শুভ্রতার স্পর্শে : পর্ব ০২
প্রথমে দু’জন দু’দিক থেকে লাগেজগুলো খুঁজতে লাগলাম। পেলাম না! তারপর একসাথে খুঁজছি। আকার, রং আর বাহ্যিকতা দেখে মাঝে মাঝে নিজেদের মনে হলেও কাছে গিয়ে দেখা যায় ‘এটা না’! বুঝলাম যে, এখানে আমাদের ব্যাগগুলো পাওয়া যাবে না। তখন অনুসন্ধান কক্ষে যোগাযোগ করলাম, দু’টো কাগজে বিভিন্ন ধরনের লাগেজের ছবি, আকৃতি দেখানো আছে। ওদেরকে বলতে হবে আমারটা কেমন?
প্রথমে মার্কিনি ভদ্রমহিলা হ্যালি বিস্তারিত সবকিছু বলার পর ওখানকার কর্মকর্তা অন্য কোথাও ফোন করলেন, খুব সম্ভবত এ তলার নিচেও কক্ষ রয়েছে। যেখানে বাকি লাগেজগুলো রাখা আছে! আমার তো গলদঘর্ম অবস্থা, ভাবছিলাম যদি ওগুলো টরেন্টোতেই রয়ে যায়, সবারটাই এলো আমারটা বাদে- এসব আরও কত কি মাথা-মুণ্ড! ভুলেই গিয়েছিলাম এটা ‘কানাডা’!
ফোনের অন্যপ্রান্তে থাকা কর্মকর্তা ওনাকে নিশ্চিত করলেন, হ্যালির কমলা আর কালো লাগেজ আর আমার নেভি ব্লু রংয়ের দু’টো লাগজের ব্যাপারে। ওগুলো নিচেই আছে, যাক! এতক্ষণে পুনরায় পরানের স্পন্দন স্বাভাবিক হলো। হ্যালি আমার চেহারা দেখে আগেই বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে আশ্বস্ত করলো ‘পাওয়া গেছে’! যে কর্মকর্তা কথা বলছিলেন সাথে সাথেই ওখান থেকে বেরিয়ে একটা ছোট্ট গাড়িতে চেপে বসে ব্যাগগুলো আনতে চললেন। তারপর হ্যালি ওয়াশরুমে গেলেন, আমি অপেক্ষা করছি আর আশেপাশের সবার কর্মকাণ্ড দেখছি! এতো ইউরোপীয় মানুষ আশেপাশে কখনও দেখিনি! যদিও তখন রাত হওয়ায় মানুষের সংখ্যা ছিল নগণ্য।
কথা বলার ধরনে, আচরণে, চলা-ফেরায় কত পার্থক্য! হ্যালি ফিরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি যাব কিনা? হ্যাঁ বলাতে নিজে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েই দিলেন ওইদিকে, আমি বলছিলাম, পারবো। পরে দেখলাম সাইনগুলো একটু ভিন্ন, ওদের পক্ষেই চট করে বোঝা সহজ! প্রথমাবস্থায় যে কেউ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে! কতটা দায়িত্বজ্ঞান থাকলে আমাকে ওয়াশরুমটা পর্যন্ত দেখিয়ে দিতে আসেন সেটাই ভাবছিলাম!
> আরও পড়ুন- শহরের গ্রিনরুম কলকাতায়
আমি ফিরে দেখলাম লাগেজগুলো রাখা আছে, হ্যালি ট্রলি নিয়ে প্রস্তুত, তাড়াতাড়ি হাত লাগালাম, একটাতেই সব চলে এলো! ওটা উনিই নিয়ে যেতে চাইলেন, আমি অনুরোধ করে নিয়ে নিলাম। একসাথে কথা বলতে বলতে নিচে চলে আসলাম। হ্যালি কথা বললো অনুসন্ধান কক্ষে। ওখান থেকে ফোনে বাইরে অপেক্ষারত ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ডাকা হলো। ট্যাক্সিচালক এসে পরিচয় দিয়ে আমাদের নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। এই প্রথমবার সরাসরি কানাডার হিমশীতল আবহাওয়ার পরশ পেলাম, আমি পুলকিত! ঠান্ডা লাগার চাইতেও উত্তেজিত ছিলাম বেশি, ইচ্ছে করছিল আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তুষারপাত দেখি, কিন্তুু সময়ের কাটা যে বয়ে চলে। উঠে বসলাম।
এবার অন্তিম গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা- মিলটন স্ট্রিট, সিডনি, নোভা স্কসিয়া। আর হ্যালিরটা ছিল আমার ঠিকানা থেকে ২০-২৫ মিনিটের ড্রাইভিং হবে! হ্যালি জানালো প্রায় চারঘণ্টা লাগতে পারে হ্যালিফ্যাক্স থেকে সিডনি পৌঁছাতে, অবশ্যই ট্রাফিকের উপর সবকিছু নির্ভর করবে! ট্যাক্সি চলছে, হ্যালি আর আমি টুকটাক কথা বলছি চালকের সাথে, খুব সম্ভবত ফ্রান্সের, বাচনভঙ্গিতে তা-ই মনে হয়। কোনো বিরতি নেই, একটানা এতক্ষণ কোনো যানজট ছাড়া কখনো এর আগে এতটা পথ চলেছি বলে মনেই হয় না!
সুনসান রাস্তা, মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি আর ট্যাক্সি চলছে আপন গতিতে! আমার গৃহকর্ত্রীকে (মারসিয়া) ফোন করতে হবে কারণ সময়ের ব্যত্যয় ঘটেছে। হ্যালিকে বললাম, সাথে সাথেই দিলো। ফোন করে মোটামুটি রকম বললাম যে, আমার রাত চারটা নাগাদ লেগে যেতে পারে। যাক, এবার একটা ঘুম দেওয়া যাবে!
মনে পড়ছিল ক্যাথে প্যাসিফিকের যে ফ্লাইটে করে হংকং থেকে টরেন্টো এসেছিলাম সেখানকার সহযাত্রী কেরালার সেই মেয়েটির কথা! ঠিক বিমান ছাড়ার পূর্বমুহূর্তেই বলে, ‘আমি পার্সে রাখা ফোনটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি’! তাড়াতাড়ি করে বিমানবালাকে ডাকলাম, লাগেজ নামালাম ও ফোন বন্ধ করলো! সিট বেল্ট লাগানোর পর মিষ্টি করে বললো ‘থ্যাঙ্ক ইউ’! আমিও বৃদ্ধাঙুলি দেখালাম। এখানে এই একটা আঙুলের খুব ভালো ব্যবহার রয়েছে।
তারপর আমি তো বসে বসে মুভি দেখলাম। অবিশ্বাস্য লাগলেও বলতে হয়, পুরো সাড়ে চৌদ্দ ঘণ্টার পথে ঘুমানোর কোন উপায় ছিল না, এমন শব্দ! অবশ্য পাশের সারিতেই প্রথম যাত্রীটিই দেখলাম বেঘোরে ঘুমাচ্ছে! আমরা দু’জন পুরো আকাশপথেই চোখ বন্ধ করেছি বহুবার, কিন্তুু নিদ্রাদেবীর কৃপা হয়নি! খাবার খাওয়ার পর ও জানতে চাইলো কি অবস্থা? আমি বললাম, ‘খাবারের কিছুটা খেতে পেরেছি, বাকিটা তো খাওয়া যাচ্ছে না শুধু ডেসার্টটা ভালো লেগেছে।’
> আরও পড়ুন- বরফের পাহাড়ঘেরা সোলাং ভ্যালি
ও বলে ওরও একই অবস্থা! আমাদের সাথে কেরালার মিল রয়েছে, ওরাও প্রধানত ভাত খায় এবং হাতে মেখেই খায়! আমি যে মুভিটা দেখছিলাম সেটাতে বেশকিছু আবেগঘন দৃশ্য ছিল, যেগুলো একা একাই দেখা ভালো! স্ক্রিনটা ছোটই কিন্তুু পাশের সহযাত্রী অনায়াসেই সবকিছু দেখতে পাবে! যখন দৃশ্য চলছে তখন আড়চোখে তাকিয়ে ওকে দেখছি, ওর চোখ বন্ধ! জানি না, ইচ্ছে করেই নাকি সত্যিই ও ঘুমাচ্ছে! যা-ই হোক, ও কিছুই দেখেনি, দর্শক একাই ছিলাম।
শেষে ওকে বলেছিলাম, ও যেন মুভিটা দেখে কারণ অসাধারণ একটা মুভি ছিলো। টুকটাক গল্পও হয়েছিল, এত শান্ত স্নিগ্ধ রুচির মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি! ওই প্রথম দেখা, হয়তো ওটাই শেষ! জানি না, তবে আগেও বলেছি ‘পৃথিবী গোলাকার’ এ সূত্রে গভীরভাবে বিশ্বাসী!
আবার ফিরে আসি ট্যাক্সিতে, কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। উঠে দেখি দু’পা-ই ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। কারণ নতুন জুতোগুলো এখানকার হিমশীতলতার সাথে টক্কর দিতে পারছে না।
চলবে...
এসএইচএস/এসইউ/পিআর