হিমাচলে তুষার ঝড়ের কবলে- শেষ পর্ব
হিমাচলে ঘুরতে গিয়ে মারাত্মক তুষার ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন কলকাতার বাসিন্দা গোপা কর। একদিকে রোমাঞ্চকর হলেও অন্যদিকে ভয়ংকর ছিল সে ঝড়। ভ্রমণ করতে গিয়ে এমন আতঙ্কে সময় কাটাতে হয়নি কখনো। সেই অভিজ্ঞতাই জানাচ্ছেন আজ শেষ পর্বে-
যদিও স্লেটরঙা আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় বোঝার উপায় নেই। বরফপাত আর ঝড়ো হাওয়ার বিরাম নেই। প্রতিটি গাড়ির মাথায় একহাত উঁচু বরফ জমে গেছে। আমাদের সারথি কিছুক্ষণ বাদেই গাড়ির সামনে গিয়ে উইন্ডস্ক্রিন থেকে পুরু বরফ ঝেরে ফেলছে। ওয়াইপারের সাধ্য কী যে বরফের ওই পুরু আস্তরণকে সরায়। গাড়ির ভেতর বসে থাকতে থাকতে একসময় ভয় করতে লাগল এই ভেবে যে, আমরা নিচে নামব কিভাবে?
এভাবে ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেল। ঘড়িতে বেলা একটা বাজে। দেখলাম আমাদের সামনের গাড়িগুলো থেকে পর্যটকরা নেমে হাঁটতে শুরু করেছেন। তা দেখে আমাদের ড্রাইভার বলল, ‘দিদি আপনারাও হাঁটা শুরু করুন। তা না হলে সারারাত এখানেই, এই গাড়ির মধ্যে কাটাতে হবে।’ ওর কথা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। বলে কি? এখানে কিভাবে হাঁটব? কতক্ষণ হাঁটব? একহাঁটু বরফে হাঁটা কি সহজ? মানালি থেকে রোটাং পাসের দূরত্ব প্রায় ৫৬ কিলোমিটার। সম্ভব কি এত রাস্তা হাঁটা? সঙ্গে রয়েছে এগারো বছরের মেয়ে। কিন্তু চিন্তা বেশিক্ষণ করতে পারলাম না। বাস্তবতা উপলব্ধি করে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। দেখলাম প্রচুর লোক হাঁটছে। নিচের দিকে দৃষ্টি যেতে দেখি অজস্র চলমান কালো কালো বিন্দু।
হাঁটছি তো হাঁটছি। মনে হলো এ হাঁটার বোধ হয় শেষ নেই। একসময় কাঁধের ব্যাগে মোবাইলটা বেজে উঠল। বেজে যাচ্ছে। কিন্তু সেটাকে রিসিভ করার ক্ষমতা নেই, কারণ হাতে কোনো সাড় নেই। চলতে চলতে হঠাৎ কানে এলো এক মায়ের আর্তচিৎকার, ‘মেরি বেটি কো বাঁচাও’। চমকে তাকিয়ে দেখি বছর দেড়েকের একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে প্রায় ছুটে চলেছে বাবা। পেছনে চিৎকার করছে মা। মেয়েটির কোনো সাড় নেই। খানিকবাদে একটি বছর বাইশ-তেইশের ছেলে বাচ্চাটিকে চেয়ে নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে চলতে চলতে নিমেষে চোখের আড়াল হয়ে গেল। জানা হলো না বাচ্চাটির শেষ পর্যন্ত জ্ঞান এসেছিল কিনা। একজায়গায় দেখলাম, বছর খানেকের এক শিশুকে জাপটে ধরে মা বসে পড়েছে রাস্তার পাশে। কী হয়েছে বুঝে উঠতে পারলাম না। দাঁড়িয়ে যে জিজ্ঞাসা করব তার উপায় নেই। কারণ নিজেরাই তখন দিশেহারা।
কয়েকশ’ মানুষ হাঁটছে। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই আতঙ্কিত। নিজেদের জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না, প্রিয়জন ছাড়া। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, ওই এত পর্যটকের মধ্যে কারোর গায়েই কোনো বরফের উপযুক্ত পোশাক নেই। ব্যতিক্রম ছিলাম আমরা (শীত পোশাক ভাড়া নেওয়ার সময় ড্রাইভারের উপর মনে মনে বিরক্ত হওয়ার জন্য নিজেই নিজেকে ধমক দিলাম)। আমার এগারো বছরের মেয়ে ক্রমাগত আমাকে বলে চলেছে, ‘মাগো আর পারছি না মা। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছি তাকে সাহস দেওয়ার। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের চার সদস্যের একজনও যদি বসে পড়ে তবে সবাইকেই এই বরফের মধ্যে বসে পড়তে হবে। মেয়েকে একটি কথাই ক্রমাগত বলেছি, ‘বাঁচতে হলে হাঁটতে হবে, মা।’
> আরও পড়ুন- শুভ্রতার স্পর্শে : প্রবাসীদের বিশ্বস্ততা
আরো খানিকটা যাওয়ার পর দেখলাম, একজন বয়স্ক মহিলা চলতে চলতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। কোন্নগরের ওই মহিলার পায়ে ছিল চটি আর গায়ে ছিল শুধু শাল। ওনার সঙ্গী মেয়ে, জামাই, নাতি, নাতনিরা চিৎকার করতে লাগল। এরপর কী হলো জানি না। কারণ দাঁড়ানোর মতো অবস্থা আমাদের ছিল না। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি দুজন পর্যটক, দুজনেরই ভারিক্কি চেহারা, সম্ভবত বাবা ও তার বারো-তেরো বছরের ছেলে, তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে ক্রমাগত পড়ে যাচ্ছেন। পড়ছেন আবার উঠছেন। উঠেই তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আবার পড়ছেন; বোধহয় তাদের মনে হচ্ছিল ভারি চেহারার কারণে তারা সবার থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। ভারি মায়া হচ্ছিল তাদের দেখে।
ইতোমধ্যে দিনের আলো কমে এসেছে। খেয়াল করলাম, বিস্তীর্ণ তুষারক্ষেত্র এক মায়াবী আলোয় পরিপূর্ণ। মনে পড়ল- আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারণে চাঁদ দৃশ্যমান নয় বটে, তবে তার ঔজ্জ্বল্যের আভা বরফে প্রতিফলিত হয়ে অপূর্ব এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। যা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু তাই নয়, মৃত্যুভয়ে ভীত, বাঁচার তাগিদে উদভ্রান্ত আমরা দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে ওই অপরূপ শোভা উপভোগ করব সেই অবকাশও আমাদের নেই।
অন্ধকারে চলতে চলতে হঠাৎ খেয়াল হলো- আমাদের চার সদস্যের মধ্যে আমার বোন আমাদের সঙ্গে নেই। ভয় পেয়ে চিৎকার করে ডাকলাম ওর নাম ধরে। উত্তর এলো বহুদূর থেকে। ওই শব্দ অনুসরণ করে ওর কাছে পৌঁছে দেখি, প্রবল ঠান্ডায় ওর মুখমণ্ডল অসাড় হয়ে গিয়েছে, যে কারণে ও বুঝতেই পারেনি, ওর চশমা পথে কোথায় হারিয়ে গেছে। আবছা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে পথ চলছে।
প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছে। সেই দুপুর একটায় পথ চলা শুরু করে এখন সন্ধ্যা সাতটা। বিরামহীনভাবে চলেছি আমরা বাঁচার তাগিদে। জল পাব কোথায় তেষ্টা মেটানোর? সঙ্গে কিছুই নেই আমাদের। জলের বোতল গাড়িতে ফেলে এসেছি। অগত্যা গায়ে মাথায় যে বরফগুলো জমা হয়েছিল তাই মুঠো করে নিয়ে মুখে পুরে দিলাম। এ সময় মনে হলো- অন্ধকারে কেউ যেন বরফের গোলা ছুঁড়ে মারল আমার কাঁধের ওপর। অত্যন্ত বিরক্তভাবে পেছনে ফিরে তাকালাম। এই দুর্যোগে এমন অসভ্যতা করার ইচ্ছা কার জাগল তা দেখার জন্য। মুহূর্তেই আবার যখন ওই রকম একটি গোলা গায়ে পড়ল তখন বুঝলাম, আমার অনুমান ভুল। আসলে পাইন গাছের পাতাগুলো যখন আর বরফের ভার নিতে পারছে না, তখনই ওগুলো আমাদের গায়ে এসে পড়ছে।
চলতে চলতে হতক্লান্ত আমরা কতদূর এসেছি বা আর কতদূর চলতে হবে বুঝতে পারছি না। এমন সময় এক যুবক এসে আমার স্বামীকে বললেন, ‘দাদা আমার বাবা আর চলতে পারছেন না, একটু ধরবেন?’ আমার স্বামী ওই সত্তোরোর্ধ্ব মানুষটিকে ধরে কিছুদূর নিয়ে যাওয়ার পরেই বৃদ্ধ মানুষটি পড়ে গেলেন। কী অসহায় অবস্থা! ওনাকে একটু সাহায্য করব বলে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়তেই আমাদের গাইডের চিৎকার, ‘পহলে খুদ কো বাঁচাও’। তা শুনে আমরা বাধ্য হলাম ওই বিপন্ন মানুষ দুজনকে ফেলে এগিয়ে যেতে।
রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত আমাদের চলার শক্তি যখন ক্ষীণ হয়ে এসেছে, দেখলাম নিচ থেকে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা হেঁটে উপরে উঠছেন। আমি তাদের একজনের উদ্দেশে বললাম, ‘প্লিজ, রেসকিউ আস।’ ওনার উত্তর ছিল- ‘চলতে রহো, চলতে রহো। রুখ যাওগি তো মর যাওগি।’ ওনার আরো বক্তব্য ছিল, আগে শিশু ও বৃদ্ধ যারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন; তাদের উদ্ধার করাই ওদের প্রাথমিক কর্তব্য। বুঝলাম ওরা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।
> আরও পড়ুন- কলকাতার কফি হাউসে এক বিকেল
রাত আটটা। পৌঁছলাম মারহি থেকে একটু এগিয়ে কোটি বলে এক জায়গায়। দেখলাম প্রচুর পর্যটক ওখানে অপেক্ষা করছেন। সেনাবাহিনী থেকে বলা হয়েছে, সেনাট্রাকে করে সবাইকে মানালিতে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রথম সেনাট্রাক যখন এলো সেই সময় যে দৃশ্যের অবতারণা হলো, সে দৃশ্য আমি শুধু টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি। কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে যখন ত্রাণ এসে পৌঁছায়, সেই সময়ে বিপর্যস্ত মানুষের যে আচরণ তার সম্যক উপলব্ধি হলো সেদিন। অত্যন্ত হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কির মধ্যে কোনোমতেই প্রথম ট্রাকে উঠতে পারলাম না। অপেক্ষায় রইলাম দ্বিতীয় ট্রাকের। আরেক প্রস্থ লড়াই শেষে উঠলাম দ্বিতীয় ট্রাকে। আক্ষরিক অর্থেই গরু-ছাগলের মতো প্রায় দেড় ঘণ্টার ট্রাক জার্নি শেষে রাত দশটায় এসে পৌঁছলাম মানালি।
ক্লান্ত-বিধ্বস্ত দেহটাকে টানতে টানতে যখন হোটেলে এসে পৌঁছলাম, হোটেলকর্মীরা ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। পাহাড়ের উপরের বিপর্যয়ের খবর ওদের কাছে এসে পৌঁছেছিল। যে জন্য ওরা আমাদের নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। ভুলব না পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় ও পরের দিনে ওদের আতিথেয়তার কথা। হোটেলে পৌঁছেই আমার মেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তড়িঘড়ি এক হোটেলকর্মী ওকে পাঁজাকোলা করে রুমে নিয়ে যায়। সবার জন্য গরম জলের ব্যবস্থা করে। এক পেগ করে হার্ড ড্রিঙ্কসের ব্যবস্থা করে। সঙ্গে এও বলে যে, ‘না খেলে হার্ট ব্লক হয়ে যেতে পারে।’ আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে তারা বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘এটা তাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।’
হোটেলে পৌঁছেও সারারাত অত্যন্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে আমরা কেউই ঘুমতে পারলাম না আমাদের ড্রাইভারের কথা ভেবে। দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে পরদিন বেলা বারোটার সময় সে এসে উপস্থিত হয়। বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘দিদি আমি আর অন্য চারজন ড্রাইভার মিলে সারারাত আমাদের গাড়িতে জেগে কাটিয়েছি। কিন্তু খুব খিদে পেয়েছিল বলে কল্পা থেকে কেনা আপেল আর নাশপাতির পেটি থেকে কিছু ফল খেয়েছি।’ শুনে আমি অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে জানালাম, ‘খুব ভালো করেছেন।’ মনে মনে বললাম, ‘ওই বিপদে তোমাকে ফেলে আসার পরও কোনোভাবে তোমার উপকারে আসতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করছি।’
পরদিন মানালি থেকে বেরিয়ে পাঁচকুলায় একরাত ও তার পরের দিন চণ্ডীগড়ের অপরূপ রক গার্ডেন দেখে গুড়গাওয়ে আত্মীয়ের বাড়ি আর একরাত কাটিয়ে বিমানে ফিরে এলাম কলকাতায়। পায়ের আঙুলে গভীর ক্ষত আর মনের গহীনে তুষার ঝড়ের আতঙ্কের রেশ নিয়ে। বছর ঘুরে গেল ক্ষত সারতে, কিন্তু বছরের পর বছর ঘুরে গেলেও ওই তুষার ঝড়ের আতঙ্ক এখনো গভীরভাবে রয়ে গেছে আমার মনে। আতঙ্ক থাকলেও সঙ্গে তৃপ্তি আছে এই ভেবে যে, এই অভিজ্ঞতা তো সবার হয় না!
এসইউ/পিআর