ইস্তানবুলের আয়া-সোফিয়া ও ব্লু মস্ক

আলী আহসান
আলী আহসান আলী আহসান
প্রকাশিত: ০১:০৩ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০১৯

ইস্তানবুলের ইতিহাস অনেক পুরোনো এবং মুসলিমদের জন্য এখানে অনেক রকমের ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান আছে। মুসলিম সভ্যতা বিকাশের অনেক আগে এখানে ছিল ক্রিশ্চিয়ান ধর্ম বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সভ্যতা। বসফরাস প্রণালি ইউরোপ আর এশিয়ার সীমানা হয়ে ইস্তানবুলকে ভাগ করে রেখেছে। আমাদের হোটেলটা ইউরোপিয়ান কোয়ার্টারে পড়েছে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ যেসব হোটেল দেখাচ্ছিল তার মধ্যে এদিকের হোটেল পছন্দ করেছিলাম ইউরোপিয়ান ধাঁচের কারণে। হোটেলগুলো মূলত তিন রকম ধাঁচে হয় এখানে- বাইজান্টাইন এবং সুলতানি ধাঁচ কিংবা বলা যায় টার্কিশ ধাঁচ, ইউরোপিয়ানদের ধাঁচ আর এশিয়ান ধাঁচ। মারমারা সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে আনাতোলিয়ার যে অংশ সেটাই মূলত এশিয়ান কোয়ার্টার নামে পরিচিত। মূল কনস্টান্টিনোপল বা ইস্তানবুলের জনবহুল মূল শহর থেকে এশিয়ান কোয়ার্টার অনেক দূরে। বসফরাস প্রণালির পূর্বাঞ্চলের পুরোটাই ইউরোপিয়ান কোয়ার্টার নামে পরিচিত। এরপর বসফরাস প্রণালি পার হলেই ধীরে ধীরে সুলতানি ধাঁচের সবকিছু দেখা যায়। তোপকাপি প্যালেস ছিল এরকম একটি নিদর্শন।

Sofia

গতকালের পর আজকের দর্শনীয় স্থানের লিস্টে ছিল আয়া-সোফিয়া আর ব্লু মস্ক। তারপর বাইজান্টাইন আমলে তৈরি শহরের দেয়াল আর গোল্ডেন গেট। ট্যাক্সিতে হোটেল থেকে আয়া-সোফিয়া মিনিট বিশেকের কিছু বেশি সময় নেয়। মানুষের স্বভাব আপনজনের কাছাকাছি থাকা, পরিচিতদের মাঝেই সে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। গতকাল ব্যাসিলিকা সিস্টার্ন হয়ে অন্যান্য সবকিছু দেখানোর কারণেই সম্ভবত আবার এই ব্যাসিলিকা সিস্টার্ন এসে হাজির হলাম। মনে হচ্ছিল জায়গাটা আমার খুব আপন। এখান থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ আয়া-সোফিয়া।

বাইজান্টাইন সম্রাট কনস্টান্টানিয়াস ৩৬০ সালে প্রথম আয়া-সোফিয়া বানান। তুর্কি ভাষায় এভাবেই বলা হয়, ইংরেজিতে ‘হাজিয়া সোফিয়া’ যার অর্থ পবিত্র জ্ঞান। যা প্রথমে কাঠের একটি কাঠামো হিসেবে বানানো হয়েছিল। আয়াসোফিয়া মূলত গ্রিক শব্দ। সম্রাটের পরিবারের মধ্যে যে দাঙ্গা হয়েছিল তার কারণে মাত্র চল্লিশ বছর যেতে না যেতেই চার্চটা আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়। সেসময় বাইজান্টাইন সম্রাট ছিলেন আর্কাডিওস। তার উত্তরসূরি সম্রাট থিওডোসিওস এখানে দ্বিতীয় হাজিয়া সোফিয়া নির্মাণ করেন। আবারও প্রায় শতাধিক বছর পরে এটাও পুড়ে ধ্বংস হয়।

Sofia

এরপর ৫৩২ সালে শুরু হয়ে মাত্র পাঁচ বছর আজকের এই বিশাল আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকাসম হাজিয়া সোফিয়া বানান সেই সময়ের সম্রাট জাস্টিনিয়ান। আর্কিটেক্ট ইসিডোরোস এবং এনথেমিওস এটা বানান। ২৭ ডিসেম্বর ৫৩৭ সালে প্রার্থনার জন্য এই চার্চ খুলে দেওয়া হয়। সম্রাট এই চার্চে প্রার্থনা করেন, ‘আমার প্রভু! আমাকে এ প্রার্থনালয় বানানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি আপনার দরবারে শুকরিয়া জানাই।’ চার্চের গম্বুজ এতো বিশাল যে কল্পনারও বাইরে। শুধু এর সৌন্দর্যের বিবরণ লিখতে গেলে গোটা একটি বই লেখা হয়ে যাবে। এরমধ্যে একটি পানির কলসের মতো আছে। যা একটা বড় মার্বেল পাথর থেকে বানানো। আকারে মানুষ সমান উঁচু আর তিন-চার জন মানুষের সমান বেড়। বাইজান্টাইনরা ছিল গ্রিক গোড়া ধর্ম বিশ্বাসের অনুসারী। তাই চার্চটা হয়ে উঠলো সকল রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের, প্রার্থনার কেন্দ্র।

বাইজান্টাইন শাসনের পতনের পর খুব অল্প সময়ের জন্য রোমানদের দখলে থাকলেও শেষ পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের পর এটি সুলতানি ক্ষমতার আওতায় চলে আসে। যেহেতু সেসময় ইসলাম ছিল তাদের ধর্ম, তারা এই হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করে। কাঁচের অসংখ্য টুকরাকে সোনা দিয়ে মুড়ে এই চার্চের দেয়ালের, ছাদের, গম্বুজের চতুর্দিকের আবরণ দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ছিল যিশুখ্রিষ্ট ও মা মেরির ছবি। এসবকে সরিয়ে সেখানে কোরআনের সুরা এবং আল্লাহর নাম বসিয়ে দেওয়া হয়। মূল কাঠামোর কোন ক্ষতি না করে এবং অন্যান্য আর কোন কিছু পরিবর্তন না করেই হাজিয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

Sofia

এটি নিয়ে তেমন কোন দাঙ্গা হয়নি। এমনকি যিশুখ্রিষ্টের ধর্মানুসারীদের মধ্যেও তেমন কোন ক্ষোভ দেখা যায়নি। যেহেতু এটা চার্চ ছিল, তাই কিবলা নির্ণয় করা খুব ঝামেলা হতো। তাছাড়া পারস্যের সাথে যুদ্ধের পর অটোমানরা স্থাপত্য শিল্পে তাদের শক্তি দেখানোর জন্যও বেশ উদগ্রীব ছিল। এসব কারণে পরে এটিকে মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং এর পাশেই ব্লু মস্ক বানানো হয়। যেখানে নিয়মিত নামাজ আদায় করা হয়। সেটাও প্রায় চারশ বছর আগের কথা। আজ সেখানেই আমরা নামাজ পড়েছি। এখানে যারা আসেন; তাদের মধ্যে যারা নামাজ পড়েন না কিন্তু ভেতরে দেখতে চান, তারাও ভেতরে যেতে পারেন। হাতে রং করা নীল টাইলস ব্যবহার করার কারণে এ মসজিদের এমন নাম হয়। এর কারুকাজ, গঠন অনেক সুন্দর এবং বিশাল।

নামাজ শেষে পাশের পার্কে কিছু সময় কাটানোর পর আমরা যাই ওয়াল অব কনস্টান্টিনোপল দেখতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এ দেয়াল আর গেটের খুব বেশি কিছু অবশিষ্ট নেই। তবুও সময়মতো পৌঁছাতে পারলে হয়তো দেখা যেতো। সেখানে বিকেল পাঁচটায় পৌঁছাই আমরা, ততক্ষণে গেটের তোরণ বন্ধ হয়ে গেছে। কনস্টান্টিনোপলকে বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য কনস্টানটাইন সম্রাট এ দেয়াল এবং গেট বানান। ইস্তানবুলের চতুর্দিকে অনেক উঁচু করে বানানো এ দেয়াল। এখনো বসফরাস প্রণালির পাশ দিয়ে ছুটে চলা হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় বিশাল উঁচু এ দেয়াল নজরে আসে। কিছু কিছু অংশ ভেঙে গেছে এবং সেসব জায়গায় জনপ্রিয় কিছু খাবারের রেস্টুরেন্ট বানিয়ে দেদারসে চলছে ব্যবসা।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।