রঙের শহর সিডনির যতো উৎসব
মো. ইয়াকুব আলী
সিডনির সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী উৎসবের নাম ক্রিসমাস। ক্রিসমাস আসার অনেক আগে থেকেই দোকানগুলোয় ক্রিসমাসের জিনিসপত্র তোলা হয়। ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ আসতে তখনো অনেক দেরি কিন্তু তখনই দোকানগুলোয় ক্রিসমাস ট্রি থেকে শুরু করে সব রকমের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র পাওয়া যায়। ক্রিসমাস উপলক্ষে বাড়িঘরগুলোকে নানা রঙের আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়।
কিছু কিছু সিটি কাউন্সিল আলোকসজ্জার প্রতিযোগিতারও আয়োজন করে থাকে। তখন সেসব সবার্ব ভ্রমণে গেলে আপনার মনে হবে, হয়তোবা স্বর্গের কোনো রাস্তায় হাঁটছেন। ক্রিসমাসের অনেক আগেই স্কুলগুলো ছুটি হয়ে যায়। তাই বাচ্চারা ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি করতে পারে। অনেকেই বাবা-মায়ের সাথে দেশ-বিদেশ ঘুরতে বের হয়। অফিসগুলোয় অনেক লম্বা ছুটি দেওয়া হয়। যাতে পরিবারের সাথে সবাই আনন্দময় সময় কাটাতে পারে।
এ ছাড়াও বছরজুড়ে চলে বিভিন্ন দেশের মানুষের বিভিন্ন রকমের ফেস্টিভ্যাল। বাংলাদেশের মানুষদের উৎসবের মধ্যে পহেলা বৈশাখ, ঈদ এবং দুর্গাপূজা অন্যতম। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে সিডনিজুড়ে অনেকগুলো মেলার আয়োজন করা হয়। সেসব মেলায় বিশাল জনসমাগম হয়। সেখানে জিনিসপত্র বিকিকিনির পাশাপাশি চলে বিভিন্ন রকমের খাবারের স্বাদ গ্রহণ।
অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত দ্বিতীয় প্রজন্ম কিছুটা হলেও দেশের মেলার স্বাদ নিতে পারে। ইদানিং বাংলাদেশের আদলে পহেলা বৈশাখের মেলার অনুসঙ্গ হিসাবে যোগ হয়েছিল রাস্তায় আল্পনা এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ ছাড়াও বছরব্যাপী বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিনগুলোও পালন করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সিডনির এশফিল্ড পার্কে দিনব্যাপী আয়োজন করা হয় বইমেলা। সেখানে ২০০৬ সালে স্থাপন করা হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ’।
সিডনির সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে ধরা হয় সিডনি হারবার ব্রিজের ‘নিউ ইয়ার’ উপলক্ষে আতশবাজি। পৃথিবী বিখ্যাত এ আতশবাজি দেখতে সিডনিতে পর্যটকরা ভিড় করতে থাকেন অনেক আগে থেকেই। অনেকেই সিডনি হারবারে সপ্তাহখানেক আগে থেকেই তাবু টানিয়ে থাকতে শুরু করেন আতশবাজির একটি ভালো ভিউ দেখার জন্য। ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ সকাল থেকেই মানুষ জড়ো হয় সিডনি হারবারসহ আশেপাশের সব জায়গায়। অনেকেই আবার ডার্লিং হারবারেও যান।
এ ছাড়াও সিটি কাউন্সিলগুলোর উদ্যোগেও ছোট আকারে আয়োজন করা হয় আতশবাজির। দুই পর্যায়ে এ আতশবাজি চলে। রাত নয়টার সময় একবার এবং রাত বারোটার সময় একবার। রাত নয়টার সময় হয় ছোট আকারে। এরপর বারোটার সময় হয় বড় আকারে। হারবার ব্রিজের দুপাশের কংক্রিটের থামের উপর চলে আলোর প্রদর্শনী। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের উপর আলোকচিত্র পরিবেশন করা হয়। সেখানেই দেখানো হয় ‘সিডনি-সিটি অব কালারস’।
এ বছর করোনার কারণে কোনো উৎসবই আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। আর যেগুলো আয়োজন করা হয়েছিল তাতেও ছিলো অনেক বিধি-নিষেধ। তাই মানুষ মন খুলে আনন্দ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। উৎসব মানেই হাজার হাজার মানুষের সমাগম। করোনার বিস্তার রোধে সেই জনসমাগমের উপরই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
গতবছর অস্ট্রেলিয়ায় দেখা দিয়েছিল স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বন অগ্নিকাণ্ড। যেটাকে অস্ট্রেলিয়ার ভাষায় বলে ‘বুশ ফায়ার’। এরপর দেখা দিয়েছিল পানির সঙ্কট। পানির সঙ্কট মোকাবিলার জন্য পানির গৃহস্থালি ব্যবহারের উপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিশ্বের সাথে সাথে অস্ট্রেলিয়াও করোনার কবলে পড়েছে। ফলে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে।
বিভিন্ন প্রকার বিপর্যয়ের মধ্যেই প্রকৃতি চলেছে তার আপন নিয়মে। ঋতু পরিক্রমায় শীতের পরে এসেছে বসন্ত। গাছেরা সব আড়মোড়া ভেঙে নতুন সবুজ পাতায় সেজেছে। গাছে গাছে শাখে শাখে দেখা দিয়েছে হরেক রকমের ফুল। মৌমাছিরা গুঞ্জন করে ফুল থেকে ফুলে মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সময় পার করছে।
অতিসম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার বসন্তকালের সিগনেচার ফুল জ্যাকারান্ডায় ছেয়ে গেছে সিডনি শহরের রাস্তাঘাট। পাখির চোখে দেখলে মনে হবে, কোনো এক নিপুণ শিল্পী তার তুলির আঁচড়ে সিডনির সবখানে বেগুনি রং ছড়িয়ে দিয়েছেন। শীতের সময় সব পাতা ঝরিয়ে জ্যাকারান্ডা গাছগুলো থুত্থুড়ে বুড়োর মতো ঝিম মেরে বসে থাকে। বসন্তকাল এলে শুরুতেই সে শুকনো শাখাগুলোয় দেখা দেয় গাঢ় বেগুনি রঙের ফুল। এরপর একসময় ফুলগুলো ঝরে গিয়ে সব গাছ আবার সবুজ পত্রপল্লবে ভরে ওঠে।
বলা হয়ে থাকে, বেদনার রং নীল। তাহলে জ্যাকারান্ডার গাঢ় বেগুনি রংটাকেও আমরা বেদনার রং বলতে পারি। সেদিক দিয়ে বিচার করলে সিডনি এখন বেদনায় আক্রান্ত একটি অবয়ব। বুশ ফায়ার, পানি সঙ্কটের পর করোনায় সিডনির স্বাভাবিক জীবন এখন বিপর্যস্ত। তবে আমরা আশাবাদী শীতের পরে যেমন সিডনিতে বসন্তের হাওয়া এসে লেগেছে। ঠিক তেমনি করোনাকাল শেষ হয়ে সিডনিতে বইবে সুবাতাস।
সিডনি আবার ফিরে পাবে তার পুরোনো রূপ। পর্যটক এবং কর্মব্যস্ত মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে সিডনির পথঘাট। সেই সুদিনের আশায় আমরা দিন গুনছি। কারণ স্বপ্ন বা আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।
লেখক: অস্ট্রেলিয়ার সিডনি প্রবাসী।
এসইউ/এমএস