লোভাছড়া হতে পারে সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৩৩ পিএম, ০৬ জুলাই ২০২০

মেহেদী হাসান তালহা

সবুজ প্রকৃতিকে একদম কাছ থেকে ছোঁয়ার জন্য সিলেট অন্যতম পর্যটন এলাকা। তবে সিলেটের কোন কোন স্পটে ঘুরতে যাবেন, সে সিদ্ধান্ত নিতে অবশ্যই হিমশিম খেতে হবে। কেননা সিলেটে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এত বেশি পর্যটন স্পট রয়েছে, যা একদমে গুনে শেষ করা কষ্টকর। আবার প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র আবিষ্কার হচ্ছে, যা পুরাতন পর্যটন স্পটগুলোর মতোই সমানতালে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করছে। গত কয়েক বছরে আবিষ্কার হলো রাতারগুল, ডিবির হাওর, পান্থুমাই, বিছনাকান্দি, আলুবাগান প্রভৃতি। যা বর্তমানে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

সিলেটের আরেকটি অপার সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্রের নাম হচ্ছে ‘লোভাছড়া’! শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে পর্যাপ্ত দর্শনার্থী টানতে পারছে না সিলেটের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের এ অপার লীলাভূমি। প্রকৃতির এ অপার সৌন্দর্যের স্বাদ একদম কাছ থেকে নেওয়ার জন্য বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, একদিন লোভাছড়া ঘুরতে যাবো। যেই বলা, সেই কাজ। গত কুরবানির ঠিক পরের দিন হুট করে সবাই ছুটলাম লোভাছড়ার দিকে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, বন্ধুদের সিলেট শহরের সোবহানী ঘাট পয়েন্টে এসে উপস্থিত হওয়ার কথা। সবার আগে এসে উপস্থিত হয়েছে জাহিদ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সময়ের প্রতি যথেষ্ট সতর্ক সে! কখনোই সময়ের অপচয় করে না। একে একে এসে হাজির আমি, জহুরুল, কামিল এবং গ্রুপের সবচেয়ে রসিক সদস্য মাহমুদ। যেকোনো পরিস্থিতিতে মানুষকে হাসানোর এক অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে।

in1

সবাই উপস্থিত হওয়ার পর মাইক্রোবাসে তামাবিল রোড হয়ে রওনা দিলাম কানাইঘাট বাজারের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে জহুরুল ‘আমরা হক্কল সিলটি’ গানে তার ভাঙা গলায় সুর তুললো। একে একে তার আয়ত্ত্বে থাকা সব সিলেটের আঞ্চলিক গান গাওয়া প্রায় শেষ। আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা জার্নি করে কানাইঘাট বাজারে পৌঁছে গেছি। সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলেও যখন কানাইঘাটে পৌঁছলাম; তখন সূর্যমামা মেঘের আবরণ ভেদ করে ফিক করে হেসে উঠলো। যেন আমাদের আগমনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল! আসার আগেই ভালো করে জেনে এসেছিলাম, লোভাছড়ায় খাবারের জন্য ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই কানাইঘাট বাজারেই সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। নাস্তার যখন শেষ সময়; তখন বাজে সকাল সাড়ে ১০টা।

নাস্তা শেষ করে একটি সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে ছুটে চললাম লোভাছড়ার গন্তব্যে। গাড়ি ছুটতে শুরু করলো, আর অল্প সময়েই মাহমুদ ড্রাইভারের সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলল। সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে শুনতে আমরা এগোতে থাকলাম। কিছুক্ষণ মেইন রোড ধরে চলার পর গাড়ি ঢুকে পড়লো এক অচেনা অজানা বাঁশসুন্দরীর পথে। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি বাঁশঝাড়। ঘন বাঁশের জঙ্গল ভেদ করে সূর্যের আলো ঝাড়বাতির ন্যায় রাস্তার উপরে এসে পড়ছিল। আধা ঘণ্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছালাম কাঙ্ক্ষিত লোভার মুখে! এখন আমাদের সামনে সুরমা নদী, একটু দূর থেকেই মেঘালয়ের উঁচু উঁচু পাহাড় লোভার স্বচ্ছ পানি হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

লোভারমুখ বাজার থেকে হালকা কিছু খাবার কিনে নিলাম। এখন আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর একমাত্র বাহন নৌকা। লোভারমুখ হচ্ছে সুরমা, লোভাছড়া এবং দেওছই নদীর সঙ্গমস্থল। এখান থেকেই তিনটি নদী তিন দিকে চলে গেছে। আমরা একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করলাম। সুরমা নদী পার হয়ে ছুটে চললাম লোভাছড়ার উদ্দেশ্যে। লোভার স্বচ্ছ পানিতে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছিল নৌকা, নদীর বুক একদম ফাঁকা। মাঝে মাঝে দু’একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা অথবা পাথরবাহী বড় বড় নৌকা ঢেউ খেলিয়ে চলে যাচ্ছে। ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের নৌকাও দুলতে থাকে, পানির ছিটা এসে গাঁয়ে পড়ে। সাথে লাইফ জ্যাকেট নেই, তবুও কোনো ডর-ভয় নেই। চোখের সামনের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে সব ডর-ভয় ভুলে গেছি। একটু অদূরেই সারি সারি ছোট-বড় পাহাড়, মনে হচ্ছিল যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবো। সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মাঝি হঠাৎ নৌকা একটি সরু খালের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। প্রথমে কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও একটু পর লোভাছড়ার সমস্ত সৌন্দর্য আমাদের একদম কাছে চলে আসে। খালের একপাশে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, মাঠে ঘাস খাচ্ছে কয়েকটি গাভি, অন্যপাশে চোখ ধাঁধানো সব উঁচু উঁচু পাহাড়! এ যেন কোনো স্বপ্নপূরীতে আমরা ছুটে চলেছি।

in1

কিছুক্ষণ পর নৌকা গিয়ে থামলো প্রায় শতবর্ষী পুরোনো লাল রঙের ঝুলন্ত ব্রীজের কাছে। ১৯২৫ সালে করা ব্রিজটি দেশের প্রথম ঝুলন্ত ব্রীজ! ঝুলন্ত ব্রিজের একপাশে সারি সারি আকাশমণি গাছ, অন্যপাশে নয়নাভিরাম চা বাগান! আকাশমণি গাছের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলা পথে আমরা পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য স্থানীয় খাসিয়া পল্লি এবং এ পাহাড়ের মালিকের ছনের তৈরি অপরূপ সুন্দর বাংলো পরিদর্শন। পনেরো মিনিট হাঁটার পর আমরা পৌঁছে গেলাম খাসিয়া পল্লিতে। আমাদের দেখে তারা প্রথমে একটু আগ্রহভরে তাকালেও আবার নিজেদের কাজে মনযোগ দিলো। যেন তাদের কাছে এরকম অতিথিদের আগমন নতুন কিছু নয়। তাদের সাথে দেখা হলো কিন্তু কথা বলা গেল না। খাসিয়া পল্লি থেকে আরও মিনিট দশেক হেঁটে আমরা পৌঁছে যাই বাংলাদেশ সীমান্তের এ অঞ্চলের পাহাড়ের মালিক নানকার সেই বিখ্যাত বাংলোতে। জাতে ব্রিটিশ হওয়া সত্ত্বেও নানকা এদেশের নাগরিক হিসেবে এখানেই থেকে যান। মহান মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেন। বর্তমানে তিনি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান।

ছবির মতো সুন্দর এ বাংলো দেখা শেষে যখন বের হলাম; তখন গোধূলি বেলা। সূর্য ধীরে ধীরে আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে। পাখিরা দলবেঁধে তাদের নীড়ে ফিরছে। আমাদেরও নীড়ে ফিরে যেতে হবে। মেঘমুক্ত আকাশে উঁকি দিচ্ছে প্লেটের মতো গোলগাল চাঁদ। আমরা ভাঙা গলায় সুর তুলে গাইছি ‘মনে চায় এই নির্জন দেশে, থেকে যাই আমি কোকিল বেশে’। গান গাইতে গাইতে পুরোপুরি সন্ধ্যা নামার আগেই নৌকায় চড়ে আমাদের ব্যস্ত শহরের গন্তব্যে রওনা দিলাম।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।