শত বছরের কবর মাড়িয়ে পথ চলতে হয় সেখানে
ইসতিয়াক আহমেদ
প্রায় ৪০০ বছরের গৌরব ও সমৃদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ঢাকা শহরের বেড়ে ওঠা। তারই জানান দেয় পুরান ঢাকার মিড ফোর্ট ও আরমানিটোলার মধ্যবর্তী চার্চ রোডে অবস্থিত আরমেনিয়ান চার্চ।
আরমানিরা ঢাকায় যে অঞ্চলে বসবাস করত, কালক্রমে তার নাম হয়ে যায় আরমানিটোলা। মুসলিম শাসনামলে কিন্তু এই এলাকার নাম ছিল ‘আলে আবু সাঈদ’। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঢাকা শহরে ৪০টির মতো আরমানি পরিবার ছিল। আরমানিটোলায় একটু গোছগাছ করে বসার পর আরমানিরা এখানে নির্মাণ করেছিল তাদের গির্জা।
বর্তমানের এই প্রার্থনালয় ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও তার আগে থেকেই স্থানটি আরমেনিয়ান দের কবর স্থান ও প্রার্থনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ঢাকায় বেড়াতে আসা ঐতিহাসিক পর্যটকরা তাদের নিয়ে ধোলাইখালের কাছে যে গির্জার কথা উল্লেখ করে গেছেন, তা-ই সম্ভবত এই আরমানি গির্জা।
অতীতে এখানে একটি কবরস্থান ছিল। গির্জা নির্মাণের জন্য কবরস্থানের আশপাশের বেশ কিছু জায়গা দান করেছিলেন ‘আগা মিনাস ক্যাটচিফ’। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, গির্জাটি নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন চারজন আরমানি।
তাদের নাম হলো- মাইকেল সার্কিস, অক্টো-ভাট সেতুর জিভর্গ, আগা এমানিয়াজ ও মার্কার পগোজ। গির্জা উদ্বোধন উপলক্ষে মোটামুটি ছোটখাটো একটা উৎসবও হয়েছিল। আরমানিরা মিছিল করে ব্যান্ড বাজিয়েছিল। চার্চটি লম্বায় সাড়ে ৭৫০ ফুট। চারটি দরজা ও ২৭টি জানালা।
১৪ ফুট প্রশস্ত এক বারান্দা দিয়ে ঢুকতে হয় গির্জায়। দালানের ভেতরের মেঝে তিন ভাগে বিভক্ত, রেলিং দিয়ে ঘেরা একটি বেদি, মাঝখানের অংশে দুটি ফোল্ডিং দরজা, বেষ্টনী দিয়ে আলাদা করা তৃতীয় ভাগটিতে শুধু নারী ও শিশুরা বসে থাকে।
গির্জার ভেতরে একসঙ্গে ১৫০-২০০ মানুষ প্রার্থনা করতে পারে। প্রার্থনাকক্ষের প্রধান প্রবেশদ্বারের একপাশে একটি সুদৃশ্য কাঠের সিঁড়ি। বেয়ে পাটাতনে ওঠা যায়। পাটাতনের দু’পাশের দরজা দিয়ে ছাদে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
এর পাশে আলাদা করে দাঁড়িয়ে আছে একটি স্থূল বর্গাকার টাওয়ার। চূড়ায় আছে ৪টি শঙ্খিল মিনার। চার দেওয়ালের মাঝে, মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে দেওয়ালে লাগানো আছে একটি মার্বেল ফলক।
আরমানি ও ইংরেজি ভাষায় তাতে লেখা আছে- মি. সার্কিস ঈশ্বরকে উৎসর্গ করেছেন এই চমৎকার জাঁকালো মিনার। গির্জাটিতে বেশ বড় আকারের একটি ঘণ্টা ছিল। এটি কবে স্থাপিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে জানা না গেলেও ১৮৪০ সালে ঢাকায় ঘুরতে আসা কর্নেল ডেভিডসন এই ঘণ্টা দেখেছিলেন।
সেই ঘণ্টার আওয়াজ শুনে ঢাকাবাসী দিনের সময় নির্ধারণ করতো। ঘণ্টাটি ঘড়ির সময়ের সঙ্গে মিল রেখে বাজানো হতো। চার্চের ঘণ্টাটিও বেশ নামকরা ছিল। নির্মাণ করেছিলেন জোহানসকাব্রু পিয়েত সার্কিস। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই ঘণ্টার শব্দ ৪ মাইল দূর থেকেও শোনা যেত।
উনিশ শতকের শেষের দিকে আরমানিরা গির্জার ব্যয় কমানোর জন্য ঘণ্টাবাদককে বিদায় করে দেয়। যেহেতু ঢাকাবাসী সময়ের বিষয়ে এই ঘণ্টার ওপরই নির্ভর করতো, তাই এটি বন্ধ করে দেওয়ায় জনপ্রিয় পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে।
গির্জাটির চারদিকে আছে পাকা করা অনেকগুলো সমাধি। অষ্টাদশ শতকের পুরোনো কবরও আছে। বেশিরভাগ স্মৃতিফলকে মৃতের নাম ও ধর্মগ্রন্থের বাণী উদ্ধৃত আছে। একেকটি পরিবারের সদস্যকে একেক সারিতে সমাহিত করা হয়েছে।
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে টাওয়ারটি সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়। আর্মেনিয়ান গীর্জাটিতে সুপরিচিত ইউরোপীয় শিল্পী দ্বারা আঁকা চার্চ বিশপের একটি তৈলচিত্র ছিল। তবে প্রয়াত আর্কবিশপ সাহাক আয়ভাডিয়ান ১৯০৭ সালে উক্ত পেইন্টিং তার সঙ্গে নিয়ে যান।
গির্জার বারান্দা হতে শুরু করে চারপাশ জুড়েই আছে শতবর্ষী শত শত কবর। গির্জায় অবস্থিত শতবর্ষী কবরগুলোর মধ্যে পুরোনো একটি কবর ক্যাটাকিক এভাটিক টমাসের।
কবরের উপরে কলকাতা থেকে কিনে আনা তার স্ত্রীর অবয়বের আদলে তৈরি মূর্তি ও কবরে লেখা ‘শ্রেষ্ঠ স্বামী’ শব্দটি জানান দেয় ভালোবাসার মানুষকে হারানোর বেদনা কতটুকু।
সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে ঢাকা ভিজিটের সময় মাদার তেরেসা এই চার্চ প্রাঙ্গণেই ছিলেন। স্থানটি একটি কবর স্থান, কোনো ঘোরার স্থান নয়। তাই অধিকাংশ সময়েই সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। তাই যাওয়ার আগে খোঁজ নিয়ে যাবেন।
জেএমএস/এএসএম