কম খরচে যেভাবে ঘুরবেন চর কুকরি মুকরি
ইসতিয়াক আহমেদ
চোখের দৃষ্টিসীমার পুরোটা ক্যানভাস জুড়েই শুধু সবুজ আর সবুজ। চোখ ধাঁধানো সবুজের সমারোহ। নিশ্চুপ প্রকৃতির মাঝে ক্যাম্পিং করার লোভেই এবার আমরা ছুটলাম ভোলা জেলার, চরফ্যাশন উপজেলার চর কুকরি মুকরিতে। সেখানে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো লঞ্চ ভ্রমণ।
রাতে লঞ্চে উঠেই ডিনার সেরে নেওয়ার পালা। লঞ্চের খাবারের বাড়তি দাম থাকলেও, দামের মতো স্বাদেও কিন্তু বাড়তি। চিংড়ি ভর্তা, ডাল, মুরগির মাংস দিয়ে ভরপুর ডিনার করে নিলাম।
ডিনার করে ঠান্ডা বাতাসে আড্ডা দিতে দিতে পৌঁছে গেলাম চাঁদপুর তিন নদীর মোহনায়। আর তখনই ভয়াবহ এক ঝড়ের মুখে পড়লাম। এই যাত্রায় ভাগ্য সহায় থাকায় হয়তো বেঁচে গেলাম। এরপর চা খেয়ে আড্ডা দিয়ে ফিরলাম কেবিনে।
ঢাকা হতে চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাট পর্যন্ত লঞ্চ রুটে যাওয়া ও আসার ভাড়া কিন্তু ভিন্ন। যাওয়ার সময় ডেক ভাড়া ৪০০ হলেও ফেরার সময় ৩০০ টাকা। সিঙ্গেল কেবিন ১২০০ ও ডাবল কেবিন ২৪০০ টাকা।
বেতুয়া ঘাটে নেমে চর কুকরি মুকরিতে যাওয়ার দুই উপায়। প্রথমটি হলো, অটো নিয়ে চলে যেতে হবে চরফ্যাশন বাস টার্মিনালে। ভাড়া জনপ্রতি ৩০-৪০ টাকা। সময় লাগবে ২০-২৫ মিনিট। চরফ্যাশন থেকে আপনি চর কচ্ছপিয়া যাওয়ার জন্য পাবেন দক্ষিণ আইচার বাস। ভাড়া জন প্রতি ৪০ টাকা। সময় লাগবে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা।
বাস থেকে নেমে আবার অটো বা রিকশায় জনপ্রতি ১৫ টাকা ভাড়ায় কচ্ছপিয়া ঘাটে পৌঁছে যাবেন। তবে আমরা সরাসরি বোরাক নামক রিকশা রিজার্ভ করেই ছুটেছি কচ্ছপিয়া ঘাট। ৪ জন বেশ সহজেই আরাম করে বসা যায় রিকশায়। গাড়ি ভাড়া ৪০০ টাকা।
চর কচ্ছপিয়া থেকে চর কুকরি মুকরি যাওয়ার উপায় মূলত দুটি। জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা ভাড়ায় ট্রলারে যেতে পারেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা ও দুপুর ১২টায় লোকাল ট্রলার চর কুকরি-মুকরির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
ট্রলার ছাড়ায় যেতে পারেন স্পিড বোটে ভাড়া জন প্রতি ১৫০ টাকা। যদি দল যদি ভারি হয় আর দামাদামিতে পররদর্শী হলে আরও কমেও যেতে পারবেন। আমাদের ৩ জনের ভাড়া পড়েছিল ৪০০ টাকা।
দুই পাশের ম্যানগ্রোভ বন কাটিয়ে যখন আপনি ছুটে চলবেন, তখন উপভোগ করবেন স্বর্গসুখ! ট্রলারে ১ ঘণ্টার বেশি সময় লাগলেও স্পিড বোটে এই জার্নি মাত্র ১৫ মিনিটের।
চর কুকরি মুকরির ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, ১৯১২ সালে এই চর জেগে ওঠে। কথিত আছে, একসময় চর কুকরি মুকরিতে শুধু কুকুর আর ইঁদুরের বাস ছিল। স্থানীয়দের কাছে যা মেকুর নামে পরিচিত। এ কারণেই চরের নামকরণ করা হয় কুকরি মুকরি।
লঞ্চ ঘাট থেকে ক্যাম্পিং সাইট নারকেল বাগান যেতে পারবেন দুই উপায়। মোটরসাইকেল অথবা অটোতে। মোটরসাইকেলে জনপ্রতি ভাড়া ৫০ টাকা আর অটোতে ২০-২৫ টাকা। যান চলার পথ শেষ হলেই শুরু পায়ে হাঁটার পথ।
ম্যানগ্রোভ বন মারিয়ে এ যাত্রায় পথ চলা। পথ চলার সঙ্গী হিসেবে স্থানীয় ছোট শিশুদের নিতে পারেন। ১০-২০ টাকার বিনিময় নারকেল বাগান পর্যন্ত পথ চিনিয়ে দেবে তারা। ম্যানগ্রোভ বন পেরিয়েই ঘাট, ছোট্ট একটি খেয়া পার হলেই নারকেল বাগান ক্যাম্পিং সাইট।
কয়েক ফিটের খেয়া পার হতে জনপ্রতি ১০ টাকা করে দাবি করে যদিও। সেখান থেকে তারুয়া যেতে চাইলে ট্রলার পাবেন। রিজার্ভ ট্রলার নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন সময় করে ভার্জিন বিচ খ্যাত তারুয়া থেকে।
শীতকালে চর কুকরি মুকরির আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আবার এখানে ক্যাম্পিং করার জন্য শীতকালেই উপযুক্ত সময়। বর্ষায় চরের সিঙ্ঘভাগই ডুবন্ত থাকে তাই বর্ষাকালে চর কুকরি মুকরি ভ্রমণে না যাওয়াই ভালো। চর কুকরি মুকরি ভ্রমণের জন্য জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস সবচেয়ে আদর্শ সময়।
১৯৮৯ সালের ১৪ মে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার একর জমিতে সংরক্ষিত শ্বাসমূলীয় ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষের বনায়ন শুরু হয়। চর কুকরি মুকরির বনভূমিতে স্থান পেয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, কেওড়া, নারিকেল, বাঁশ ও বেত।
বর্তমানে কুকুরি মুকুরি চরে বনভূমির পরিমাণ ৮ হাজার ৫৬৫ হেক্টর, যার মধ্যে ২১৭ হেক্টর জমি বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম। বসতি ও কৃষি আবাদর জন্য প্রায় ৪ হাজার ৮১০ হেক্টর জমি রয়েছে। মাছ ধরা ও কৃষিকাজ চর কুকরি মুকরিতে বসবাসকারী মানুষের প্রধান পেশা।
পেছনে বিস্তার বন, আর সামনে অকূল দরিয়া। আর এর মাঝেই ছায়া ঘেরা, বৃক্ষরাজির নিচে আমাদের টেন্ট। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা! চর কুকরি মুকরিতে ক্যাম্পিং করার উপায় জানবেন পরের পর্বে...
জেএমএস/এমএস