ঘুরে আসুন ঐতিহাসিক আম্রকানন ও জিরোপয়েন্ট
আম্রকানন বললে দুটি ইতিহাস ভেসে ওঠে। একটি পলাশীর; অন্যটি বৈদ্যনাথতলা। প্রথমটিতে মীরজাফরদের জন্য বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হয়। দ্বিতীয়টিতে বীর বাঙালির ইস্পাতদৃঢ় মনোবলের কারণে স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়। বৈদ্যনাথবাবুর আম্রকানন এখন ইতিহাস। পরবর্তীতে মুজিবনগর। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয় এখানেই। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। এখানেই রয়েছে স্মৃতিসৌধ।
দর্শনা থেকে কেদারগামী সড়ক। ২৬ কিলোমিটার। ২ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই মুজিবনগরের প্রবেশপথ। গেট পেরিয়েই ‘সূর্যোদয়’ রেস্ট হাউস। জেলা পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করে। আরও কয়েকটি সরকারি দফতরের রেস্ট হাউস আছে। ৫শ গজ যেতেই শিহরিত হলাম। ২৩টি পিলারের স্মৃতিসৌধ। আমাদের গর্বের। তানভীর কবিরের আঁকায় এ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। বৈদ্যনাথতলাকে স্বাধীনতার সূতিকাগার বলা হয়।
স্মৃতিসৌধের দিকে যেতেই এগিয়ে আসেন একজন। নিজের নাম বলে হ্যান্ডসেক করলেন। তার নাম সুভাষ মল্লিক। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি পাশের ভবের পাড়ায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক কিছুর সাক্ষী। বলে গেলেন ইতিহাস। স্মৃতিসৌধের বিভিন্ন পর্যায়ের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব। অনেক না জানা ইতিহাস। তিনি নিজের ইচ্ছায়ই এখানে থাকেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন স্মৃতিসৌধের পুরো এলাকা। দর্শনার্থীদের বুঝিয়ে দেন ইতিহাস। জানিয়ে দেন মুজিবনগেরর মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছু ইতিহাসও। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের হেডকোয়ার্টার্স তৈরি করা হয় এখানে। ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল উদ্বোধন করা হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধটি ২৩টি ত্রিভুজাকৃতির দেয়ালের সমন্বয়ে গঠিত। ২৩টি দেয়ালই পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসনের প্রতীক (আগস্ট ১৯৪৭ থেকে মার্চ ১৯৭১)। ৩৯.৩৭ একর জমির ওপর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয় ১৯৭৮ সালে। আড়াই ফুট উচ্চতার গোলাকার বৃত্তে শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন স্থান পেয়েছে। ৭ কোটি সংগ্রামী মানুষের প্রতীক প্রতিফলিত হয়েছে ৩ ফুট উচ্চতায় নির্মিত অপর বেদিতে।
স্মৃতিসৌধের ভেতরে মাঝখানে একটি আয়তকার লালমঞ্চ দেখিয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ মল্লিক জানান, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এখানেই শপথগ্রহণ করে। ২৪ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ফুট প্রশস্ত সিরামিকের ইট দিয়ে তৈরি এটি। প্রথম দেয়ালটির উচ্চতা ৯ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং দৈর্ঘ্য ২০ ফুট। পরবর্তী প্রতিটি দেয়ালকে ক্রমান্বয়ে দৈর্ঘ্য ১ ফুট ও উচ্চতা ৯ ইঞ্চি করে বাড়ানো হয়েছে। যা দ্বারা বোঝানো হয়েছে, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার জন্য ৯ মাস ধরে যুদ্ধ করেছিল। শেষ দেয়ালের উচ্চতা ২৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ও দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, প্রতিটি দেয়ালের ফাঁকে অসংখ্য ছিদ্র আছে। যেগুলোকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের চিহ্ন হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধটির ভূমি থেকে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু বেদিতে অসংখ্য গোলাকার বৃত্ত রয়েছে। যা দ্বারা ১ লাখ বুদ্ধিজীবীর খুলিকে বোঝানো হয়েছে। বেদিতে আরোহণের জন্য ১১টি সিঁড়িকে মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১টি সেক্টরকে বোঝানো হয়েছে। স্মৃতিসৌধের মূল ফটকের রাস্তাটি মূল স্মৃতিসৌধের রক্তের সাগর নামক ঢালকে স্পর্শ করেছে। ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী অর্থে এটি করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধের পশ্চিম পাশে প্রথম দেয়ালের পাশ দিয়ে শহীদের রক্তের প্রবাহ তৈরি করা হয়েছে, যাকে রক্তসাগর বলা হয়। তথ্যগুলো গড়গড় করে বলেই চললেন সুভাষ মল্লিক।
এরপর চললাম আরেক ঐতিহাসিক জায়গায়। অটোরিক্শায় চড়ে আম্রকাননের মধ্যদিয়ে। কমপ্লেক্সের বাইরে দিয়ে। কমপ্লেক্সটির ভেতরে আছে বাংলাদেশের বিশাল এক মানচিত্র। মুক্তিযুদ্ধকালীন এগারো সেক্টরের বিভিন্ন ঘটনা পরিক্রমা। বাইরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন স্মারক ভাস্কর্য। এটি পার হতেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আম্রকাননের গেট পার হতেই সরু পিচঢালা রাস্তা। একটু দূরেই ভারতীয় সীমান্ত। কাঁটাতারে ঘেরা। আরও ১ কিলোমিটার যেতেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ‘জিরোপয়েন্ট’। মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরসেনানীরা এপথ দিয়েই ভারতে যাতায়াত করতেন। অস্ত্রসামগ্রী লুকিয়ে রাখতেন। প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যেতেন। পাকিস্তানি কর্তৃক অত্যাচারিত বাঙালি নর-নারী শরণার্থী হিসাবে এপথ দিয়েই যাতায়াত করতেন।
মুজিবনগর গেলে কাছের এ ঐতিহাসিক জায়গায় না গেলে আফসোসই থেকে যাবে। গেটের পরেই নোম্যান্স ল্যান্ড। ঐতিহাসিক ‘বেলতলা’। এখন বিজিবি (সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশ) ও বিএসএফ’র (ভারত) মধ্যে পতাকা বৈঠক হয়, বিভিন্ন সভা হয়। স্মারক হিসাবে একটি ফ্লাগ উড়িয়ে দেওয়া হয়। কী রোমাঞ্চকর জায়গা! ভারতের গ্রাম আর অবারিত ফসলের মাঠ। চোখ জুড়িয়ে যায়! জিরোপয়েন্টে একটি বাজার আছে। এ নোম্যান্স ল্যান্ডে বিজিবির অনুমোদন নিয়ে ঢুকতে হবে। তবে গেটের কাছ পর্যন্ত অবাধে যেতে পারলাম। একটি ওয়াচটাওয়ার আছে। ওয়াচটাওয়ারে উঠে চারিদিকের দৃশ্য দেখতে খুব সুন্দর। দক্ষিণে ভারত। উত্তরে মুজিবনগরের আম্রকানন। পূর্ব-পশ্চিমে ক্ষেত। এখন বড় বড় পেঁয়াজ উৎপাদনের সিজন। নেমে জিরোপয়েন্টের বাজার থেকে বাচ্চাদের খেলনা কিনে নিলাম। বাংলাদেশ ও মুজিবনগরের স্মৃতিস্মারকের কিছু শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে চলে এলাম ‘সূর্যোদয়’এ। জেলা পরিষদ পরিচালিত একটি ডাকবাংলো। বিশ্রাম নিয়ে গন্তব্যস্থলে রওনা দিলাম।
বিশাল আম্রকানন যুদ্ধের স্মৃতি ধরে আছে এখনো। আমের মুকুলে ম-ম করছে। আম্রকানন বা আম বাগান। বাগানটির মালিক ছিলেন মেহেরপুরের ভবের পাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথ বাবু। বৈদ্যনাথ বাবুর নামানুসারেই জায়গাটির নাম হয় ‘বৈদ্যনাথতলা’। পাশের গ্রামের এখানকার দোকানদার সামসুল জানান, প্রায় ৮০ একর জায়গার উপর দাঁড়িয়ে আছে মুজিবনগর কমপ্লেক্স। আম্রকাননের জায়গার পরিমাণ প্রায় ৪০ একর। এখানে আমগাছ রয়েছে ১ হাজার ৩শ’টি। তিনটি ধাপে ছয় স্তর বিশিষ্ট দুটি গোলাপ বাগান। যা ৬ দফা আন্দোলনের রূপক। এসব তথ্য দিলেন সুভাষ মল্লিক ও কয়েকজন এলাকাবাসী।
মুক্তিযুদ্ধের বিশাল এ কমপ্লেক্সের কোথাও দর্শন করতে কোনো প্রকার প্রবেশ ফি লাগে না। সময় নিয়ে ঘুরলে মনের অজান্তেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাস জানা হয়ে যাবে।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি মুজিবনগর যাওয়া যায়। এ ছাড়া বাসে মেহেরপুর জেলা সদর। তারপর প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরের মুজিবনগরে সহজেই যাওয়া যায়। ট্রেনে গেলে চুয়াডাঙ্গা বা দর্শনা নেমে বাস বা অটোতে মেহেরপুর বা মুজিবনগর যাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে দূরত্ব ২৫-৩০ কিলোমিটার।
থাকা-খাওয়া: মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হোটেলে আবাসনের সুব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া জেলা পরিষদের স্থাপিত ডাকবাংলোয় (নাম সূর্যোদয়) ৩টি ভিআইপি কক্ষে আবাসনের ব্যবস্থা আছে। মেহেরপুর জেলা সদরে সার্কিট হাউস, পৌর হলসহ অন্যান্য আবাসিক হোটেলে আবাসনের সুব্যবস্থা রয়েছে।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
এসইউ/এএ/জেআইএম