই আসে বেশি। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী আসে ঘুরতে, জানতে।

আমাদের শ্রীমঙ্গল চায়ের রাজধানী খ্যাত। একটি জাদুঘরও রয়েছে। কিন্তু পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো বিশেষ কোনো ব্যবস্থা সেখানে নেই। এমনকি এখানকার চা বাগানগুলোতে ছবি তুলতে গেলেও বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

jagonews24

পর্যটন নিয়ে কথা হয় শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা বিশেষ করে ডিসি, ইউএনওর সঙ্গে যখন কথা হয় তখন আমরা দাবি জানাই চায়ের রাজধানীতে এসে মানুষ যেন চা উৎপাদন দেখতে পারে। কিন্তু আমাদের নানান সিক্রেটের কথা বলে নিরুৎসাহিত করা হয়। ভারতে এটা আছে। কিন্তু আমাদের বিটিআরআই চা বাগানে তো ছবি তোলাও নিষেধ। তাহলে পর্যটন এগোবে কীভাবে।

শ্রীমঙ্গলের চা মিউজিয়ামের এলাকাটা পর্যটকদের জন্য চা তৈরি দেখা, ছবি তোলা, চা কেনার ব্যবস্থা করার জন্য উপযুক্ত বলে মনে করেন তিনি।

এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।