প্রাচীন সভ্যতাকে ছুঁতে ঘুরে আসুন ইস্তানবুল

আলী আহসান
আলী আহসান আলী আহসান
প্রকাশিত: ০৫:২৫ পিএম, ০৭ নভেম্বর ২০১৯

প্রাচীন ইতিহাস আমাকে চুম্বকের মতো টানে, কেন সেটা জানি না। শুধু জানি খুব টানে। শুধু ইতিহাস নয়, বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম, মানব সভ্যতা এবং সংস্কৃতির উপর ধর্মের প্রভাব ইত্যাদির উপরও আমার এই টান অনেক বেশি। পৃথিবীর সব দেশ ঘুরে দেখা হয়তো সম্ভব নয়, তবু যতটুকু ইতিহাসকে, প্রাচীন সভ্যতাকে ছুঁয়ে দেখা যায়। এই ছুঁয়ে দেখার অভিপ্রায়েই তুর্কির সাবেক রাজধানী ইস্তানবুলে আসা। নেপোলিয়ন বলেছিলেন যে, এই পৃথিবী যদি একটি রাজ্য হতো তাহলে তার রাজধানী হতো ইস্তানবুল।

ইস্তানবুল অনেক বড় একটা শহর। এর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। প্রথমে বাইজান্টাইন, তারপর গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। এরপর রোমানরা এখানে রাজত্ব করে। এর প্রথম নাম ছিল বাইজান্টিয়াম, তারপর রোমান সম্রাট কনস্টানটিন দ্য গ্রেট রোমান সম্রাজ্যের রাজধানী বানান এটাকে এবং নাম রাখেন কনস্টান্টিনোপল। এই কনস্টান্টিনোপল মানব সভ্যতার ইতিহাসে বেশ জনপ্রিয় একটা নাম। এরপর অনেক রক্তপাত, রায়ট ইত্যাদির মাধ্যমে আরবরা, বার্বারিয়ানরা, একসময় এলো অটোম্যানরা। এরপর বহু বছর এখানে অটোম্যান সুলতানদের মাধ্যমে ইসলামের প্রচার আর বিস্তার হয়। এভাবেই তুর্কি ভাষা islambol (City of Islam) এবং গ্রিক ভাষা eis tin polin (to the city) এর সমন্বয়ে এ শহরের নাম হলো ইস্তানবুল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অটোম্যানদের দৌরাত্ম ছিল। এরপর এলো আতাতুর্ক।

হোটেল থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা শহরের উদ্দেশে রওনা দিয়ে আমরা Bosporus (ব্ল্যাক সী আর সী অব মারমারের মধ্যের জলপথ) এর পাশ দিয়ে এসে হাজির হলাম ট্যুরিস্ট গিজগিজে একটা জায়গায়। সামনে ট্যাক্সি এগোতে পারবে না, সুতরাং হেঁটে বাকি পথ আসতেই সামনে পড়ল Basilica Cistern। যদিও আমাদের লিস্টে প্রথমেই ছিল Topkapi Palace (অটোম্যান সুলতানের রাজপ্রাসাদ, যা এখন মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা হয়)।

istanbul-1

লম্বা লাইন দেখে প্রথমে ইতস্তত করলেও আল্লাহর নাম নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। কী আছে জীবনে? এতো দূর আসতে পারলাম আর এখানে ঢুকতে পারবো না? অবিশ্বাস্য হলেও কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা সেই basicila cistern এর মধ্যে প্রবেশ করতে পারলাম। বাইজান্টাইন সম্রাট একটা গির্জা বানিয়েছিলেন এখানে। এরপর বিভিন্ন পরিবর্তন, মেরামত, ইত্যাদির মাধ্যমে মাটির নিচে এক ধরনের জলাশয় হিসেবে বানানো হয়েছিল এই গির্জাকে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে একেবারে মাটির নিচে এতো বিশাল এক গির্জা কল্পনাও করা যায় না, বিশেষ করে প্রাচীন আমলে। মোট ৩৩৬টা লম্বা মার্বেল পিলারের উপর দাঁড়িয়ে মাটির নিচের এই Cistern এর মাপ প্রায় সাড়ে চারশ ফিট বাই সোয়া দুইশ ফিট (প্রায় এক লাখ স্কয়ার ফিট এলাকা)।

আমরা গ্রিক মিথোলজি অনেকেই পড়েছি। মেডিউসার ইতিহাসও অনেকে জানি। মেডিউসার মাথাভর্তি চুলের পরিবর্তে ছিল শাপ আর তার দিকে তাকালেই যে কেউ জমে পাথর হয়ে যাবে। প্রাচীন আমলে এই মিথ এতোই মানুষ বিশ্বাস করতো যে এই গির্জার দুটো পিলারের নিচের সাপোর্ট হিসেবে মেডিউসার মাথাকে উল্টো করে বসানো হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল গির্জাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা। দুষ্টচক্রের কেউ এসে মেডিউসার দিকে তাকালেই তারা জমে পাথর হয়ে যাবে। এটা এক ধরনের প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাস বলা যায়। এখানে ক্যামেরায় অনেকেই ছবি তুলেছে, আমরাও কিছু তুলেছি কিন্তু অন্ধকারে সেই ছবি দেখলে যে কেউ জমে যেতে পারে (যেভাবে মেডিউসাকে দেখে জমে যেত মানুষ প্রাচীন আমলে- গ্রিক মিথ অনুযায়ী)। আর সভ্যতার এই দুর্দান্ত নিদর্শন সত্যিকার অর্থে কোন ক্যামেরাতেই ধরা সম্ভব নয়। কিছু ভিডিও করেছি যা এডিট করে পরে কখনো বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবো ইনশাআল্লাহ। এখান থেকে বেরিয়ে সোজা হাজির হলাম খুব কাছের Topkapi Palace এ।

Topkapi Palace ১৫ শতকের সময় অটোম্যান সুলতানদের মূল বাসস্থান এবং প্রশাসনিক ভবন ছিল এটা। এটা এতো বিশাল যে হেঁটে হেঁটে পুরোটা ঘুরে দেখার অভিপ্রায় এক ধরনের বিলাসিতা, অন্তত যারা হাঁটতে খুব একটা পছন্দ করেন না। আমি নিজে বাদে পরিবারের বাকিরা হাঁটায় ব্যাপক ওস্তাদ শ্রেণির। প্রথমে ভুজুং ভাজুং দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলাম সুলতান মিয়া কী কী খাইছে, কীভাবে খাইছে, কেন খাইছে, খেয়ে দেয়ে এরপর কোথায় গড়াগড়ি করছে, এইসব ছাড়া এখানে আর তেমন কিছুই নাই। তাই শুধু শুধু কষ্ট করে এসব না দেখে বাইরে থেকে কিছু সুন্দর ছবি তুলে আমরা পাশের আরও ইন্টারেস্টিং কিছু দেখতে পারি। কিন্তু ভুজুং ভাজুং পকেটে ভরে আমাকে হাঁটতে বাধ্য হতে হলো।

প্রথমে ধারণাই সঠিক মনে হচ্ছিল। কারণ এই প্যালেসের প্রথম বিল্ডিংয়ের পুরোটা জুড়েই সুলতানের রান্না ঘর, খাবার ঘর, ডেজার্ট খাবার ঘর, কফি পানের ঘর ইত্যাদি। কিন্তু সেখানে রাখা আছে শুধু সুলতান নয়, এর আগে রোমানদের সময়ে যেসব তৈজসপত্র ব্যবহৃত হতো সেসবও। এরপর যে শুরু হলো ইতিহাসের কলিজা নিয়ে টানাটানি তার তুলনা নেই। তবে কলিজা টানাটানির আগে প্যালেসের পাহাড়ি কোলে মনোরম এক রেস্টুরেন্টে বসে Bosporous এর নীল রঙের পানি দেখলাম। নীল রঙের পেছনে ঝকঝকে নীল আকাশ আর আরও পেছনে Prince Island এর মাথা। আমাদের ভ্রমণের একটা দিন রেখেছি এই দ্বীপ দেখার জন্য।

istanbul-3

মন ও শরীরের যথেষ্ঠ দেখাশোনার পর শুরু হলো জীবনের সবচেয়ে দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। প্যালেসের একটা অংশে সবচেয়ে লম্বা লাইন দেখে সেটা এড়িয়ে আমরা ঘুরছিলাম যেখানে সুলতান তার বন্ধু, আত্মীয়, মন্ত্রী এদের নিয়ে আড্ডা মারতেন, গল্প করতেন তাদের স্ত্রীরা, কন্যারা। এরপর বিশাল একটা রাজকীয় ঘরের সামনে ট্যুরিস্টদের হাসাহাসি দেখে এগিয়ে গিয়ে জানতে পারলাম, ওটা ছিল সুলতানি আমলের খতনা কামরা। অনেকেই সেখানে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ছবি নিচ্ছিল। এসব পেরিয়ে আমরাও লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে একসময় প্রবেশ করলাম এমন একটা অংশে, যেখানে কলিজা টান লাগবেই। দাউদ (আ.) এর তলোয়ার, মুসা (আ.) এর লাঠি, ইয়াহিয়া (আ.) এর তলোয়ার আর হাতের একটা অংশ, হযরত মোহাম্মদ (স.) এর পায়ের ছাপ, দাঁড়ি, দাঁত, তার কন্যা বিবি ফাতেমার জোব্বা, আলী (রা.), আবু বকর (রা.) এবং আরও অনেক সাহাবার তলোয়ার, এমন আরও অনেক কিছু এখানে ডিসপ্লেতে রাখা হয়েছে। আমাদের কল্পনারও অতীত ছিল যে, এসব দেখার সৌভাগ্য হবে। পুরো Topkapi Palace এর বিভিন্ন অট্টালিকা ভবন এখন মিউজিয়াম। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ থাকায় কোন ছবি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। এতক্ষণ এসব প্রাচীন নিদর্শন দেখতে দেখতে পায়ের ব্যথার কথা মনেই ছিল না। যদিও কিছুদূর পরপরই বসার ব্যবস্থা ছিল এবং যথারীতি সেখানে আমাকে নিয়মিত দেখা গেছে।

topkapi palace থেকে বের হয়ে যখন পায়ের ব্যথা উপশমের জন্য বেশ আরাম করে প্যালেসের ভেতরের সুদৃশ্য পার্কের বেঞ্চে বসলাম; তখন দুজন বাঙালির সাথে পরিচয় হলো। তারা আমাদের বিপরীত দিকের বেঞ্চে বসে পায়ের আরাম করছিলেন। ছেলে-মেয়েদের বাংলা শুনে তারা লাবিবকে ডাকলেন কথা বলার জন্য। মনে হলো দুজনেই ভীষণ অবাক হয়েছেন ওদের বাংলা শুনে। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না দেশের বাইরে জন্ম এবং বড় হওয়া বাচ্চারা কীভাবে এতো সুন্দর বাংলা বলে। তারা আমাদের সাথে একটা সেলফিও নিলেন। দুজনেই সরকারি এক সেমিনারে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন। যাবার আগে এই প্যালেস প্রদর্শন করতে এসেছেন। বিদায় নিয়ে হাজির হলাম পাশের ইস্তানবুল প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে।

ইস্তানবুল প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর- এখানে এসে আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০০ সালের থেকে শুরু অতি প্রাচীন আমলে মানুষ কীভাবে কবর দিতো, কীভাবে বাক্সের মধ্যে মৃত স্বামীর ক্রন্দনরত স্ত্রীকে বসিয়ে বাক্স বন্ধ করে রাখতো এসব দেখলাম। এসবের পাশাপাশি মিশরীয় কিছু রাজার মমি, নমরুদের সময়ের কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা প্রথম শান্তি চুক্তি, বিভিন্ন কমার্স ডকুমেন্ট, মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস, মন্দির বানানোর নকশা- এসব রাখা আছে। সবই cuniform অর্থাৎ বিভিন্ন ট্যাবলেটে, মাটির পাত্রে, পৃথিবীর প্রথম লেখা প্যাপিরাসের পাতায়। মানব সভ্যতার শুরু থেকে এরপর জানা যতো সভ্যতা আমরা পড়েছি, তার প্রতিটির নমুনা সেখানে রাখা আছে বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের মধ্যে। প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, মেসোপটেপিয়া, আক্কাডিয়ান, ব্যাবিলনিয়ান হেন কোন সভ্যতা নেই, যার একটা নিদর্শন এখানে নেই।

ইস্তানবুলে সুলতানি কায়দায় আরামদায়ক তাকিয়ায় বসে খাওয়ার জন্য বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট আছে। এসব রেস্টুরেন্টে তুর্কি খাবার। এদের খাবার অত্যন্ত লোভনীয় এবং মজাদার। বিভিন্ন কাবাবের দোকান থেকে ভেসে আসে ধোঁয়া ওঠা কাবাবের গন্ধ। দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরে এমনই এক সুলতানি রেস্টুরেন্টে সুলতানি কায়দায় বসে বেশ আয়েশ করে খেলাম নানান মজার খাবার। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা যে, এমন একটা সুন্দর দিন গেল, পৃথিবীর ইতিহাসের অনেক অনেক দুর্লভ নিদর্শন দেখার সৌভাগ্য হলো। আপনারা যদি ইস্তানবুলে আসেন, চেষ্টা করবেন অবশ্যই এই জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে। চোখ আর মনের ক্যামেরায় বন্দি করে নিতে পারবেন এই দুর্লভ অভিজ্ঞতাগুলো।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।