চর কুকরি মুকরিতে ক্যাম্পিং করবেন যেভাবে
ইসতিয়াক আহমেদ
চোখের দৃষ্টিসীমার পুরোটা ক্যানভাস জুড়েই শুধু সবুজ আর সবুজ। চোখ ধাঁধানো সবুজের সমারোহ। নিশ্চুপ প্রকৃতির মাঝে ক্যাম্পিং করার লোভেই এবার আমরা ছুটলাম ভোলা জেলার, চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরি মুকরিতে। সেখানে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো লঞ্চ ভ্রমণ।
প্রথম পর্বে জানানো হয়েছে কীভাবে কম খরচেই চর কুকরি মুকরি ভ্রমণে যাবে। আজ শেষ পর্বে থাকছে সেখানকার নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য উভোগ করতে ক্যাম্পিংয়ের অভিজ্ঞতা জানাবো আজ।
পেছনে বিস্তার বন, আর সামনে অকূল দরিয়া। আর এর মাঝেই ছায়া ঘেরা, বৃক্ষরাজির নিচে আমরা তাবু টানালাম। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা! টেন্ট খাটিয়ে দলবল ছাড়িয়ে, একা একা হেঁটে ক্যাম্পিং সাইটের সৌন্দর্য উপভোগে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রচুর পাখির কিচিরমিচির ছাড়া প্রায় নিস্তব্ধতা ঘিরে রয়েছে পুরো ক্যাম্পিং সাইট জুড়ে।
কেউ কেউ অবশ্য টেন্ট খাটিয়েছে পেছনেও বনের ভেতরে। আর হ্যাঁ, এই চর কিছুটা দূর্গম হলেও এখানে কিন্তু গ্রামীনফোন ও টেলিটকের মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। ঘুরতে ঘুরতেই ডাক পড়লো দুপুরের খাবারের। দেশি মুরগির মাংস, ডাল, আলুর ভর্তা আর দেশি চালের ভাত দিয়ে সেরে নিলাম। দুপুরের খাবার শেষে একটু বিশ্রাম নেওয়ার পালা।
চর কুকরি মুকরির বনে যেসব প্রাণী দেখা যায় তার মধ্যে আছে চিত্রা হরিণ, বানর, উদবিড়াল, শিয়াল, বন্য মহিষ-গরু, বন-বিড়াল, বন মোরগ, প্রভৃতি। আর পাখিও সরিসৃপ হিসেবে এই বনের অধিবাসীদের মধ্যে আছে বিভিন্ন প্রজাতির বক, বন মোরগ, শঙ্খচিল, মথুরা, কাঠময়ূর, কোয়েল, গুইসাঁপ, বেজি, কচ্ছপ, কুকুরি বনের ও নানা ধরনের সাপ।
এই চরে শীতকালের চিত্র ভিন্ন ধরনের। সূদুর সাইরেরিয়া থেকে ছুটে আসা অতিথি পাখিদের আগমনে চরাঞ্চলগুলো যেন নতুন রূপ ধারণ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এর মধ্যে সিংহভাগই ভোলায় অবস্থান করে। তখন স্বপ্নের দ্বীপ কুকরিমুকরি এর চর অতিথি পাখিদের অভয়ারন্যে পরিণত হয়।
আপনি চাইলে চর কুকরি মুকরিতে ক্যাম্পিং না করেও রাত কাটাতে পারবেন। চরফ্যাশনের এমপি জনাব জ্যাকব সরকারি অর্থায়নে রেষ্ট হাউজ করেছেন। যায় প্রতিটি রুমের ভাড়া ২০০০ টাকা ও ৫০০০ টাকা। এই রেস্ট হাউজে আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সাহেব ছিলেন দুই রাত।
এছাড়া খুব স্বল্প মূল্যে রাত কাটাতে পারেন হোম স্টে গুলোতে। তবে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে টেন্টে ক্যাম্পিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো তাই সে বিষয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
বন থেকে কুড়ানো কাঠের ক্যাম্প ফায়ার, আর অসাধারণ বাতাসে আড্ডা দিতে দিতেই রাত ঘনিয়ে এলো। ইলিশ মাছ, দেশি মুশির মাংস, আলু ভর্তা, ডাল দিতে অস্থির এক রাতের খাবার করার পালা। এরপর আবারো আড্ডায় হলো গভীর রাত।
ভোরে ঘুম ভেঙ্গে টেন্টের চেন খুলতেই দেখি টেন্ট বরাবর সূর্য উঠছে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। ভোরের কুকরি মুকরি দেখে,গতকাল কচ্ছপিয়া বাজার থেকেই কিনে আনা খাবার দিয়েই সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। চর কুকরি মুকরি থেকে কচ্ছপিয়ার ট্রলার ছেড়ে যায় সকাল ৯ টায়।
আমাদের দেরি হয়ে গেছে, তাই ধীরে সুস্থে টেন্ট গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। খেয়া ঘাটে এসে দেখি, নৌকা ঠিকই আছে কিন্তু মাঝি নেই। নৌকা এপারে তো মাঝি ওপারে। কি আর করা আমাদের দলে তো মাঝির অভাব নেই। আপাতত নুরই তুলে নিলো সেই দায়িত্ব।
নিজেরা চালিয়েই ওপারে পৌঁছালাম। হাতে যেহেতু সময় আছে, তাই উঠে পড়লাম নির্মাণাধীন ওয়াচ টাওয়ারে। যেখান থেকে বার্ডস আই ভিউতে দেখতে পাবেন নারকেল বাগানখ্যাত ক্যাম্পিং সাইট।
ম্যানগ্রোভ পেরিয়ে এসে আবারো পায়ে হাঁটা পথ ধরলাম আমরা। এবার যাওয়ার পালা ঝুলন্ত ব্রিজে। পর্যটকদের জন্য নতুন রূপে সাজানো হয়েছে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লিলাভূমি চর কুকরি মুকরি। যুক্ত করা হয়েছে রেস্ট হাউজ, বনের মাঝে ঝুলন্ত সেতু, জিপ ট্রাকিং, রেস্টিং বেঞ্চসহ নানা প্রকল্প।
এসব প্রকল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। এই ঝুলন্ত ব্রিজ এ প্রবেশের জন্য কিন্তু কোনো ফি প্রদান করতে হয় না৷। কেউ কেউ এসে জনপ্রতি ৩০ টাকা দাবি করতে পারেন। তাদের কাছে টিকিট চাবেন। টিকেট দেবে না, কারণ এখানে প্রবেশের বর্তমানে কোনো মূল্য নেই। সবার জন্য উন্মুক্ত।
চর কুকরি মুকরি ভ্রমণে কিছু পরামর্শ ও সতর্কতা:
>> চর এলাকা হওয়ায় সেখানে গাড়ির কোনো ব্যবস্থা নেই। যাদের হাঁটার অভ্যাস নেই তারা সেখানে যাবেন না।
>> হরিণ শিকার থেকে বিরত থাকুন এটা দণ্ডনীয় অপরাধ।
>> স্থানীয়দের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুন।
>> বিদ্যুতের কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই প্রচুর পাওয়ার ব্যাংক সঙ্গে রাখুন।
>> নদীতে সাঁতার কাটার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করুন।
>> গ্রামীণ ও টেলিটকের নেটওয়ার্ক ভালো এই সিমগুলো ব্যবহার করতে পারেন।
জেএমএস/এমএস