বিশ্বের রহস্যময় ১০ রেইনফরেস্টে কী আছে?
পৃথিবী ও মানুষের জীবন রক্ষায় রেইনফরেস্টের গুরুত্ব অপরিসীম। রেইনফরেস্ট বা চিরহরিৎ বন হলো এমন এক ধরনের বাস্তুসংস্থান, যা উচ্চমাত্রার বৃষ্টিপাত দ্বারা চিহ্নিত। অত্যধিক উচুঁ প্রজাতির বৃক্ষরাজির ঘনস্তর। সব ধরনের রেইনফরেস্টের মধ্যে বেশি আর্কষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ হলো গ্রীস্মমণ্ডলীয় রেইনফরেস্ট বা চিরহরিৎ বনাঞ্চলগুলো।
যদিও রেইনফরেস্ট মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার্থে খুবই মূল্যবান; তবুও মানুষের ক্রিয়াকলাপই এসব বনভূমি ধ্বংসের নেপথ্যে আছে। কানাডা, উত্তর আমেরিকা,অসট্রেলিয়া এবং প্রাক্তন সোবিয়েত ইউনিয়ন(রাশিয়া) সহ বিশ্বজুড়ে অনেক নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলগুলোতে চিরহরিৎ বনভূমি আছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থলজ জীববৈচিত্র্যের ৫০ ভাগ পাওয়া যায় রেইনফরেস্ট বা চিরহরিৎ বনাঞ্চলে। রেইনফরেস্টগুলো কমপক্ষে ২৫০ কোটি টন কার্বন গ্রহণ করে থাকে। বিশ্বে বেশ কয়েকটি রেইনফরেস্ট আছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় রেইনফরেস্টগুলোতে লুকিয়ে আছে নানা রহস্য ও বিস্ময়। যা হয়তো এখনও সবার সামনে আসেনি। জেনে নিন বিশ্বের শীর্ষ ১০ রেইনফরেস্টের রহস্য-
১. আমাজন
বিশ্বের বৃহত্তম জঙ্গল আমাজন। এটি বিশ্বের বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট এবং দক্ষিণ আমেরিকার ৪০ শতাংশ জুড়ে মোট ৯টি দেশ জুড়ে এর অবস্থান। আমাজনে বিশ্বের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি গাছ-পালা আছে। আনুমানিক ৩৯০ বিলিয়ন স্বতন্ত্র গাছ আছে যা ১৬ হাজার প্রজাতির মধ্যে বিভক্ত। পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন আসে আমাজন থেকে। এর জন্যে একে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়। আমাজন পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের একটি।
আমাজন নদী বেশির ভাগ নদীর উৎস। এই নদী বিশ্বে প্রচুর পানির যোগান দিয়ে থাকে। এ ছাড়াও আমাজনে ৪৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, ৪২৮ প্রজাতির উভচর, ৩৭৮ প্রজাতির সরিসৃপ এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। পাশাপাশি আমাজন নদীতে ৩ হাজার প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী আছে।
আমাজন জঙ্গলে ৩০০ এরও বেশি উপজাতি বাস করে। মোট ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। তারা বেশিরভাগই ব্রাজিলিয়ান। এ ছাড়াও পর্তুগীজ, স্প্যানিস ইত্যাদি ভাষায় তারা কথা বলে। যদিও তাদের নিজস্ব ভাষা আছে। এদের মধ্যে কিছু যাযাবর। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই।
২. কঙ্গোলিজ রেইনফরেস্ট
এই রেইনফরেস্টের আয়তন ১ কোটি ৭ লাখ ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ক্যামেরুন, গ্যাবন, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, নিরক্ষীয় গিনি অঞ্চলগুলো নিয়ে এই রেইফরেস্টের অবস্থান।
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের কঙ্গোলিজ রেইনফরেস্ট কঙ্গো অববাহিকার বেশিরভাগ অংশসহ ৬টি দেশ জুড়ে অবস্থিত। কঙ্গোলিজ রেইনফরেস্ট বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট। ১৯৯০ সাল থেকে মধ্য আফ্রিকার বন উজানের হার অন্যান্য বনাঞ্চলের মধ্যে সর্বনিম্ন।
৩. নিউ গিনি রেইনফরেস্ট
বিশ্বের আরেকটি বৃহত্তম রেইনফরেস্টের অবস্থান নিউ গিনিতে। এর আয়তন ২ লাখ ৮৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ইন্দোনেশিয়া ও পাপুয়া নিউ গিনি জুড়ে এ রেইনফরেস্টের অবস্থান। নিউ গিনির রেইন ফরেস্ট পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপের প্রায় ৬৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে আছে। দ্বীপটি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বৃহত্তম বৃষ্টিপাত এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রেইনফরেস্ট হিসেবে পরিচিত।
পৃথিবীতে এমন কয়েকটি জায়গা আছে, যা নিউ গিনি রেইনফরেস্টের বৈচিত্র্যকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ঘন ক্রান্তীয় বৃষ্টিপাত থেকে উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ পর্যন্ত এ দ্বীপে বিশ্বের বেশ কয়েকটি অনন্য উদ্ভিদ এবং প্রাণী আছে। এ ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের চেয়ে এখানে অর্কিডের বেশি প্রজাতি পাওয়া যায়।
৪. ভালদিভিয়ান তাপমাত্রা রেইনফরেস্ট
চিলি ও আর্জেন্টিনা জুড়ে অবস্থিত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেইনফরেস্ট হলো ভালদিভিয়ান। বিশ্বের প্রান্তে রেইন ফরেস্ট হিসেবে পরিচিত। এটি বিশ্বের সর্ব দক্ষিণের বৃহত্তম জঙ্গল। এর আয়তন ২ লাখ ৪৮ হাজার ১০০ বর্গ কিলোমিটার।
ভালদিভিয়ানা বনটি দক্ষিণ দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। এটি বিশ্বের বৃহত্তম তাপমাত্রাযুক্ত রেইন ফরেস্ট। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যও অনেক সুন্দর। ফার্ন, বাঁশ এবং চিরসবুজ অ্যাঞ্জিওস্পার্ম গাছের ঘন বন এটি।
৫. হার্ট অব বোর্নিও
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ব্রুনেই নিয়ে এই রেইনফরেস্টের অবস্থান। বোর্নিও রেইন ফরেস্টের বয়স প্রায় ১৪০ মিলিয়ন বছর পুরোনো বলে অনুমান করা হয়। সেই হিসাবে, এটিকে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন রেইন ফরেস্ট বলা হয়। এর আয়তন ২ লাখ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার।
বিশ্বের বিভিন্ন গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের মতো, বোর্নিও রেইন ফরেস্ট কাঠ, পাম তেল, সজ্জা, রাবার এবং খনিজের কারণে উজাড় করা হয়। বিগত ৪০ বছরে ৩০ শতাংশ বন হারিয়েছে। এর ফলে বড় আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণীরা যেমন- ওরেঙ্গুটান এবং হাতি ঝুঁকির মধ্যে আছে।
৬. প্রশান্ত মহাসাগরীয় তাপমাত্রা রেইনফরেস্ট
৬০ হাজার ২৪৬ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত এই রেইনফরেস্টটি। কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে অবস্তিত এই রেইনফরেস্টটি আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডের প্রান্ত থেকে কানাডার উপকূলীয় ব্রিটিশ কলম্বিয়া পর্যন্ত বিস্তত। সেখান থেকে আবার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওরেগন এবং ওয়াশিংটনের উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত প্রশস্ত উপকূলীয় নাতিশীতোষ্ণ রেইন ফরেস্ট এটি।
এই রেইনফরেস্টটি দক্ষিণ পূর্ব আলাস্কার টোঙ্গাস জাতীয় বনভূমিতে যুক্ত হয়েছে। আমেরিকার বৃহত্তম জাতীয় বন এবং কানাডার গ্রেট বিয়ার রেইন ফরেস্টে গেলে দেখা মিলবে স্পিটি বিয়ার, কালো ও সাদা ভাল্লুকের বিরল রূপ।
৭. সুমাত্রার ক্রান্তীয় রেইনফরেস্ট হেরিটেজ
ইন্দোনেশিয়ার ক্রান্তীয় রেইনফরেস্টটির আয়তন ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম দ্বীপটি একসময় এক উপকূল থেকে অন্য উপকূল পর্যন্ত ঘন জঙ্গলে আবৃত ছিল। বিগত ৩৫ বছরে সুমাত্রার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছে। এই বনে থাকা বাঘ, গণ্ডার, ওরেঙ্গুটান এবং হাতি সবই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে।
৮. পূর্ব অস্ট্রেলিয়ান তাপমাত্রা বন
ব্লু মাউন্টেনস ন্যাশনাল পার্কের সঙ্গে সংযুক্ত এই রেইনফরেস্টটির আয়তন ২ লাখ ২২ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার। মধ্য উপকূলীয় নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে দক্ষিণ পূর্ব কুইন্সল্যান্ড পর্যন্ত প্রসারিত এই অরণ্য। নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল এই বনভূমি।
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ-তালিকায় ব্লু মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্কের নাম আছে। এই রেইফরেস্টে গেলে দেখা মিলবে, বালির পাথর, জলাশয়, ইউক্যালিপটাস বন এবং বিরল সব উদ্ভিদ এবং প্রাণীর প্রজাতিদের।
৯. বোসাওস বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ
নিকারাগুয়ার প্রায় ৫ শতাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই ক্রান্তীয় রেইনফরেস্টটি। পশ্চিম গোলার্ধের (অ্যামাজনের পরে) দ্বিতীয় বৃহত্তম রেইনফরেস্ট হিসাবে গঠিত এটি। ১৯৯৭ সাল থেকে এই রেইনফরেস্টটি ইউনেস্কোর বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের তত্ত্বাবধায়নে আছে। বিশালাকার সব বিরল গাছপালাসহ বন্যপ্রাণীতে ঠাসা এই অরণ্য।
১০. ওয়েস্টল্যান্ড তাপমাত্রা রেইনফরেস্ট
১১ হাজার ৮৮০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে নিউজিল্যান্ডের এই তাপমাত্রা রেইনফরেস্টের অবস্থান। নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ দ্বীপের মধ্য পশ্চিম উপকূল বরাবর অবস্থিত এটি। এই অঞ্চলে বাদামী কিউইসহ কমপক্ষে ২৮ প্রজাতির বিরল পাখি আছে। অঞ্চলটি বেশিরভাগই জাতীয় উদ্যান বা সংরক্ষণাগার দ্বারা সুরক্ষিত। এটি বিশ্বের সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ রেইন ফরেস্টের মধ্যে অন্যতম।
আজ বিশ্ব রেইনফরেস্ট দিবস। ২০১৭ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। রেইন ফরেস্ট দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো রেইন ফরেস্ট ভিত্তিক কমিউনিটি প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন ঘটানো। যা বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে স্থানীয় জনগণ এবং বন্যজীবনে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। সেইসঙ্গে বন উজার বন্ধ ও বনাঞ্চল টিকিয়ে রাখার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে দিবসটি পালিত হয়।
জেএমএস/এএসএম