সত্যিই কি ভুতূড়ে ফয়’স লেক?

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:০৩ পিএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

ইসতিয়াক আহমেদ

বাংলার ঐতিহাসিক এক অঞ্চল এটি। যেখানে প্রথম ইউরোপীয়রা উপনিবেশিক ছিটমহল স্থাপন করে। বলছি
পোর্তো গ্রান্ডে দি বেঙ্গলারের কথা। ইংরেজিতে গ্র্যান্ড পোর্ট অব বেঙ্গল। এটি মূলত ১৬ ও ১৭ শতকের সময়ে চট্টগ্রামে পর্তুগিজ উপনিবেশ।

বঙ্গোপসাগরের এই অন্যতম বাণিজ্যিক অঞ্চলটি বিভিন্ন সময় নানা জাতি-গোষ্ঠির উপনিবেশ ছিল। পর্তুগিজরা ১৫২৮ সালের দিকে চট্টগ্রামে প্রথম আসে। মুঘল বিজয়ের পরে ১৬৬৬ সালে আবার চলে যায়।

jagonews24

এরপর চট্টগ্রাম মুঘলদের হাতে চলে আসে। এর নামকরণ করা হয় ইসলামাবাদ। বাংলাদেশের প্রথম জেলা চট্টগ্রাম। যা কি না ১৬৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর দ্বিতীয় জেলা উত্তরের রংপুর। চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ফয়’স লেক অন্যতম।

যা যা দেখবেন ফয়’স লেকে

খুলশি এলাকার প্রধান সড়কের পাশে ফয়’স লেকের তোরণ। সেখান থেকে কিছুটা ভেতরে এর মূল প্রবেশ পথ। শুরুতেই ফয়’স লেকের অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ড। দীর্ঘ সময় অযত্নে পড়ে থাকায় একসময় জৌলুশ হারাতে বসে প্রাচীন এই লেক।

jagonews24

ফয়’স লেকের প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ২০০৫ সালে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও রিসোর্ট। ফয়’স লেকের পাশেই আছে চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বাটালি হিল।

লেকের আশেপাশের মনোরম পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি বহু পর্যটক ছুটে আসেন। ফয়েজ ফয়েজ লেক চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় অবস্থিত একটি কৃত্রিম হ্রদ।

jagonews24

এটি ১৯২৪ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে খনন করা হয়। সে সময় পাহাড়তলী লেক হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে ইংরেজ রেল প্রকৌশলী ফয় এর নাম অনুসারে ফয়েজ লেক নামকরণ করা হয়।

হ্রদটি তৈরির উদ্দেশ্য ছিল, রেল কলোনিতে বসবাসকারী লোকদের নিকট পানি পৌঁছানো। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাভুক্ত। বেশ বড় মাপের (৩৩৬ একর জমির উপর) এই হ্রদটি পাহাড়ের এক শীর্ষ থেকে আরেক শীর্ষের মধ্যবর্তী একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় আড়াআড়ি ভাবে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সৃষ্ট।

jagonews24

বাঁধটি চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকের পাহাড় শ্রেণির থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহের দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই লেকটিকে সৃষ্টি করেছে। ফয়েজ হ্রদের পাশেই আছে চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বাটালি পাহাড়।

চট্টগ্রামের দিক থেকে ফয়’স লেক এন্টারটেইনমেন্ট ওয়ার্ল্ডের প্রবেশপথ সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন হয়েছে। তবুও লেকটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখনও খুব স্পষ্ট। তাই অনেক দর্শনার্থীরা চিত্তবিনোদন পার্কটি অতিমাত্রায় উপভোগ করেন। আবার অনেকে ফয়’স লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশি উপভোগ করে।

jagonews24

বেশ কিছু আধুনিক রাইড আছে এখানে। সার্কাস সুইং, বাম্পার কার, বাম্পার বোট, ফ্যামিলি রোলার কোস্টার, জায়ান্ট ফেরিস হুইল, ড্রাই স্লাইড, ফ্যামিলি ট্রেইন, প্যাডেল বোট, ফ্লোটিং ওয়াটার প্লে, পাইরেট শিপের মতো মজাদার সব রাইড।

এখান থেকে উপরে টিলায় আছে বনভোজন কেন্দ্র। সেখান থেকে আরেকটি টিলার উপরে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। চট্টগ্রাম শহরের বার্ডস আই ভিউ দেখা যায় জায়গাটি থেকে। ফয়’স লেকে দেখার মত আছে অনেক কিছু।

jagonews24

শিশুদের জন্য যেমন নানা রকম রাইডের ব্যবস্থা আছে তেমনি বড়রাও খুজেঁ পাবেন পাহাড়-লেক, সব মিলে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। এ অঞ্চলের চারদিকে পাহাড় আর মাঝখানে রয়েছে অরুনাময়ী, গোধূলী, আকাশমনি, মন্দাকিনী, দক্ষিণী, অলকানন্দা নামের হৃদ।

হৃদের পাড়ে যেতেই দেখা মিলবে সারি সারি নৌকা। নৌকায় যেতে মিনিট দশেক লাগবে। তারপরই দেখা মিলবে দুই দিকে সবুজ পাহাড়, মাঝে মধ্যে দু-একটি বক এবং নাম না জানা হরেক রকম পাখি।

এর সঙ্গে আছে মনোরম পরিবেশে হরিন বিচরণ স্থান। পর্যটক আকর্ষণ করার জন্য একটি ছোট চিড়িয়াখানা ফয়’স লেক প্রবেশদ্বারে স্থাপন করা হয়েছে। ফয়’স লেকের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে লেকের সৌন্দর্য ও তার পার্শ্ববর্তী পাহাড়।

jagonews24

এখানে যারা বেড়াতে আসেন তাদের বেশিরভাগই জানেন না, একাত্তরে ফয়’স লেকের আশপাশের অনেক বাঙালি শহীদ হন। নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডের জন্য স্থানীয়ভাবে পাহাড়তলী ফয়’স লেক এলাকা জল্লাদখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ধারণা করা হয়, এটি দেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি।

১৯৭১ সালের বিশতম রোজায় স্থানীয় পাঞ্জাবী লেইন (বর্তমানে শহীদ লেইন), ঝাউতলা, পাহাড়তলীসহ চট্টগ্রাম নাজিরহাট রুটে চলাচলকারী ট্রেন থেকে ধরে এনে কমপক্ষে ৫ হাজার বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করে পাকবাহিনী।

স্থানীয় বিহারি-পাঞ্জাবি ও তাদের এদেশীয় রাজাকার আলবদররা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বধ্যভূমিটির শুধু একটি গর্ত থেকেই প্রায় ১১০০ মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বধ্যভূমির বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ৫০০০ মানুষকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হয়।

ফয়’স লেকে ভূতের আনাগোনা!

ফয়েজ লেক দিনের বেলা আনন্দ আর উৎসবের এলাকা হলেও, রাতে পরিণত হয় ভৌতিক স্থানে। লেকের এক পাশে নৌকা নিয়ে ভ্রমণ নিষেধ। সেখানে একটা ওয়ার্নিং বোর্ডও লাগানো আছে। শোনা যায় যে, ওই পাশে একটি পাথরের দ্বীপ আছে। একবার কেউ সেখানে চলে গেলে সে আর সহজে পথ খুঁজে পায় না।

jagonews24

অনেকেই দূর থেকে ওই দ্বীপে একটি মেয়েকে ঘুরে বেড়াতে দেখেন। অনৈকের বর্ণনা থেকে জানা যায়, মেয়েটি চুল খুলে ও বিষণ্ণ মন ঘুরে বেড়ান। এছাড়াও ফয়েজ লেকের মধ্যকার কয়েকটি বড় মূর্তি মাথায় মাগরিবের আজানের সময় কালো চাদরে জড়ানো এক বৃদ্ধ নারীকে বসে থাকতে দেখা যায়।

ফয়েজ লেকের পানিতে ডুবে বছরে প্রায় ৪-৫ জন মানুষ মারা যায়। এছাড়াও স্থানীয়রা গভীর রাতে লেক সংলগ্ন এলাকায় কারও চিৎকার শুনতে পায় ও সাদা আলো দেখা যায়।

কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন?

দেশের যে কোনো স্থান থেকে প্রথমে যেতে হবে চট্টগ্রাম শহরে। সেখানকার জিইসি মোড় থেকে সিএনজিতে ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা নেবে। রিকশায় নেবে ৪০ টাকা। এক বিকেলে ঘুরে শেষ করা যাবে না। তাই একদিনের প্ল্যান থাকলে সকাল বেলা চলে যাওয়াই ভালো।

শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং শুক্রবার ও শনিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। ফয়’স লেকের অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ডের সাধারণ প্রবেশমূল্য ২৫০ টাকা। তিন ফুটের চেয়ে কম উচ্চতার শিশুদের প্রবেশ মূল্য লাগে না।

এখানকার বিভিন্ন রাইডে চড়ার আলাদা আলাদা মূল্য আছে। তবে প্রবেশ ও সব রাইডের বিশেষ প্যাকেজও আছে। বনভোজন দলের জন্য খাবারের আয়োজনসহ বিশেষ মূল্যও আছে ফয়’স লেকে। ফয়’স লেকের রিসোর্টের কক্ষ ভাড়া ৪ হাজার ৯৩৫ থেকে ১০ হাজার ৫০৮ টাকা। এছাড়াও বাংলোর কক্ষ ভাড়া ৫ হাজার ৫৬৩ থেকে ৯ হাজার ৮৯০ টাকা।

জেএমএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।