এই শীতে নীল জলের দেশে
সমুদ্র বরাবরের মতই সবার প্রিয়। উত্তাল গর্জন আর শীতল বাতাস সবার হৃদয়ই শিহরিত করে। নিজের ভেতরে অন্যরকম রোমাঞ্চ তৈরি হয়। পাহাড়, সমুদ্র আর নীল আকাশের অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় সেখানে। সেন্টমার্টিন ঘুরে এসে বিস্তারিত জানাচ্ছেন হুসাইন আরমান-
চতুর্থবারের মত সুযোগ করে দিলো ফেনী সরকারি কলেজ প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। এবার নিজের ভেতরে উন্মাদনাটা অনেক বেশি কাজ করছিলো। কারণ প্রথমবারের মত সেন্টমার্টিন যাব। তিনদিনের সফরে সেন্টমার্টিন, ছেড়াদ্বীপ, কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান নির্ধারণ করা হয়। আগে কখনো সেন্টমার্টিন যাইনি। তাই এর সৌন্দর্য সম্পর্কে অতটা জানতাম না।
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রাত বারোটায় কলেজ প্রাঙ্গন থেকে বাস ছাড়ে। বাসের মধ্যে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। সকাল ৬টায় কক্সবাজার শহরে পৌঁছাই আমরা। কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে গাড়ি ছুটছে আপন গতিতে। একটু পর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্টে গাড়ি থামিয়ে চেক করছে। এর জন্য সামান্য বিরক্ত লাগলেও রাস্তার দু’পাশের দৃশ্য বিরক্তিটা নিমিষেই দূর করে দিচ্ছে।
একপাশে নীল সমুদ্র আর অন্যপাশে সবুজের সমারোহ। সমুদ্র আর পাহাড়ের মাঝে বাস ছুটে চলছে। কখনো উঠে যাচ্ছি পাহাড়ের গায়ে আবার নেমে আসছি সমতলে। সূর্যের মৃদু আলো বাসের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যেন আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। পথের দৃশ্য দেখতে দেখতে টেকনাফ জাহাজ ঘাটে পৌঁছাই সকাল সাড়ে ৭টায়। বাস থেকে নেমে স্থানীয় একটি হোটেলে সকালের নাস্তা পর্বটা সেরে নেই।
> আরও পড়ুন- বান্দরবানের কোথায় কী দেখবেন
সাড়ে ৯টায় জাহাজ ছাড়বে। তাই ৩০ মিনিট আগেই আমরা জাহাজে উঠে যাই। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে প্রতিদিন যে কয়টি জাহাজ ছাড়ে, সবগুলো একই সময়ে ছাড়ে আবার বিকেল সাড়ে ৩টায় ফিরে আসে। জাহাজে আমাদের আসন ছিলো একদম উপরের তলায়। সবচেয়ে মজার বিষয়- এই তলা পুরোটা খোলা ছিলো। অর্থাৎ জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখতে হবে না, সরাসরি দেখা যাবে। জাহাজের সামনে-পেছনে, ডান-বাম উভয় পাশ থেকে সবকিছু সুন্দরভাবে দেখা যাচ্ছিলো।
যথাসময়ে ভো-ভো আওয়াজ করে নাফ নদীতে জাহাজ চলতে শুরু করলো। নাফ নদীর বুককে দ্বিখণ্ডিত করে জাহাজ তার গন্তব্যের দিকে ছুটে চললো। এই নদী বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তকে আলাদা করেছে। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা সীমান্ত আর কাঁটাতারের বেড়া জানান দিচ্ছিলো, আমরা মিয়ানমারের প্রতিনিধি। সবুজের মাঝে কিছুদূর পর পর ওয়াচ টাওয়ারগুলো স্বগর্বে দাঁড়িয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলো। নাফ নদীর দু’পাশের অবারিত মনকাড়া, অপরূপ সবুজের দৃশ্য দেখলে বোবা মানুষও হয়তো চিৎকার দেবে।
সৌন্দর্যের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয় জাহাজের পেছনে ছুটে চলা গাঙচিলগুলো। গাঙচিল জাহাজের দু’পাশে উড়তে থাকে। মনে হচ্ছে যেন, তারা পর্যটকদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। গাঙচিলের ঝাঁক দেখে সবাই তখন সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তাদের ধরার চেষ্টা করে। পর্যটকরা তাদের চিপস ছুড়ে মারে। ওরাও জন্টি রোডসের মত মুখ দিয়ে ক্যাচ ধরার চেষ্টা করে। কেউ ধরতে পারে কেউ পারে না। চিপস খাওয়ার জন্য নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়ে যায়। ছুড়ে মারা চিপস পানিতে পড়ে গেলে পানি থেকে সাথে সাথে তুলে নেয়।
নাফ নদী পেরিয়ে জাহাজ যখন সমুদ্রের মোহনায় প্রবেশ করে; তখন মনে হয় যেন আমরা কোন নীল রঙের খনিতে প্রবেশ করি। কাঁচের মত স্বচ্ছ নীল পানিতে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে- নারিকেল আর ঝাউ গাছের সারি বেষ্টিত নীলের মাঝে একখণ্ড সবুজ। আমাদের হুমায়ূন আহমেদের সেই ‘দারুচিনি দ্বীপ’।
> আরও পড়ুন- কলকাতায় ঘুরতে কোথায় কেমন খরচ
আড়াই ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে জাহাজ এসে ভিড়ল সেন্টমার্টিনের জেটিতে। জাহাজ থেকে নেমে যেন নীলের দুনিয়ায় হারিয়ে গেছি। প্রথম দর্শনেই মনটা ভরে গেল। আকাশ ও সমুদ্রের পানি অনেক নীল দেখাচ্ছিল। চোখ সরাতে ইচ্ছে করছিল না। মনে মনে ভাবছিলাম, এখানে না এলে কী মিসই না হয়ে যেতো!
একপাশে ব্যাগ রেখে সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। আমিও কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। এবার সবাই মিলে হাঁটা দিলাম রিসোর্টের দিকে। একটু হাঁটতেই সামনের বাজারে ভ্যান পেয়ে চলে গেলাম রিসোর্টে। সেন্টমার্টিনের মাটিতে পা দিয়ে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে- যা বলে বোঝানো যাবে না।
রিসোর্টে ঢোকার রাস্তা দেখে ভাবছিলাম, মনে হয় খুব খারাপ হবে রিসোর্ট। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে অবাক! অসাধারণ সুন্দর নিরিবিলি একটি রিসোর্ট। নারিকেল গাছে ঘেরা রিসোর্ট। আমাদের রুমটা ছিল বিচের একদম কাছে। শুয়ে শুয়েই সমুদ্র দেখা আর গর্জন উপভোগ করা যায়। আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে সোজা বিচে চলে গেলাম। বিচে ফুটবল খেলে ঝাঁপ দিলাম নীল জলরাশিতে। আনমনে গেয়ে উঠলাম, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’।
আমিসহ আমাদের তিন স্যার মিলে সমুদ্রে জলকেলি শুরু করলাম। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে জানান দিচ্ছি- নীল সাগর আমরা এসেছি তোমার কোলে। সমুদ্রের ঢেউগুলো বেশি বড় নয়। ঢেউয়ের সাথে খেলার ফাকে মাছ নিয়ে একটি ট্রলার তীরে এলো। তরতাজা মাছগুলো দেখে চোখ জুড়িযে গেলো। জেলেদেরে থেকে নাম জিজ্ঞাসা করে মাছগুলোর সাথে পরিচয় পর্বটা সেরে নিলাম। সহকারী অধ্যাপক মোতাহার হোসেন স্যারের একটি মাছ পছন্দ হয়ে গেলো। বিভাগের আরেকজন সহকারী অধ্যাপক শাহআলম স্যার দরদাম করে ২০০ টাকায় মাছটি কিনে নিলেন। মাছের নাম তিল্লি মাছ। রাতে স্যারদের জন্য ভুনা করা হয়েছিলো।
> আরও পড়ুন- প্রবাসীরা ব্যাগে যা কিছু আনতে পারবেন
সমুদ্র পর্ব শেষ করে গোসল করে খেতে বসলাম। কী খেয়েছি সেটি বড় কথা নয়, কোন পরিবেশে খেয়েছি সেটাই মনে থাকবে আজীবন। খাচ্ছি আর সমুদ্র দেখছি। খাবার ঘর থেকে সমুদ্রের দূরত্ব ৫০ হাত হবে। সমুদ্রের শীতল হাওয়ায় প্রাণটা জুড়িয়ে যাচ্ছে।
একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেল বেলা বের হলাম দ্বীপ ঘুরে দেখতে। কেয়াপাতার সারি দেখতে দেখতে চলে গেলাম হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি ‘সমুদ্র বিলাসে’। ভেতরে ঢুকে দেখি ছোট ছোট কয়েকটি ঘর। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের নামে ঘরগুলোর নাম। দরজায় নেমপ্লেটে লাগানো আছে। একটি ঘর পর্যটকরা ভাড়া নিয়েছে। বাকিগুলো সংস্কারের কাজ চলছে। কটেজ থেকে বের হয়ে সামনে চোখে পড়লো ডাব। খেয়ে দেখলাম সেন্টমার্টিনের ডাবের পানি অনেক মিষ্টি। ইতোমধ্যে সূর্য ডোবার সময় হয়ে এলো। সবাই অসাধারণ মুহূর্তটাকে ক্যামেরায় ধারন করছিলো। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে ঢেউয়ের আকার বড় হতে লাগলো। গর্জন ও বেশ জোরে শোনা যাচ্ছিলো।
রিসোর্টের দোলনায় দোল খাচ্ছি আর হালকা ঠান্ডা বাতাসের সাথে সমুদ্রের গান উপভোগ করছি। ভাবনার ছেদ পড়লো সহপাঠীর ডাকে, সবাই মিলে বিচে হাঁটতে গেলাম। সমুদের গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। রাতের আকাশে ছিল অনেক তারা। সেদিন তারাদের বড় কোন সমাবেশ ছিলো। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে নির্জন পরিবেশে আকাশে তারা দেখা আমার জীবনের ভয়ংকর সুন্দর অনুভূতি।
বিচ থেকে গিয়ে বসলো গানের আসর। সবাই গোল হয়ে বসলো। অন্যদিনের মত গান ধরলাম আমি। আমার সাথে সুর মেলালো সবাই। হাতের তাল, সমুদ্রের গর্জন আর গলার সুরে অন্যরকম মেলডি। একপাশে গান আর অন্যপাশে বারবিকিউ। গানের আসর শেষে জমলো খাওয়ার আসর। খাওয়া শেষ করে যে যার রুমে চলে যায়। সকাল ৫টায় ঘুম থেকে উঠতে হবে। তা না হলে সূর্যোদয় দেখা যাবে না। সকাল বেলার মাছের বাজারটাও দেখতে পারবো না।
> আরও পড়ুন- ঈদে ঘুরে আসুন কাট্টলী সমুদ্রসৈকত
কখন ঘুমিয়েছি জানি না। ভোর ৫টার আগে রুমমেটের ডাকে ঘুম ভাঙলো। ঘুম ঘুম চোখে সবাই বিচে বেরিয়ে পড়লাম। সকালের হাওয়াটা একটু ঠান্ডা ছিলো। কেউ হাঁটছে কেউ দৌড়াচ্ছে। স্যাররা এখানকার কিছু প্রাণির সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। জীববৈচিত্র সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন।
হাঁটতে হাঁটতে দেখা পেলাম সূর্য মামার। আমরা চলে গেলাম মাছের পল্লিতে। সারারাত জেলেরা মাছ ধরেছে। সেই মাছ বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সব মাছের সাথে পরিচিত হলাম, ছবি তুললাম এবং রিপোর্ট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যও সংগ্রহ করলাম।
রিসোর্টে এসে সকালের নাস্তা সেরে ছেড়া দ্বীপ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি। দুপুর তখন একটা বাজেনি। ছেড়া দ্বীপ থেকে আবার রিসোর্টে ফিরে আসলাম। তখন মনটাও খারাপ হয়ে গেলো। কারণ একটু পরেই এই নীল সাগর আর কোরাল দ্বীপ ছাড়তে হবে। বিকেল সাড়ে ৩টায় আমাদের জাহাজ। ৩টার আগেই আমরা জাহাজে উঠে যাই। যথাসময়ে জাহাজ ছাড়লো। বিদায় জানাতে হলো সেন্টমার্টিনকে।
এসইউ/এমএস