রাজস্থানে আনন্দ ভ্রমণ : পর্ব ০৫
অরূপ কুমার ভট্টাচার্য
৬ অক্টোবর জয়পুর থেকে বিকেল সোয়া ৪টায় লেলন এক্সপ্রেসে আমরা যাত্রা করেছি জয়সালমিরের উদ্দেশে। নির্দিষ্ট সময়েই ভোর ৫টায় এসে পৌঁছলাম জয়সালমিরে। জায়গাটির নাম-যশ যত শুনেছিলাম, স্টেশনটি কিন্তু সে তুলনায় খুবই সাদামাটা। ট্রেন থেকে স্টেশনে নামতেই একাধিক অটোচালক আর দালাল মৌমাছির মত জেঁকে ধরল। আমি যতই বলছি, আমাদের হোটেল বুকিং আছে। তারা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না। শেষ পর্যন্ত একটু রাগান্বিত হয়ে উত্তর দেওয়ায় বুঝতে পারল, আমি মানুষটি সহজ-সরল বাঙালি পর্যটক নই। এবার তাদের কৌতূহল, কোন হোটেল? আমি বললাম, হোটেল আকাশদীপ। তখন তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে সব কজন বিদায় নিলো।
এবার তো খেলা জমল অটো বুক করতে গিয়ে। যে অটোওয়ালা জানছে, হোটেল আকাশদীপ যাব; সে-ই দেখি এড়িয়ে যায়। দু’জন তো বেশ ব্যঙ্গ করে বলল, ‘ও মুকেশজি কা হোটেল, বহুত বুড়া আদমি হ্যায়।’ শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। কারণ যার গাইডেন্সে জয়সালমিরের সব ব্যবস্থা করেছি; সেই শিউলি সেন দিদিকে আমিই হোটেল আকাশদীপের সন্ধান দিয়েছিলাম। এখন যদি অটোওয়ালার কথা ঠিক হয়, তাহলে সাধের জয়সালমির ভ্রমণটা মাটি হয়ে যাবে। সবটাই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে অটো ভাড়া করে চললাম হোটেল আকাশদীপে।
তখনো চারিদিক অন্ধকার, রাস্তার আলোয় এক আলো-আঁধারি পরিবেশ। কিছুটা যেতেই একটি চৌমাথার মোড়, এখান থেকেই স্বপ্নের সোনার কেল্লা প্রথম চাক্ষুস করলাম। সেই ছোটবেলা থেকে সত্যজিৎ রায়ের অনুগ্রহে সোনার কেল্লার সাথে পরিচয়। তাই নতুন করে আর অটোওয়ালাকে জিজ্ঞাসা না করেই ছেলেকে বলে উঠলাম, ‘বাবা, দেখ সোনার কেল্লা’। অটোওয়ালা মানুষটি বেশ ভালো। সে নিজেই বলল, এ হলো জয়সালমির ফোর্ট, কিন্তু আপনাদের সত্যজিৎ বাবু সবার কাছে এর পরিচয় দান করেছেন সোনার কেল্লা নামে। কথা বলতে বলতে আমরা পৌঁছে গেলাম হোটেল আকাশদীপের সামনে। স্টেশন থেকে আসতে সময় লাগলো খুব বেশি হলে ৫ মিনিট।
বাইরে থেকে দেখে সহজেই চিনতে পারলাম হোটেলটিকে। সবচেয়ে বড় কথা, এই রাজস্থানের সুদূর জয়সালমিরে হোটেল আকাশদীপ নামটা বড় বড় অক্ষরে বাংলায় লেখা আছে। বেশ তৃপ্তি অনুভব করলাম। জয়সালমির জায়গাটির সাথে বাঙালির এক আত্মিক বন্ধন আছে।
তখনো হোটেলের মূল দরজা বন্ধ। আমি বাইরে থেকে ডাকতেই একজন যুবক এসে দরজা খুলে দিলো। পরিচয় দিয়ে হোটেলের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখি হোটেলের সব স্টাফ ভোরের সুখনিদ্রায় আচ্ছন্ন। নিজেকে একটু খারাপ লাগলো। আমার জন্য মানুষগুলোর ভোরের ঘুমটা ভেঙে গেল। যাক, এসব আর ভেবে লাভ নেই। আমরা হোটেলের নির্দিষ্ট চেক ইন টাইমের অনেক আগে পৌঁছে গেছি। কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাদের একটা ফোর বেডের বড় রুমে থাকার ব্যবস্থা করেছেন শিউলি দি। সেই মতো আমাদের সব ব্যাগপত্র একটি বড় ঘরেই রাখলাম।
আমার মাথায় তখন হোটেল সম্পর্কে অটোওয়ালাদের খারাপ মন্তব্যগুলো ঘুরপাক করছে। তাই হোটেলের ভেতর দিকটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম। কিন্তু কোন কিছুতেই খারাপের ছাপ দেখতে পেলাম না। অত ভোরেও দেখলাম হোটেলের স্টাফদের ব্যবহার খুব ভালো। একজন ভদ্রলোক এসে বলে গেলেন, ‘স্যার সকাল নয়টা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করুন, তারপর বাকি দুটি রুম দিয়ে দেব।’ আসলে হোটেলের চেক ইন টাইম সকাল ১০টা। ইতোমধ্যে আমাদের টিমের একে একে সবাই হাতমুখ ধুয়ে স্নান সেরে নিলাম।
হোটেলের রেস্টুরেন্টটা রুফটপে। দিনের আলো ফুটতেই ছাদে গিয়ে দেখি খুব সুন্দর ছিমছাম রেস্টুরেন্ট। আরও বিস্ময় হচ্ছে- রেস্টুরেন্টের সব স্টাফ বাঙালি। একজন তো পরিচয় করার আগেই বলল, ‘ওই দেখুন সোনার কেল্লা দেখা যাচ্ছে।’ সকালের আলোয় সোনার কেল্লা দেখলাম, চোখ জুড়িয়ে গেল। সত্যিই নামকরণ সার্থক- সোনার কেল্লা। মনে মনে সত্যজিৎ রায়ের অপার জ্ঞানসমুদ্রের কাছে আরও একবার মাথা নত করলাম। ইতোমধ্যে হোটেলের মালিক মুকেশ ভাটিয়া চলে এসেছেন। প্রথম পরিচয়েই আমাকে অরূপজি সম্বোধন করে এমনভাবে আলিঙ্গন করলেন, যেন মনে হলো কতদিনের পরিচিত এক বন্ধুর সাথে অনেক বছর পর দেখা হলো আজ। তিনি এসেই সকাল ৯টার মধ্যে আমাদের পৃথক তিনটি রুম দিয়ে দিলেন।
হোটেলের রেস্টুরেন্টে গরম গরম লুচি, ফুলকপি আর আলুর তরকারি সহযোগে দারুণ জলখাবার খেয়ে সবাই প্রস্তুত। জয়সালমির, ওঁ শিয়া আর যোধপুর ভ্রমণের জন্য আমি একটি ১২ সিটের এসি টেম্পু ট্রাভেলা বুক করেছিলাম। গাড়ির ড্রাইভারের সাথে কথা ছিল, ভোরে আমাদের স্টেশন থেকে পিকআপ করবে। কিন্তু নানা অজুহাত দেখিয়ে সে বলে দিলো, আপনারা অটো করে হোটেলে চলে আসুন। আমি ৮টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যাব।
এবার শুরু হলো তার আরেক গল্প। আমার কথামত সকাল ৯টায় টেম্পু ট্রাভেলার হোটেলের সামনে আনলেও সে বলতে শুরু করল, ‘আপনারা আজ সকালটা অটো করে ফোর্ট আর দুটো হাভেলি ঘুরুন। কারণ জায়গাগুলোতে অলিগলি আছে, বড় গাড়ি ঢুকবে না। শুরু হলো বাদানুবাদ পর্ব। আমার স্পষ্ট কথা, এতগুলো টাকা অটো করে ঘোরার জন্য আপনাকে দেইনি। আপনার বড় গাড়ি যতদূর যাবে আমরা ততদূর যাব। বাকিটা আমাদের ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত আমাদের দাবি মেনে টেম্পু ট্রাভেলা করেই সোনার কেল্লার সামনে পৌঁছলাম। সোনার কেল্লা থেকেই শুরু হলো আমাদের জয়সালমির ভ্রমণ।
চলবে...
লেখক: সহকারী শিক্ষক, বিবেকানন্দ মিশন আশ্রম শিক্ষায়তন, হলদিয়া, কলকাতা।
এসইউ/পিআর