সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র আন্দু লেক
মেহেদী হাসান তালহা
সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু শাপলা। তাই তো হাজার ফুলের ভিড়ে জাতীয় ফুলের খেতাবটা নিজের করে নিয়েছে। বলছিলাম শাপলা ফুলের কথা, বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা। সেই ফুল যদি কোনো জলাশয়ে ভর্তি থাকে, তাহলে সেই জলাশয় দেখতে কেমন হতে পারে- একবার চিন্তা করে দেখুন। কল্পনার রাজ্যে এতক্ষণে নিশ্চয়ই ভর করেছে কোনো শাপলা বিলের কথা, যেখানে হয়তো ঘুরতে গিয়েছিলেন। আর যদি না ঘুরে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই কল্পনায় ছবি আঁকার চেষ্টা করছেন, কেমন হতে পারে শাপলা বিল?
একসময় আমারও কল্পনায় এমনসব চিন্তা ভর করতো। ভাবতাম, সত্যি কি ছবির মতো সুন্দর হয় শাপলা বিল? সেখানে গেলে কি কোনো ভিন্ন অনুভূতি পাওয়া যায়? সেই ভাবনা থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম, একদিন শাপলা বিলে যাবো। কিন্তু কখনো সময়ের স্বল্পতা আবার কখনো সঙ্গীর অভাবে আর যাওয়া হচ্ছিল না। অবশেষে একদিন হুট করেই সে কাঙ্ক্ষিত দিন সামনে চলে এলো।
সিলেটে এবার অনেকটা ভাইরাল পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে আন্দু লেক। স্বচ্চ পানি আর লাল শাপলার সুবিশাল রাজ্য। সবার ইতিবাচক মন্তব্য আর আর বাড়ির পাশে হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিলাম সেখানেই যাবো। যেই ভাবা সেই কাজ। লেকের দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে জুলাই গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দা ফয়সাল ভাইয়ের সাথে রাতে কথা বলে নৌকা ম্যানেজ করে নিলাম। আগে খবর নিয়ে জেনেছিলাম, এখানে পরিচিত কেউ না থাকলে না কি নৌকা পাওয়া যায় না। তাই আগেভাগেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম, যেন কোনো সমস্যা না হয়।
নৌকা ম্যানেজ হওয়ার পর ভাইয়া, আদিল আর মাহমুদকে জানালাম, আগামীকাল সকালেই আমরা যাচ্ছি আন্দু লেকে। সকাল সকাল বের হতে হবে, শাপলা ফুলের এই একটা বৈশিষ্ট্য। সূর্যের তাপ প্রখর হওয়ার সাথে সাথে তারা চুপসে যায়। তাই শাপলার মূল সৌন্দর্য দেখার আদর্শ সময় হচ্ছে সকাল ৬টা থেকে ৮টা। এ সময়ে সূর্যের তাপ কম থাকে। তাই শাপলাও তার যৌবনের রূপ দেখাতে কার্পণ্য করে না।
সকাল ৬টায় বাসা থেকে রওনা দিলাম আমি আর ভাইয়া। তখন ছোটভাইও বায়না ধরে বসলো সে যাবে। তাই তাকেও নিয়ে নিলাম। ততক্ষণে নির্ধারিত জায়গায় হাজির হয়ে গেছে আদিল আর মাহমুদ। বাল্যবন্ধু রিয়াজকেও বলেছিলাম আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য কিন্তু ঘুম থেকে উঠতে না পারায় তার আর যাওয়া হয়নি।
মিলিত হওয়ার নির্ধারিত স্থান থেকে আমরা হেঁটেই রওনা দিলাম জুলাই গ্রামের উদ্দেশে। একে তো গ্রামের কাচা রাস্তা, তার ওপর আবার একদম ভোরবেলা। তাই গাড়ির আশা ছেড়ে দিয়ে হেঁটেই ছুটে চললাম গন্তব্যে। কারণ যেকোনো ভাবেই সূর্য ওঠার আগেই পৌঁছাতে হবে লেকে।
প্রায় ১ ঘণ্টা হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম জুলাই গ্রামে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন ফয়সাল ভাই। পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকাও এসে হাজির। কোনো কালক্ষেপণ না করেই নৌকায় উঠে পড়লাম।
যেহেতু এটি স্বচ্ছ পানির লেক, পানি আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে স্বচ্ছ বর্ণ ধারণ করেছে। তাই নৌকায় উঠেই প্রথমে লেকের দু’পাড়ের কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম। লেকের উত্তর দিকে রয়েছে মাথা উঁচু করা আসাম রাজ্যের পাহাড়। দু’পাশে দুটি আলাদা আলাদা ইউনিয়ন। আর যেখানে শাপলার রাজ্য; সেখানে অন্য আরেকটি ইউনিয়নের এলাকা। সবমিলিয়ে মোট তিনটি ইউনিয়নের মিলনস্থলে অবস্থান করছে আন্দু লেক।
খবর নিয়ে জানলাম, স্থানীয়দের কাছে এটি আন্দু নদী নামেও পরিচিত। এককালে এর বুক দিয়েই সুরমার স্রোতধারা বয়ে চলতো। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার সুরমা নদীর গতিপথ বদলে দিলে কার্যত অচল হয়ে পড়ে নদীর এ অংশ। দু’পাশ ভরাট হয়ে পুরাতন সুরমা পরিণত হয় মৃত নদী বা লেক হিসেবে। নদী হিসেবে কার্যক্ষমতা হারালেও তার সৌন্দর্যে একটুও ভাটা পড়েনি।
স্থানীয়দের কাছে অপরূপ সৌন্দর্যের এক অপার সম্ভাবনাময় স্থান হলেও বাইরের পর্যটকদের কাছে এটি অচেনাই ছিল এতদিন। সবশেষ এবার যখন এখানে শাপলা ফুলের বিস্তার ঘটে; তখন মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠতে শুরু করে। স্বচ্ছ পানির পাশাপাশি দুপাশে স্বপ্নের মতো গ্রাম, আর সেই সাথে জেগে উঠলো শাপলা ফুলের রাজ্য। সবমিলিয়ে এখানে এখন প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকেও পর্যটকরা আসেন।
খুব সকাল সকাল পৌঁছায় সেখানে আমরা তেমন পর্যটকের দেখা না পেলেও অন্য দুটি আলাদা নৌকায় কয়েকজনকে দেখলাম। তারাও আমাদের মতোই সকাল সকাল চলে এসেছেন আন্দু লেকে।
আকাশের সাথে মিশে নীল বর্ণ ধারণ করা পানির ওপর দিয়ে ছুটে চলছিল আমাদের ডিঙি নৌকা। স্রোতহীন লেক, তাই ধীরে ধীরেই এগিয়ে যাচ্ছিল নৌকাটি। প্রায় ৫ মিনিট চলার পর পৌঁছে গেলাম সুবিশাল লাল শাপলার রাজ্যে। ততক্ষণে সূর্যের আলোরও তাপের তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে। স্বচ্ছ পানিতে চলছিল সূর্যের আলোর ঝলকানি। পানি আলোর ছোঁয়া পেয়ে তখন চিকচিক করছিল।
ঘণ্টাখানেক উপভোগ করলাম শাপলার সৌন্দর্য। সেই সাথে ছবি তোলা, গান গাওয়া এবং আনন্দ তো ছিলই। সবমিলিয়ে ঘণ্টাখানেকের আন্দু লেক ভ্রমণ এনে দিয়েছিল আনন্দের এক অনন্য মাত্রা। সকাল প্রায় ৯টা, সূর্য মামা তার প্রখরতা বিলাতে শুরু করেছে। তাপের কারণে শাপলাগুলোও ধীরে ধীরে চুপসে যেতে শুরু করে। যেন সূর্যের তাপের বিরুদ্ধে তাদের এই মৌন প্রতিবাদ। প্রতিবাদী সুরে তারা বলছে, তুমি তীব্রতা দেখালে আমি আমার সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখবো।
শাপলা চুপসে যাচ্ছে, আমাদের নৌকাও তার গন্তব্যে ফিরতে শুরু করেছে। শাপলার রাজ্য থেকে ফেরার পথে ভাবতে লাগলাম, আরও কিছুক্ষণ থেকে গেলে কী হতো! কিন্তু সূর্যের তাপের সাথে শাপলার প্রতিবাদের কারণে খুব দ্রুত আমাদের ফিরে আসতে হলো।
যেভাবে যাবেন: সিলেট শহরের কদমতলী বাস স্টেশন থেকে জকিগঞ্জ রোড দিয়ে প্রথমে বাংলাবাজার আসতে হবে। সিলেট শহর থেকে বাংলাবাজার আসতে আনুমানিক দেড় ঘণ্টা লাগবে। লোকাল বাসে ভাড়া নিতে পারে ৬৫ টাকা। বাংলাবাজার যাত্রী ছাউনিতে নেমে একটি রিকশা অথবা অটোরিকশা করে ভবানিগঞ্জ বাজারে আসতে হবে। ভাড়া নেবে ১৫-২০ টাকা। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করতে হবে। ভাড়া করার সময় অবশ্যই কথা বলে নেবেন। নৌকা ভাড়া ২০০-২৫০ টাকা চাইবে।
বিকল্প রাস্তা হিসেবে আপনি সিলেট নগরীর সোবহানীঘাট থেকে বাসে করে কানাইঘাট বাজারে আসবেন। ভাড়া নেবে ৬০ টাকা। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশায় সোজা চলে যাবেন ভবানিগঞ্জ বাজারে। ভাড়া নেবে ২০-২৫ টাকা। এরপর নৌকা ভাড়া করে নেমে যাবেন সুবিশাল শাপলার রাজ্যে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ।
এসইউ/জেআইএম