শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে যা যা দেখবেন ও যেখানে থাকবেন

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:১৫ পিএম, ০৩ জুলাই ২০২২

ইসতিয়াক আহমেদ

পর্যটন শহর হিসেবে শ্রীমঙ্গলের নামটি সবসময় প্রথম সারিতেই থাকে। মৌলভীবাজার জেলার শুধু এই এক উপজেলাতেই আছে ৪০টি চা বাগান। শুধু কি চা বাগান, শ্রীমঙ্গলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থানও আছে এখানে।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, বাইক্কাবিল, মাধবপুর লেক, হাম হাম ঝরনা তারমধ্যে অন্যতম। টিম ঘুরুঞ্চির ৯ জন ১৭ জুন একসঙ্গে ছুটলাম শ্রীমঙ্গলের পথে।

চলতি পথে প্রথম বিরতি দিলাম পাঁচদোনা পেরিয়ে নরসিংদীতে। যেহেতু ভোরেই আমরা রওনা হয়েছি তাই এক প্রকার সকালের নাস্তা শেষ করলাম নরসিংদীর জনতা রেস্তোরাঁয়। বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা সেখান থেকেই শুরু হলো।

jagonews24

পুরো পথ জুড়ে যে বৃষ্টি আমাদের সঙ্গী হবে, তার আভাস বেশ ভালোই পাচ্ছিলাম। যাইহোক অতঃপর আবারো পথ ধরা শ্রীমঙ্গলের। বৃষ্টিস্নাত যাত্রাপথ শেষ করে যখন আমরা শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করলাম তখন প্রায় দুপুর দেড়টা পার হয়েছে।

তাই রিসোর্টে যাওয়ার আগেই বসে পড়লাম পেট পূজো করতে বিখ্যাত পানসী রেস্তোরাঁয়। সেখানে তুলনামূলক স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসম্মত ও সুস্বাদু নানা পদের খাবার খেতে পারবেন। শ্রীমঙ্গলে যারাই ঘুরতে আসেন পানসীতে খেতে ভুলেন না কেউই।

শ্রীমঙ্গল শহর ঘুরে দেখার জন্য বর্তমানে সেখানে অনেকগুলো হোটেল রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। সেখানে পাঁচ তারকা গ্র্যান্ড সুলতানের মতো প্রাসাদসম রিসোর্ট যেমন আছে ঠিক তেমনই সুলভ বাজেটের কিছু ছোট ছোট রিসোর্টও আছে।

jagonews24

বর্তমানে শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত রিসোর্টগুলোর মধ্যে নভেম ইকো রিসোর্ট অন্যতম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই রিসোর্ট পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সে কারণে এই রিসোর্টে রুম খালি পাওয়াটাই মুশকিল।

শ্রীমঙ্গলের রাধানগরের রাস্তা ধরে নভেম ইকো রিসোর্টে যেতে হয়। একেবারেই নিরিবিলি এলাকায় ছোট্ট দুটো টিলার উপর গড়ে তোলা হয়েছে এই রিসোর্ট। ২০১৬ সালে প্রায় তিন একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এই রিসোর্টের আছে নিজস্ব চা বাগান। আছে সুইমিংপুলসহ অত্যাধুনিক প্রায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা।

দুটো ছোট টিলাকে নকশায় রেখে নির্মিত হয়েছে রিসোর্টটি। তাই টিলার মাঝের জায়গাটুকু আগের মতোই রাখা হয়েছে। সবুজ পাহাড় ঘেরা মাঠটিতে রিসোর্টের কিচেন ও খাবার ঘর।

jagonews24

এই দুই টিলার মাঝে সংযোগ করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি চমৎকার ব্রিজ। আর এই ব্রিজটিই রিসোর্টটির ‘ট্রেড মার্ক’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টিলার গায়ে চমৎকার কাঠের ব্রিজ পার হয়ে যেতে হবে মূল রিসোর্টের থাকার অংশে।

অনেক রকম থাকার ব্যবস্থা আছে এই রিসোর্টে। এখানে আছে মাড হাউড, উডেন কটেজ, ডুপ্লেক্স ফ্যামিলি ভিলা, কাপল ও ফ্যামিলি রুম। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কাঠের কটেজ দুটো। কাঠের এই কটেজ দুটি খুবই দৃষ্টিনন্দন। এর ভেতরের ইন্টেরিয়রও খুব সুন্দর।

এই কাঠের কটেজগুলোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে এই রুমের সঙ্গেই আছে একটি ছোট প্রাইভেট সুইমিং পুল। রিসোর্টে সবার ব্যবহারযোগ্য আরো একটি সুইমিংপুল আছে। পাহাড়ের উপর চমৎকার সূর্যাস্ত দেখা যায় রুম থেকেই।

jagonews24

এখানে আছে নিজস্ব বারবিকিউ করার জায়গা। যদিও এানে কটেজের ভাড়া সবচেয়ে বেশি। প্রতি রুমের নিয়মিত ভাড়া ১৬ হাজার টাকা। তবে মাঝে মধ্যে বেশ বড়সড় ছাড় দেয় রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ। যেটা তাদের ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেইজ থেকে জানা যাবে।

এই রিসোর্টে মাড হাউজ নামে মাটি দিয়ে তৈরি একটি রুম আছে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘরের সঙ্গে মিল রেখে তৈরি এ ঘরের বিছানাও কাদা দিয়েই তৈরি করা। তবে বাথরুম এবং ঘরের প্রয়োজনীয় সব আসবাব আধুনিক। এই রুমটিতে দুজন থাকা যাবে আর এর নিয়মিত ভাড়া ৭ হাজার টাকা।

ডুপ্লেক্স ফ্যামিলি ভিলাটা বানানো হয়েছে বড় পরিবার বা বন্ধু-বান্ধবের গ্রুপের কথা মাথায় রেখে। এ ভিলাটার দুই তলায় মোট ৪টি বেড আছে যার মধ্যে ২টি ডাবল বেড আর ৩টি সিংগেল বেড, সাতজন সহজেই থাকতে পারবেন।

jagonews24

এই ডুপ্লেক্স ছোট্ট বাড়িটি ১ হাজার ৪১৫ স্কয়ার ফিট, বাথরুম আছে দু টি যার একটি কমন আর অন্যটি এটাচড। বাইরের পাহাড়ে আনারসের চাষ হয়, সে পাহাড়টার ও অসাধারণ ভিউ পাবেন বেড থেকেই। এই ভিলায় ২য় তলার সঙ্গেই লাগোয়া ছাদ, যা বন্ধু বান্ধব মিলে আড্ডা দেবার জন্য আদর্শ স্থান।

এছাড়া রিসোর্টের মূল ভবনে বেশ কয়েক ধরনের রুম আছে। সামনেই সুইমিংপুল, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, আর রেস্টুরেন্ট আছে। এছাড়া রিসোর্টের আরেকটি টিলার উপর আছে চমৎকার একটি কাপল ভিলা। এই ভিলার চারপাশে দেখা যায় পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য।

ক্যাম্পিং বর্তমানে বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চাইলে এই রিসোর্টে তাবুর স্বাদও নিতে পারেন। পাহাড়ের ঢালের উপর আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন একটি তাঁবু রাখা আছে এই রিসোর্টে।

jagonews24

সাঁতার কেটে, রেস্ট নিয়ে ও আড্ডা দিয়েই, কাটিয়ে দিলাম প্রথম দিনের বিকেল। এরপর সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতেই বেড়িয়ে পড়লাম ডিনারের সন্ধানে। স্থানীয়রাই ইকো ফ্রেন্ডলি নানা উপকরণ দিয়ে অসাধারণ করে সাজানো চেষ্টা করেছে সেখানকার চামুং রেস্তোরাঁ।

রাতের আলোয় স্বর্গীয় এক পরিবেশের সৃষ্টি হয় যেখানে। শুধুই যে দেখতে শুনতে সুন্দর তাই নয়, একই সঙ্গে অসাধারণ তাদের খাবারের স্বাদ। তাদের আপ্যায়নও আপনাকে মুগ্ধ করবে।

রেস্তোরাঁর সঙ্গে বেরে ওঠা চেরির স্বাদ নেওয়া, ডিনার শেষে তাদের অসাধারণ চায়ের স্বাদ সব মিলে দারুন সময় কাটাতে পারবেন সেখানে। শ্রীমঙ্গল গেলে অবশ্যই চামুং রেস্তোরাঁ ঘুরে আসতে ভুলবেন না।

jagonews24

দ্বিতীয় দিন ঘুম থেকে উঠেই ব্রেকফাস্টের পালা। সকাল ৮-১০টা পর্যন্ত সময় ব্রেকফাস্টের সময়। সেখানে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টে পাবেন জ্যাম, জেলি, ব্রেড, পরাটা, খিচুড়ি, ডিম, স্থানীয় আনারস, আমের জুস, পাস্তা ও চা। সুন্দর সাজানো গোছানো ডাইনিং এরিয়ার মতো সুস্বাদু তাদের খাবারের স্বাদও।

ব্রেকফাস্ট করে রেস্ট নিয়ে ১২টায় চেকআউট করলাম। আমরা টিম ঘুরুঞ্চি দলবল পাকিয়ে আবারো বেরিয়ে পড়লাম। এ যাত্রায় যাচ্ছি মাধবপুর লেকের উদ্দেশ্যে। নুরজাহান টি স্টেটের ভেতরের চা বাগানে ঘেরা পথ দিয়েই বৃষ্টির মধ্যেই ছুটাম আমরা।

মাধবপুর লেক মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। ১৯৬৫ সালে চা বাগানের টিলায় বাঁধ দিয়ে পানি জমিয়ে এই লেক তৈরি করা হয়। প্রায় ৫০ একর আয়তনের মাধবপুর হ্রদের দৈর্ঘ্য ৩ কিলোমিটার ও স্থান বিশেষে প্রস্থ ৫০-৩০০ মিটার পর্যন্ত।

ন্যাশনাল টি কোম্পানির মালিকানাধীন মাধবপুর চা বাগানের ১১ নম্বর সেকশনে অবস্থিত মাধবপুর লেকের শোভা বাড়ায় সাদা ও নীল পদ্ম ফুল। শীতকালে এই লেকে অনেক অতিথি পাখিরও আগমন ঘটে।

jagonews24

চা বাগান কর্তৃপক্ষ চা বাগানের টিলার নিচে লেকের পাড় ঘেঁষে হাঁটার জন্য সরু পথ করে দিয়েছে। টিলার ওপর আছে খড়ের তৈরি তাঁবু। মাধবপুর লেকে একসঙ্গে জল, পাহাড় ও চা বাগান ঘেরা একটা বুনো নির্জনতা আছে। তবে সন্ধ্যা ৬টার আগেই সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ুন।

মাধবপুর লেক ঘুরেই কাঁক ভেজা হয়ে ছুটলাম লাউয়াছড়ার পথে। বাংলাদেশে যে ৭টি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য আর ১০টি জাতীয় উদ্যান আছে তার মধ্যে লাউয়াছড়া অন্যতম। ১২৫০ হেক্টর আয়তনের এই উদ্যানে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও ৩ ঘণ্টার তিনটি ভিন্ন ট্রেইল আছে। বিখ্যাত ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ৮০ ডে’ মুভির শুটিং হয়েছিল এ স্থানেই।

কীভাবে যাবেন?

ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল ট্রেনে অথবা বাসে করে যেতে পারবেন। চাইলে নিজস্ব গাড়ি নিয়েও পৌঁছাতে পারবেন। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সিএনজিতে করেই পৌঁছাতে পারবেন রিসোর্টে। আর সিএনজি বা জিপ ভাড়া নিয়ে সহজেই ঘুরে দেখতে পারবেন সব দর্শনীয় স্থান।

লন্ডন রেস্টুরেন্টে দুপুরে খাবার শেষ করে ফেরার পথ ধরলাম আমরা। ফিরতে মন চাইবে না তবেও আমাদের ফিরতে হয়। ভ্রমণ গিয়ে দয়া করে প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না।

জেএমএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।