মনোলোভা ল্যান্ডস্কেপের শহর ডুসেলডার্ফ
মোস্তফা মহসীন
রডোডেনড্রন, টিউলিপ, জিনিয়া হাতড়ে হলুদ প্লাস্টার করা বাড়ির থাম বসানো প্রশস্ত বারান্দা। যখন সেখানে এসে দাঁড়ালাম; ততক্ষণে পদশব্দে সচকিত হয়ে গৃহকর্তা মানুয়াল মাথেউস সদর দরজার কপাট খুলে দিয়েছেন। প্রাতরাশপর্ব অধিকাংশ জার্মান চা বা কফি দিয়েই সূচনা করেন। তারপর ব্রেড বা রোলের সঙ্গে মাখন, মধু, পনির, জেলির সমাহার। সঙ্গে কলা, আপেলসহ বিবিধ ফল তো থাকেই।
পেশায় আইনজীবী মাথেউসসের বাড়িটি বেশ সুন্দর। ঘোমটার মতো ঢেকে আছে ছাদ। দেয়ালে গথিক যুগের অয়েল পেইন্টিং। বসার ঘরে সবুজ আর লালের মিশ্রণে তৈরি কার্পেট। এর মধ্যেই পর্দা তুলে বানানো ডাইনিংরুম। প্রগলভ মুহুর্তের মধ্যেই চিরকুমার মাথেউসের বাড়িতে পূর্বনির্ধারিত প্রাতরাশটি সুসম্পন্ন হলো।
সদালাপী মাথেউস মুচকি হেসে জানতে চান-‘ভি জিনিয়েট ডু দাস ডয়চে লান্ড?(জার্মান দেশটা কেমন উপভোগ করছ?)বলি,‘সেহর স্কান। ইছ বিন ফসজিনিয়াট ফন সিনেমে আউশেন’ (খুবই সুন্দর, বলা যায় আমি এর রুপে মুগ্ধ)।‘বীর সেহেন উন্স ওয়েডের’ (পুনরায় দেখা হবে) নিশ্চয়তা দিয়ে বাড়ির চৌকাঠ পেরোই।
দেখলাম, বাড়ির দু’পাশ থেকে শুরু করে প্রধান দরজা পর্যন্ত দীর্ঘ ঋজু ওকগাছের সারি। এদের ঘন পল্লবিত, সুদূর প্রসারিত শাখা-প্রশাখা দেখতে ভীতিকর। বাংলাদেশিদের কাছে মনে হতে পারে কিছুটা ভৌতিক! জনবিচ্ছিন্ন ছায়াচ্ছন্নতা আসলে কি জিনিস; এখানে ঢুঁকবার মুহূর্তেই টের পেয়েছি।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের মতো এখানে কোনো আইনজীবীর চেম্বারেই বইপত্র-ঠাসা দেখিনি। সবার সামনেই একেকটা ল্যাপটপ। আইনজীবীরা দেখলাম শুধু মোয়াক্কেল এর নিকট থেকে বিস্তারিত বিষয় বুঝে নিয়ে নোট নিয়েই ক্ষান্ত হন না; সমাধানের পদ্ধতিও বাতলে দেন। বাকি কাজটুকু করেন তাদের জুনিয়র বা সহকারীরা।
মাথেউসের বাড়ির মতোই একচালা বাড়িগুলো পুরো জার্মানি জুড়ে প্রচলিত। স্থানটির নাম ড্যারেনডার্ফ। ডুসেলডার্ফ এর অন্তর্গত একটি ছোট শহর। উত্তর-রাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের রাজধানী শহর হচ্ছে ডুসেলডার্ফ। বড় নদী রাইন এবং ছোট নদী ডাসেল এর সঙ্গম আর ৬ লাখ মানুষের পদস্পর্শে মুখরিত মনোলোভা ডুসেলডার্ফ। এই শহরের মনোমুগ্ধকর রুপে মজেছিলেন স্বয়ং নেপোলিয়ন।
রাইন নদীর বুকের উপর দাঁড়িয়ে শহরটিকে ভূষিত করেছিলেন '‘লিটল প্যারিস’ অভিধায়। এ শহরের অনেক ঐতিহাসিক বাড়ি ইট থেকে তৈরি হলেও অর্ধ-কাঠযুক্ত এবং সম্পূর্ণ কাঠযুক্ত বাড়ি দেখা যায় প্রচুর, তবে তা বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলে। ডুসেলডার্ফের আধুনিক বাড়িগুলো প্রায়শই বালি এবং চুনাপাথরের তৈরি গথিক স্টাইল, রোমানেস্ক স্থাপত্য নিয়ে সমৃদ্ধ।
ড্যারেনডার্ফ থেকে ওঠেছি উবানে। নামবো ডুসেলডার্ফ হপ্ট বানুফে। এখানকার প্রধান রেলওয়ে স্টেশনটি হলো হপ্ট বানুফে। নেতিয়েপড়া গাছে জল ঢেলে দিলে যেমন তারা প্রাণ ফিরে পায়; এখানকার বৃদ্ধ মানুষগুলোকে দেখলে আমার তা-ই মনে হয়। এই জল ঢালার কাজটি কিন্তু নিয়মিত করে যাচ্ছে রাষ্ট্র।
ট্রেনে দেখা হলো এক অশীতিপর বৃদ্ধার সঙ্গে। চামড়া কুঁচকে গেছে হয়তো কিন্তু ধবধবে ফর্সা শরীরে এক সুখী মানুষের প্রতিবিম্ব। বিরক্তির ছায়াও নেই বৃদ্ধার চোথে-মুখে। ‘গুটেন মর্গেন’ সম্ভাষণে মৃদু হাসিতে নিজের কুকুরটিকে দূরে সরিয়ে আমাকে বসার বন্দোবস্ত করে দিলেন। ট্রেন ছুটছে…
আর আমি দেখছি বৃদ্ধার ড্যাবড্যাবে চোখে সারা পৃথিবীর সৌন্দর্য। তিনি আছেন আপন ধ্যানে, কথা বলছেন বাতাসের গায়ে আঁকিবুকি কেটে। এর মধ্যেই পিঠের ঝুলি খুলে ঢোঁক ঢোঁক করে সাবাড় করে দিলেন তিন তিনটি বেক’স ব্রান্ডের বিয়ার। উত্তেজনা সামলাতে না পেরে উল্টোপাশে বসে থাকা নীলচোখের তরুণীটি; চুমোতে চুমোতে অধর রাঙিয়ে দিলো কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটির।
ভাবছি, শারীরীক গঠনে ছেলেটি বডি-বিল্ডার হলে মেয়েটিও কিন্তু কম যায়না! একেবারে মেদহীন পেলব দেহের দ্যোতনা। ঊর্ধগামী সিঁড়ি বেয়ে যখন উপরে ওঠছি; কোনোরকম সংকোচ ছাড়াই এক রোমানিয়ান মেয়ে ১০ ইউরো চেয়ে বসলো। এঙ্গেলা মের্কেল আশ্রয় দিয়েছেন। জীবনের মৌলিক সমস্যার সমাধানও করেছেন তারপরেও কেন যে ওরা ভিক্ষাজীবীই রয়ে গেল। আফসোস!
ডুসেলডার্ফ জার্মানির ধনি শহর আর সাম্প্রতিক মার্সার জরিপে জীবনযাত্রার মানের দিক দিয়ে পৃথিবীর সেরা ১০ শহরের একটি। তবও এখানে একাকিত্বে ভোগা, নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা কম নয়। ডুসেলডার্ফে তা-ই একটি বিকেল নিঃসঙ্গতার ঢেউ থেকে দূরে থাকার জন্য আলস্টাডের রিভারফ্রন্ট অন্যতম সেরা জায়গা।
কয়েক শত মাইল দীর্ঘ প্রসারিত সড়কটি ওল্ড টাউনকে সমসাময়িক মেডিয়ানহ্যাফেনের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। উপরের স্তরটিতে যেন ছবির মতোই সাজিয়ে রাখা অসংখ্য গাছ, ক্যাফে, বার। সারা দুনিয়া থেকে দর্শনার্থী এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন এখানকার প্রাণবন্ত নাইট লাইফ এবং দুর্দান্ত সব রেস্তোঁরাগুলোতে। বরাবর হাঁটার জন্য পথটি অবশ্য রেখাঙ্কিত।
বার্গপ্লাটজ পিয়ার থেকে আপনি নদীটি ক্রুজে ঘুরে দেখতে পারেন। অথবা সুর্যাস্ত মুহুর্তে নদীর তীরের দক্ষিণে প্রান্তের তীরবর্তী তীর থেকে দৃশ্যটি ফ্রেমবন্দী করে রাখতে পারেন। ইউরোপে নদী ক্রুজ শিল্প দ্রুততম ক্রমবর্ধমান সেগমেন্ট। একটি ছোট জাহাজে সমস্ত শহর চষে বেড়ানো বা দূরর্বর্তী শহরে দলবেঁধে আনন্দ-ফুর্তির জোয়ারে ভেসে বেড়ানো।
জাহাজের ভেতরেই রয়েছে খাবার-দাবারের সুব্যবস্থা। টিপিক্যাল ডুসেলডার্ফের খাবারের মেন্যু হিসাবে ‘হিমেল এবং এর্ড’ খুব জনপ্রিয়। কালো পুডিং, আলু এবং আপেলস স্যুপ ছাড়াও ‘রাইনিশার ড্যাবকোওচে’ নামে একটি থালা। যা আলু কেকের সঙ্গে ডুসেলডার্ফের জার্মানরা গ্রহণ করে থাকেন।
নয়নাভিরাম রুপের সুড়ঙ্গ আছে, আছে অন্ধগলি; তারই ফাঁকে ফাঁকে উপচে পড়ে হরিণরোদ্দুর। দুপুরের তেজোদীপ্ততায় টার্কিস ডোনার দেখলেই জিভে জল এসে যায়! মাত্র চার ইউরোতে এতো লোভনীয় ফুড আইটেম। তৃপ্তিদায়ক লাঞ্চ শেষে ডেজার্ট হিসেবে আইসক্রিম খারাপ না।
হাতের বাঁ দিকেই রেড লাইট স্ট্রীট। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম। এখানে যন্ত্রদানবরা টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছে যৌনবিলাসীতা। টাকায় উড়ছে সম্পর্কের আনন্দবেলুন! যেখানে সেজেগুছে খদ্দেরেরর জন্য অপেক্ষারত বহুজাতিক দেহপসারিণীরা। গান বাজছিলো। কাঁচে ঘেরা একেকটা ছোট ছোট ঘর থেকে তারা ডাকছেন। দর-দাম শেষে বেড়ালের মতো সরু পদক্ষেপে ওই ভবনে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন যৌনতার পাঠ নিতে আগ্রহী সুপুরুষেরা।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। রাইনের তীর ধরে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে থাকি। ব্রিজ থেকে জলের গভীরে ভালো করে তাকাই। শীতকাল তবু দিনটা কি উষ্ণ! কি একটা পাখি, ফ্লেমিঙ্গো পাখিই হবে হয়তো লাফিয়ে উঠলো রাইনের পাগলপাড়া স্রোতের উপর। মনে হলো, কিছু মাছের মতো প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে আমিও যদি ডুব সাঁতারে জলের অতলে তলিয়ে যেতে পারতাম!
ফ্লেমিঙ্গো পাখিটি লাফিয়ে ওঠার সময় বড় জাহাজটা সরে গেল দ্রুত, পেছনে তৈরি হওয়া ঘোলাটে জলের রেখাটিও মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। নদীর পাড়ে সপ্তাহান্তের পার্টি, গান-বাজনা জমে উঠেছে। সঙ্গে বিয়ার, হুইস্কি, ভদকার অফুরান যোগান। মনে মনে ভাবলাম, এখানেই যদি তাঁবু খাটিয়ে রাতটা থাকা যেত?
সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখি, লাইটার নেই পকেটে। অগত্যা গিটার হাতে কিন্তু গান না করা উচ্ছ্ল তরুণি; তার দিকেই মনোযোগ গেল। ‘মে আই হ্যাভ ইউর লাইটার? অবকোর্স’ বলে তরুণি নিজেই কাছে এসে সিগারেটটিকে দীপ্তিময় করে দিল।
জানালেন তার নাম সিলভিয়া নাইড। সে ডুসেলডার্ফের লাগোয়া বিল্কে থাকে। মগ্নতার সাথে সংগীতের ভেতর প্রবেশে সে আমাকে উদ্বুদ্ধ করল। তরুণ দলটির ভোকাল বেশ চেঁচিয়ে গান করছিল। একটি গানের লিরিক যে কারো মনোযোগ কেড়ে নেবার জন্য যথেষ্ঠ।
পীঠের উপরে অনুভব করি একটা ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। সিলভিয়ার পনিটেইল খুলে ছড়িয়ে দেওয়া চুলগুলো হাওয়ায় এলোমেলো হচ্ছিল বারবার। এরই মধ্যে ওর বয়ফ্রেন্ড পিটার এসে কয়েকগ্রাম গাঁজা হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল। জার্মানিতে গাঁজা নিষিদ্ধ হলেও তারুণ্যের প্রিয় মাদক।
স্টেশন, পার্কে, চুপিচুপি আফ্রিকান আর এশিয়ান অবৈধ অভিবাসীরা ১০ ইউরোতে এক পুটলি করে গাঁজা বিক্রি করে। এগুলোর যোগান আসে মূলতঃ নেদারল্যান্ড থেকে।ওখানে গাঁজা নিষিদ্ধ নয়। গাঁজা পাবার মৃদু হাসিতে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি ঝকমকে দাঁতগুলোও যখন বেরিয়ে পড়লো; তখন তার সুহাসিনী রুপটিও যেন বিদ্যুৎ চমকের মতো উছলে পড়লো।
সবুজ জ্যাকেটের সঙ্গে ডেনিম জিন্স (যার মাঝখানটা বিড়ম্বিত বা ছেঁড়া) আর সাদা স্নিকার সু সিলভিয়াকে দারুণ আবেদনময়ী করে তুলেছিল। ব্যাকপ্যাক হাতড়ে কাঁচি দিয়ে কেটে, কী নিপুণ ভঙ্গিমায় সিগারেটের প্রতিটি সলাকায় ভরতে লাগলো গাঁজা। তৈরি সেরে দ্বিগবিজয়ী এক সুখটান! ডুসেলডার্ফে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের একটি বিখ্যাত কবিতা,অনুবাদে যার নাম হয়েছে ‘শতদল’। এর কয়েকটি পঙক্তি আউড়াতে ইচ্ছে হলো-
কোমল পদ্ম এাসে কম্পিতা
সূর্যালোকের কঠিন ছোয়ায়,
নিমীলিত চোখে স্বপ্ন দ্যাখে সে,
স্নিগ্ধ রাত্রি একান্তে চায়।
হিমাংশু তার প্রেমিক প্রবর
ডেকে তোলে তাকে রপালি আভায়;
অবগুন্ঠন খুলে ফেলে ফুল
প্রেমিকাসুলভ মুখ তুলে চায়’
জার্মানির দিনগুলোতে নিঃসঙ্গতার পর নিঃসঙ্গতার ঢেউ আমার ওপর বয়ে গেছে ঝড়ের মতো। এর ভেতরেও ভালোবাসার কুহক থেকে আমি যে আনন্দ পেয়েছি; তার জন্যে আমাকে হয়তো জীবনের বাদবাকি মুহূর্তগলোতেও প্রতীক্ষা করে যেতে হবে দীর্ঘশ্বাসে নিঃশব্দ আর এক প্রদীপ্ত ভাবাবেগে।
জেএমএস/এএসএম