কলকাতার কফি হাউসে এক বিকেল

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:০১ পিএম, ০৪ আগস্ট ২০১৮

‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই। কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই।’- এটি ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী মান্না দে’র কালজয়ী গানের দুটি লাইন। সম্প্রতি মান্না দে’র চিরসবুজ গানের সেই কফি হাউসে এক বিকেল কাটিয়ে এসেছেন আবু রায়হান মিকাঈল। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আজ-

সময়টা বিকেল ছুঁইছুঁই। কলকাতার নন্দন থেকে ৫ রুপিতে পাতাল ট্রেনে চড়ে গেলাম কলেজ স্ট্রিট। কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম কফি হাউসের সন্ধানে। হাঁটতে হাঁটতে চোখ পড়ল একটি লুচির দোকানে। সেখান থেকে খেলাম কয়েকটি লুচি, সঙ্গে আলুর দম। শুকনো পাতার বাটিতে আলুর দম ও গরম গরম লুচি খাওয়ার মজাই আলাদা!

Coffee-House

খাওয়া শেষে অল্প একটু হাঁটতেই পেয়ে গেলাম কাঙ্ক্ষিত কফি হাউসটি। প্রেসিডেন্সি কলেজ গেটের উল্টোদিকের বাঁয়ের গলিতে ঢুকলেই চোখে পড়বে বিখ্যাত ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউস’। যেটি এখন মান্না দে’র কফি হাউস নামে প্রসিদ্ধ। কফি হাউস সংলগ্ন সড়কে ঢাকার নীলক্ষেতের মতো চিরচেনা বইয়ের অসংখ্য দোকান আমাকে বিমোহিত করেছিল। সেখানে গেলে বইপাড়ার এমন দৃশ্য সবারই চোখে পড়বে!

এদিকে বাহির থেকে কফি হাউস ভবনে দৃষ্টি পড়তেই আমার মনটা ভেঙে গেল। পুরাতন জরাজীর্ণ পরিত্যক্তের মতো দেখাচ্ছিল ভবনটি। এমন জরাজীর্ণ ভবনটাকে সেই বিখ্যাত কফি হাউস হিসেবে কেন জানি মানতে পারছিলাম না। হোক না সেটা শত বছরের কুটির, তবুও কি তুলির আঁচড়ে নয়নের কাছে ভরা যৌবন ফেরানো যেতো না?

Coffee-House

একটু মন খারাপ নিয়েই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। দোতলায় উঠতেই চোখে পড়লো ‘কফি হাউস’ লেখা সাইনবোর্ড। এরপর দরজা দিয়ে ভেতরে একটু উঁকি দিতেই চমকে উঠলাম। বাহির থেকে দেখলাম একটি জরাজীর্ণ ভবন, আর ভেতরে এসে এ কী দেখছি! অডিটোরিয়ামের মতো দোতলার বিশাল রুমটি লোকারণ্য। সবাই গল্প, আড্ডায় মত্ত। চারিদিকে হইচই আর হইচই! সেখানে বসার মতো একটি সিটও খালি পেলাম না।
দোতলা থেকে গেলাম তিনতলায়। তারপর ভেতরে ঢুকেই যেন প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। দেয়ালের নানা প্রান্তে টাঙানো রয়েছে বিখ্যাত সব শিল্পীদের চিত্রকর্ম। দ্বিতীয় তলায় সারি সারি পঞ্চাশ-ষাটটার মতো সাজানো ছিল গোলটেবিল। তবে তৃতীয় তলাটি ছিল ভিন্ন রকমের। এটি দেখতে থিয়েটার বা গ্যালারির মতো। সেখানেও চারদিক থেকে টেবিল সাজানো।

একটি টেবিলে বসলাম। কফির অর্ডার দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই মাথায় পাগড়ি পরা ষাটোর্ধ্ব একজন বেয়ারা কফি নিয়ে এলেন। কফির পেয়ালায় চুমুক দিতেই হারিয়ে গেলাম মান্না দে’র ওই বিখ্যাত গানের মাঝে। গুনগুন করে গাওয়া শুরু করলাম গানটি। ওই মুহূর্তটি ছিল কল্পনাতীত। উল্লেখ্য, এখানে পাঁচ পদের কফির পাশাপাশি চাইনিজ আইটেম ও বিভিন্ন স্ন্যাকস পাওয়া যায়। দামও ততো বেশি নয়। কফির পেয়ালা ১৬ রুপি থেকে শুরু। এরপর দাম-চাহিদা অনুয়ায়ী বাড়ে। তবে ক্রিমসহ কোল্ড কফির দাম সবচেয়ে বেশি।

Coffee-House

প্রতিদিন হাজারো মানুষের কলরবে মুখরিত হয় কলকাতার কফি হাউসটি। নিকটতম স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও লেখক, সাহিত্যিক, গায়ক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও বিদেশি পর্যটকরাও আড্ডা জমান এখানে। প্রেমিকযুগলেরও রয়েছে বেশ আনাগোনা।

মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বাঙালি অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো কত বিখ্যাত ব্যক্তিরা একসময় আড্ডা দিয়েছেন এই কফি হাউসে!

Coffee-House

২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর পরলোকগমন করেন মান্না দে। তবে তার গানের সাত কাল্পনিক চরিত্র এখনও আছে কফি হাউসে। যা এভাবে ব্যক্ত করেছিলেন তিনি, ‘সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে/ সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই/একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি/ শুধু সেই সেদিনের মালি নেই।’

উইকিপিডিয়া মতে, উত্তর কলকাতার বইপাড়া কলেজ স্ট্রিট চত্বরে কফি হাউসটি অবস্থিত। কফি হাউসের নাম প্রথম দিকে ছিল না। এটি ছিল বিরাট আকৃতির হল। যেখানে মানুষ জমায়েত হতো। ১৮৭৮ সালের এপ্রিলে তৎকালীন ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্টের নামকরণে এটির নামকরণ করা হয় ‘অ্যালবার্ট হল’। এরপর ১৪০ বছর কেটে গেছে। ১৯৫৭ সালে এটি কফি হাউসে রূপ লাভ করে। যা ইন্ডিয়ান কফি হাউস বা কফি হাউস নামে পরিচিত হতে থাকে। একসময় কফি হাউস ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের আওতা থেকে বেরিয়ে এসে শ্রমিক সমবায়ের আওতায় আসে। বাঙালির প্রাণের এ আড্ডাস্থল উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।