একদিনের রাঙ্গামাটি ভ্রমণে যা যা দেখলাম

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৪৬ পিএম, ৩১ মে ২০২২

ইসতিয়াক আহমেদ

অস্থির এক রাত কাটানোর পর যখন সকাল হলো তখন পাখির কলকাকলিতে মুখর ডিভাইন লেক আইল্যান্ড রিসোর্ট এর পুরো প্রান্তর। রাত ভর চাঁদের আলোয় আড্ডা দেয়ায় সকালে একটু দেরি করেই উঠলাম আমরা। অতঃপর বুফে ব্রেকফাস্ট করে ব্যাগ বস্তা গুছিয়ে নিলাম।

এরই মধ্যে আমাদের জন্য নির্ধারিত নৌকা সেই ভোরেই চলে এসেছে। অথচ আমরা যখন চেকআউট করলাম তখন প্রায় দুপুর সাড়ে ১২ টা। অভিজাত এক নৌকায় গাঁ এলিয়ে বসলাম আমরা। প্রায় ২৫ জন ধারণ ক্ষমতার নৌকাটিতে আমরা যাত্রী হলাম টিম ঘুরুঞ্চির মাত্র ৯ জন। অতঃপর যাত্রা শুরু, কাপ্তাই লেকের রুপ গিলতে গিলতে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাঙ্গামাটি জেলা। আর এই জেলার কাপ্তাই উপজেলা জুড়েই আছে অনন্য পাহাড়, লেকের অ থৈ জলরাশি ও চোখ জুড়ানো সবুজের সমারোহ। ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই কৃত্রিম হ্রদ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে বড়।

একদিনের রাঙ্গামাটি ভ্রমণে যা যা দেখলাম

সেখানে চোখে পড়ে ছোট-বড় পাহাড়, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, ঝরনা আর পানির সঙ্গে সবুজের মিতালী। একদিকে পাহাড়ে আছে যেমন বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্ভার, তেমনই লেকের অ থৈ জলে আছে বহু প্রজাতির মাছ ও অফুরন্ত জীববৈচিত্র্য। লেকের চারপাশের পরিবেশ, ছোট ছোট দ্বীপ, নানাবিধ পাখি ও জল কেন্দ্রিক মানুষের জীবনযাত্রা আপনাকে মুগ্ধ করবে প্রতি মূহুর্তে।

একদিনের রাঙ্গামাটি ভ্রমণে যা যা দেখলাম

কৃত্রিম হলেও প্রকৃতি যেন তার সবটুকু রং ও রূপ ঢেলে দিয়েছে কাপ্তাই হ্রদকে। সারা বছরই কাপ্তাই লেক ভ্রমণের জন্য যাওয়া যায় তবে বর্ষায় লেকের পাশের ঝরনাগুলোর পরিপূর্ণ রূপের দেখা মেলে। কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলী নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এতে রাঙ্গামাটি জেলার ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি ডুবে যায়। আর সেই সঙ্গে সৃষ্টি হয় কাপ্তাই হ্রদের।

১৯৫৬ সালে আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়। প্রায় ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ ও ৫৪.৭ মিটার উচ্চতার এ বাঁধটির। বাঁধের পাশে ১৬টি জলকপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা স্পিলওয়ে রাখা হয়েছে। এ স্পিলওয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি নির্গমন করতে পারে। এ প্রকল্পের জন্য তখন প্রায় ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাজেট নির্ধারণ করা হলেও পরে তা ৪৮ কোটি ছাড়িয়ে যায়।

একদিনের রাঙ্গামাটি ভ্রমণে যা যা দেখলাম

কাপ্তাই হ্রদের কারণে ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি ডুবে যায়। যা ওই এলাকার মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ। এছাড়া সরকারি সংরক্ষিত বনের ২৯ বর্গমাইল এলাকা ও অশ্রেণিভুক্ত ২৩৪ বর্গমাইল বনাঞ্চলও ডুবে যায়। এতে প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের মোট এক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়। সেই সঙ্গে পুরোনো চাকমা রাজবাড়ি কাপ্তাই বাঁধ নির্মাষের সময় তলিয়ে যায় এই লেকেই।

কাপ্তাই লেক ঘিরেই মূলত রাঙ্গামাটি জেলার পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। পথে চলতে চলতে প্রথমেই মেচাং রেস্টুরেন্টে নেমে খাবারের অর্ডার দিয়ে আবার চেপে বসলাম। রাঙ্গামাটি আসলে ট্রলার ভাড়া করে লেকে ভ্রমণ করা যায়। ২০০০-৩৫০০ টাকার বিভিন্ন আকারের নৌকা পাবেন সারাদিন সব কিছু ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। এই নৌকা বা ট্রলারে করেই যাওয়া যায় শুভলং জলপ্রপাতে।

একদিনের রাঙ্গামাটি ভ্রমণে যা যা দেখলাম

চলার পথে লেকের পাড়ে আছে নতুন চাকমা রাজবাড়ি ও বৌদ্ধ মন্দির। আমরা প্রথমেই ছুটলাম শুভলং ঝরনার পানে। রাঙ্গামাটি সদর হতে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে শুভলং বাজারের পাশেই শুভলং ঝরনার অবস্থান। বাংলাদেশের অন্যান্য সব ঝরনার মতো শুভলং ঝরনাতেও শুকনো মৌসুমে পানি খুব কম থাকে।

বর্ষা মৌসুমে প্রায় ১৪০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে বিপুল জলধারা কাপ্তাই লেকে আছড়ে পড়ে। এছাড়া শুভলং ঝরনা দেখতে যাওয়ার পথের সৌন্দর্য আপনাকে আবেগময় করে তুলতে পারে। দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া লেক দেখে থাইল্যান্ড বলেও মনে হতে পারে!

একদিনের রাঙ্গামাটি ভ্রমণে যা যা দেখলাম

শুভলং ঝরনার সৌন্দর্য পর্যটকদের বিমোহিত করে। পাহাড়ের উপর থেকে পাথুরে মাটিতে ঝরনা ধারা আছড়ে পড়ার অপূর্ব দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অতিরিক্ত কাপড় সঙ্গে থাকলে ঝরনার শীতল পানিতে গোসল করে শরীর জুড়িয়ে নিতে পারেন। শুভলং ঝরনার কাছেই প্রায় ২০০০ ফুট উঁচু ‘শুভলং পাহাড়’ বা ‘টিএন্ডটি পাহাড়’ আছে।

পাহাড়ের চূড়ায় আছে সেনাক্যাম্প ও একটি টিঅ্যান্ডটি টাওয়ার। পাহাড়ে ওঠার জন্য আছে চমৎকার সিঁড়ি। এই পাহাড়ের উপর দাঁড়ালেই দেখতে পাবেন পুরো রাঙ্গামাটি জেলা কাপ্তাই লেকের পানির উপর ভেসে আছে। তবে এই যাত্রায় আমরা ঝরনার সৌন্দর্য সেভাবে উপভোগ করতে পারিনি। ঝরনার সৌন্দর্য দেখার সেরা সময় হলো বর্ষাকাল।

একদিনের রাঙ্গামাটি ভ্রমণে যা যা দেখলাম

কাপ্তাই লেকের বুক জুড়ে ঘুরতে ঘুরতে যদি হাঁপিয়ে ওঠেন, তবে নামতে পারেন মাস্টার পাড়া আদিবাসী গ্রামে। পাহাড়ের উপর সাজানো ছোট্ট ছিমছাম এক গ্রাম। পাহাড়ি ফল খাওয়া, সেই সঙ্গে আদিবাসীদের তৈরি নানান পণ্য কিনতে পারবেন এখানে। মাস্টার পাড়া ঘুরে ধরলাম আমরা পেট পূজো করতে।

কাপ্তাই গিয়ে কোথায় খাবেন?

কাপ্তাই লেকের মাঝখানে ছোট ছোট দ্বীপে কিছু রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে, চাইলে সেখান থেকে দুপুর কিংবা প্রয়োজনীয় খাবার সংগ্রহ করে নিতে পারেন। পেদা টিন টিন, মেজাং, জুমঘরসহ বেশ কিছু বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট আছে। সাধারণ খাবারের পাশাপাশি পাহাড়ি খাবারের স্বাদও নিতে পারবেন এসব রেস্টুরেন্টে।

একদিনের রাঙ্গামাটি ভ্রমণে যা যা দেখলাম

আমাদের খাবারতালিকায় ছিল ব্যাম্বু চিকেন, ফিশ ফ্রাই, ঘন ডাল ও সবজি। খাবার খেয়েই আমরা আবার চড়ে বসলাম বোটে। এবারের গন্তব্য ঝুলন্ত ব্রিজ। রাঙ্গামাটির বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের মধ্যে কাপ্তাই হ্রদের উপর নির্মিত ৩৩৫ ফুট লম্বা ঝুলন্ত ব্রিজ উল্লেখযোগ্য। রাঙ্গামাটিতে ভ্রমণে আসা সবাই ‘সিম্বল অব রাঙ্গামাটি’ হিসেবে খ্যাত ঝুলন্ত সেতুটি দেখতে আসেন।

কাপ্তাই লেকের বিচ্ছিন্ন দুই পাড়ের পাহাড়ের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে দিয়েছে রঙিন এই ঝুলন্ত সেতু। এই সেতুতে দাঁড়িয়ে কাপ্তাই লেকের মনোরম দৃশ্য অবলোকন করা যায়। ব্রিজের একপাশে পাহাড়ের উপর শিশুদের বিনোদনের জন্য আছে দোলনা, স্লিপার ইত্যাদি। লেকে ভ্রমণের জন্য ব্রিজের নিচে ইঞ্জিনচালিত বোট ঘণ্টা প্রতি ভাড়ায় পাওয়া যায়।

একদিনের রাঙ্গামাটি ভ্রমণে যা যা দেখলাম

ঝুলন্ত ব্রিজে প্রবেশের জন্য পর্যটন কর্পোরেশনকে জনপ্রতি ২০ টাকা ফি দিতে হয়। আর নৌকায় গেলে তা পাড়ে ভিড়ানোর জন্য ৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে বছরের যে কোনো সময়ই যেতে পারেন। তবে বর্ষায় অতি বৃষ্টি হলে অনেক সময় ঝুলন্ত ব্রিজের উপর পানি উঠে যায়। তখন ঝুলন্ত ব্রিজের উপরে যাওয়া মানা।

তাই বর্ষায় গেলে আগেই খোঁজ নিয়ে তারপর যাবেন। সাধারণত শীতের আগে আগে ও শীতকালেই পর্যটকগন ঝুলন্ত সেতু ভ্রমণে যান। রাঙ্গামাটি গেলে শুধু ঝুলন্ত ব্রিজ নয় আশেপাশে আছে আরও দর্শনীয় স্থান যা আপনি একইদিনে একসাথে ঘুরে দেখতে পারবেন।

একদিনের রাঙ্গামাটি ভ্রমণে যা যা দেখলাম

কীভাবে যাবেন রাঙ্গামাটি ভ্রমণে?

ঢাকার ফকিরাপুল মোড়, আরামবাগ, আব্দুল্লাহপুর ও সায়দাবাদে রাঙ্গামাটিগামী অসংখ্য বাস কাউন্টার আছে। এই বাসগুলো সাধারণত সকাল ৮টা থেকে ৯টা ও রাত ৮টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ১১টার মধ্যে ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে ছাড়ে। ঢাকা-রাঙ্গামাটি এসি বাসের প্রতি সিট ভাড়া ১০০০-১৬০০ টাকা। এছাড়া সব নন-এসি বাসের ভাড়া ৭৫০-৮০০ টাকার মধ্যে।

রাঙ্গামাটি ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা

>> একসঙ্গে দলগত ভাবে গেলে খরচ কমে যাবে, অফ সিজনে ও ছুটির দিন ব্যাতিত গেলে খরচ কম হবে।
>> ট্রলার/বোট রিজার্ভ করার সময় কি দেখবেন কোথায় যাবেন ভালো করে বলে নিন, রিজার্ভ করার সময় ঠিকমতো দরদাম করে নিতে হবে।
>> লেকের কাছাকাছি কোনো হোটেল ঠিক করার চেষ্টা করুন।

একদিনের রাঙ্গামাটি ভ্রমণে যা যা দেখলাম

>> কোথাও কোথাও লেকের পানির গভীরতা অনেক, নামতে চাইলে মাঝিকে জিজ্ঞেস করে নিন। অহেতুক ঝুঁকি নেবেন না।
>> একদিনেই বেশ কয়েকটি স্পট ঘুরে বেড়াতে পারবেন।
>> স্থানীয়দের সঙ্গে শালীন আচরণ করুন।

জেএমএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।