হামহামে জলের সঙ্গে সখ্য

জুয়েল থিওটোনিয়াস
জুয়েল থিওটোনিয়াস জুয়েল থিওটোনিয়াস
প্রকাশিত: ০১:২৫ পিএম, ২৪ জুলাই ২০১৮

পুরাণ মতে, বরুণ জলের দেবতা। আমাদের বরুণদা জলদেবতা না হলেও জলসখ্য তার বেশ। বরুণদা অর্থাৎ বরুণ মুণ্ডা আমাদের এবারের হামহাম সফরের গাইড। এর আগে যতোবার গিয়েছি সেখানে, বরুণদার ছোটভাই স্বপন মুণ্ডা আমাদের গাইড ছিল। স্বপন গাইডিং পেশা ছেড়ে কৃষিকাজ ও ছোটখাটো ব্যবসায় মনোযোগী। স্বপনপাড়ের ডাক শুনেই ২০১৪ সালে প্রথম সাক্ষাৎ হয় হামহামের সঙ্গে।

হামহামের বেস ক্যাম্প কলাবনপাড়ায় জিপ ঢুকতেই চোখেমুখে আনন্দ-অনিশ্চয়তার মিশেলে ২৫-৩০ জন মুণ্ডা শিশু দৌঁড়ে আসলো, হাতে বাঁশের লাঠি, দাম মাত্র ৫ টাকা। এসব ট্রেকারদের কাজে লাগে সহজ ট্রেকিংয়ের ক্ষেত্রে। আমরাও যথারীতি কিনলাম, প্রতি শিশুর কাছ থেকে ১টা করে। যারটা বিক্রি হলো সে আনন্দিত। এ কারণেই অনিশ্চয়তা থাকে যে, কারটা বিক্রি হবে। এক বাড়িতে ব্যাগ বোচকা রেখে দুপুরে কী খাব অর্ডার দিয়ে, ট্রেকিংয়ের উপযোগী পোশাক অর্থাৎ জার্সি ও হাফপ্যান্ট পরে প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিয়ে ট্রেকিং শুরু।

বছরে একবার হামহামের সঙ্গে আলিঙ্গন করাটা ধরাবাঁধা, অন্তত আমার আর সানভির। বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত বা ঝরনা। এটি ২০১০ সালে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মার সাথে দুর্গম জঙ্গলে ঘোরা একদল পর্যটক আবিষ্কার করেন। দুর্গম গভীর জঙ্গলে এই ঝরনাটি ১৩৫, মতান্তরে ১৪৭ কিংবা ১৬০ ফুট উঁচু। কেউ কেউ ঝরনার সাথে গোসলের সম্পর্ক রেখে ‘হাম্মাম’ (গোসলখানা) শব্দ থেকে ‘হামহাম’ হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। কেউ কেউ মনে করেন, সিলেটি উপভাষায় ‘আ-ম আ-ম’ বলে বোঝানো হয় পানির তীব্র শব্দকে, আর ঝরনা যেহেতু সেরকমই শব্দ করে, তাই সেখান থেকেই শহুরে পর্যটকদের ভাষান্তরে তা ‘হামহাম’ হিসেবে প্রসিদ্ধি পায়। তবে স্থানীয়দের কাছে এটি ‘চিতা ঝরনা’ হিসেবে পরিচিত, কেননা একসময় এ জঙ্গলে নাকি চিতাবাঘের দেখা মিলতো।

juwel

এবার আমরা ৭ জন; সানভি, নিলয় ভাই, মিতু আপু, আরিফ ভাই, নাদিয়া আপা, দিশা ও আমি। সানভি, দিশা আর আমি বাদে বাকি সবারই হামহামে প্রথম। ২৯ জুন রাতে কমলাপুরে উপবন এক্সপ্রেসে সওয়ার হই রাত ৯টা ৫০ মিনিটে। ঢাকা ছাড়তেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণ যেন ফিরে পেলাম। চলতি পথে কারো ঘুম নেই উত্তেজনায়, কারো জেটল্যাগে। নাদিয়া আপাকে সারা রাস্তা জোঁকের ভয় দেখাচ্ছিলাম, আপা প্রতিবারই শিউরে উঠছিল আর বকছিল। স্টেশনগুলোতে বিরতির সময় পাশের ট্রেনের ছাদে গামছা হাতে-কাঁধে একাধিক ব্যক্তির আনাগোনা, আমাদের মনে করিয়ে দিলো ঠগীদের কথা। আসলেই তাই, ওসব লোক একালের ঠগী। অ্যাডভেঞ্চারে বেরোলে এসব না হলে হয়? যেমন হতো না পুরো রাস্তার সঙ্গী মায়াবী চাঁদকে ছাড়া।

শ্রীমঙ্গল যখন পৌঁছাই, তখন ভোর রাত ৩টা। স্টেশন থেকে বেরোতেই হাতের বায়ে একটা ছোট রেস্তোরাঁয় ঢুকে পেটকে শান্ত করলাম তেলছাড়া পরোটা, ডিমভাজি আর সবজি সমেত। ভোর ৬টার আগে জিপচালক নয়ন ভাই আসবেন না বলে পদব্রজেই আমি আর সানভি বাকিদের নিয়ে ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকা শ্যামা সুইটমিটে নিয়ে যাই, চলার মতো মিষ্টি খেতে। বাকিটা সময়? শ্রীমঙ্গলের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি আর আড্ডা। ভোর ৫টায় নয়ন ভাই নিজেই কল দিয়ে জানালো, আমরা পাঁচভাই রেস্তোরাঁয় গিয়ে নাস্তা সারতে সারতে তিনি পৌঁছে যাবেন। নয়ন ভাই আমাদের পুরনো লোক।

শ্রীমঙ্গল শহর শেষ হলেই চা বাগান, আনারস বাগান; ব্যক্তিভেদে আমাদের চিরচেনা ভালো লাগা ও মুগ্ধতা শুরু। লাউয়াছড়ার মূল প্রবেশ গেট পেরোতেই জিপ থামাতে হলো। আমাদের স্বাগত জানাতেই যেন পথের ওপরের বৃক্ষরাজির ডালে ডালে দোল দিয়ে অবস্থান করছে চশমা হনুমান, উল্লুকের ডাকও পেলাম দূরে। আমাদের স্বাগত জানানো বলতে, সবাইকে এরা দেখা দেয় না, দেখা দিলেও কেউ পাত্তা দেয় না এদের। লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে সড়ক ও রেলপথ বন্যপ্রাণীর জন্য মৃত্যুফাঁদ। সেদিকে কর্তৃপক্ষের কিছুই যায় আসে না।

juwel

চাম্পারাই বাজারে কারখানা থেকে আনা ‘চা’ বিরতির পর বরুণদাকে নিলাম জিপে। রাস্তা এখন অনেক ভালো, ইট সোলিং ও পাকা মিশ্রিত, আগে ছিল কাঁচা। পর্যটন এখন সহজ, ফলে পথ ও গন্তব্যের প্রতি প্রেমপ্রদীপ নিভু নিভু। হামহামের ট্রেইলও গড়াপেটা, বাঁশের রেলিং দেওয়া। হাহ! বনে প্রবেশের আগে রেঞ্জ অফিসে নিবন্ধন করতে হয়। সেখানে ট্রেকারদের কাছে বাড়তি টাকা চায়, হামহামের ট্রেইল গড়াপেটার জন্য অথচ সরকারি খরচেই তা করা হয় এবং ট্রেকারদের কাছে টাকা চাওয়া-নেওয়াটা অন্যায়।

যে কোনো ট্রেকিং বা হাইকিংয়ে প্রথম আধ-এক ঘণ্টা একটু কষ্ট হয় সবারই তা সে যতো ফিট ব্যক্তিই হোক। একে বলে এক্লেমাটাইজিং বা মানিয়ে নেওয়া। আমাদের ২-৩ জনেরও তাই হলো। তবে সবচেয়ে যেটা জরুরি, তা হলো মনোবল, সেই বলে (দেহবলও দরকার) তারা উৎরে গেল দ্রুত। পুরো পথে বিশ্রাম নিতে হয়েছিল খুবই কম, আমি আর সানভি খুবই অবাক ও সন্তুষ্ট হয়েছিলাম সবার পারফরমেন্সে।

juwel

বনপথে পা রেখে যেন সবাই আদিমসত্তা অর্থাৎ প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ টান যেন উপলব্ধি করলো। তাছাড়া শহরে থেকে থেকে তা থেকে বেরিয়ে সান্দ্র-সবুজে নিমজ্জিত হলেও টানটা অমন হয়। সানভিসহ কয়েকজন চাইছিল বৃষ্টি নামুক আকাশ ভেঙে, তাতে ট্রেকিং জমবে, ঝরনাকে দেখা যাবে উদ্দাম নৃত্যে। আমি মনে মনে প্রকৃতিকে বলছিলাম বৃষ্টি না হোক, হলে নবীনদের নিয়েই টানাপোড়েন হবে। হয়ওনি অবশ্য। রোদ ছিল রুদ্র, মাঝে মাঝে মেঘ এসে ছায়া দিচ্ছিল কায়াকে। বনপথের ঝিরঝিরে হাওয়া, পাখির কুজন আর সান্দ্র-সবুজই ক্লান্তি দূর করছিল সহসাই। শুনেছিলাম দু’দিন আগেও নাকি ভয়াবহ রূপ ছিল হামহাম ঝিরির, হড়কা বান বা ফ্ল্যাশ ফ্লাডও হয়েছিল। আজ কী হবে কে জানে? ঝিরিতে নামার আগে শেষ উৎরাইয়ে (উল্টোভাবে চড়াই) কিছুটা বেগ পেতে হলো নবীনদের, হাস্যকরভাবেই তারা উড়িয়ে দিলো তা যখন ঝিরির শীতল জলে তাদের প্রথম পদক্ষেপ পড়লো। ঝিরি দেখেই বোঝা গেল ঝরনায় পানি কম; মন খারাপ। থাক না! প্রকৃতি যেমন নিজেকে উপস্থাপন করবে, তেমনই গ্রহণ করবো। ঝিরিপথের সৌন্দর্য অবলোকন করে সফরসঙ্গীদের কেউ কেউ সন্দেহ করেই বসলো এটি বাংলাদেশেই কিনা।

নবীনদের যখন বলা হলো, কান পাততে, সবার সেকি আকর্ণ হাসি! হামহামের নৃত্য-গীত সঞ্চারিত সুমধুর বাণী বাতাসে ভেসে আসছে। তার সামনে গিয়ে চর্মচক্ষু-দর্শনেই বিমোহিত সকলে। প্রথমে টিফিন বিরতি নেওয়া হলো, সিদ্ধান্ত হলো আগে ঝরনার উপরে যাওয়া হবে, কেননা ঝরনায় স্নান করলে ভেজা জামা ও শরীরের ওপর ওঠা কষ্টকর হবে, তাছাড়া ঝরনায় কিছু উচ্ছৃঙ্খল তরুণ উপস্থিত ছিল; ঝরনার বাম পাশ দিয়ে আরোহণ করে যেতে হয় উপরে। ঝরনার পতনমুখে বসে কেউ যেন সরতেই চায় না, বকাঝকা দিয়ে সরাতে হলো; জায়গাটা পিচ্ছিল, অসাবধানতায় পড়ে গেলে হতাহত হতেই হবে। নামার সময় মিতু আপা ও নাদিয়া আপা অনেকটা বাঁচবে না মনে করেই নামলো; এতটাই ভড়কে গেছিল তারা; নবীনদের ক্ষেত্রে ওখান দিয়ে নামাটা বেগ সম্পন্ন। নেমে ঝরনায় অবগাহন চললো কিছুক্ষণ, সেখান থেকেও কেউ সরতে চায় না। সানভি তাড়া দিচ্ছিল, আরিফ ভাই তাতে হাওয়া দিচ্ছিল; সিরতাপ নামে আরেক ঝরনা আছে, সেখানে যেতে। সে পথ আরো দুর্গম ও সুন্দর। পরে অবশ্য সময় সংক্ষিপ্ততায় যাওয়া হয়নি। পুরোপথে সবাইকেই জোঁক ধরেছিল ২-১টা করে, ছবিও ওভাবে কেউ তোলেনি, চোখ দিয়ে দেখেই মন-প্রাণ জুড়াচ্ছিল। কলাবনপাড়ায় ফিরে লেবুর সরবত গিলে ফ্রেশ হয়ে ‘পৃথিবীতে আর কাউকে চিনি না’ টাইপের খাওয়া খেলো সবাই সবজি-ডাল-মুরগি দিয়ে, রান্নাও হয়েছিল চমৎকার; অবশ্য ক্ষুধা পেটে সবই মজা। ফেরার পথে জিপে ক্লান্তি ভর করলো।

juwel

যেভাবে যাবেন: ট্রেনে শ্রেণীভেদে ভাড়া। আর নন-এসি বাসে ৪৮০ টাকা শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত। সেখান থেকে জিপ রিজার্ভ করে গেলে ভালো, ভাড়া ২৫০০-৩০০০ টাকা। কলাবনপাড়া বা তার আগের বাজারগুলো থেকেই গাইড পাওয়া যায় ৫০০-৬০০ টাকায়।

প্রস্তুতি: অনভিজ্ঞরা কলাবনপাড়া থেকে বাঁশের লাঠি কিনবেন, ট্রেকিং সহজ হবে, তাছাড়া দরিদ্র মুণ্ডা পরিবারগুলোও সহায়তা পায় কিছু হলেও। ট্রেকিংয়ে সবসময় জার্সি ভালো, সুতি কাপড় ঘেমে লেপ্টে যায় শরীরে, হাফপ্যান্ট পরা ভালো, ফুলপ্যান্ট পরলে জোঁকের উপস্থিতি টের পাওয়া কঠিন। এক সেট কাপড় বাড়তি রাখা ভালো। যে বাড়িতে ব্যাগ বোচকা রাখবেন, সেখানে টাকা-পয়সা, মোবাইল, ক্যামেরা না রেখে সাথে রাখাই ভালো, রেখে গেলেও ক্ষতি নেই। যথেষ্ট সুপেয় পানি রাখতে হবে ও শুকনো খাবার। জোঁকের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কেরোসিন হাতে পায়ে গায়ে মেখে নিবেন।

কখন যাবেন: বর্ষায় গেলে পূর্ণযৌবনা ঝিরি ও ঝনার দেখা পাবেন। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে ছাতা-রেইনকোট রাখবেন সাথে। পলিব্যাগ রাখবেন।

juwel

কী দেখবেন: শ্রীমঙ্গল থেকে কলাবনপাড়া অবধি চা বাগান, আনারস বাগান, লাউয়াছড়ার কিছু অংশ, স্থানীয় সরল মানুষ, বিশেষ করে মুণ্ডা আদিবাসীদের সহজ-সরল জীবন যাপন, হামহাম ট্রেইল, বনবৈচিত্র্য, স্নিগ্ধ ঝিরি, অনিন্দ্য ঝরনা।

কী খাবেন: ট্রেকিং শুরুর আগে যে বাড়িতে ব্যাগ রাখবেন, সেখানেই খাবারের ব্যবস্থা হয়, অবশ্য সব বাড়িতে খাবারের ব্যবস্থা নেই। মূলত যে দোকানে খাবেন কলাবনপাড়ায় তাদের বললেই ব্যাগ রাখার ও কাপড় বদলানোর ব্যবস্থা করে দিবে। অর্ডার দিয়ে রাখলে ট্রেকিং শেষ করে এসে খাবার পেয়ে যাবেন; ভাত, সবজি, ডাল, মুরগি-হাঁস খেলে ১৫০-১৬০ টাকা নিবে।

juwel

কই থাকবেন: কলাবনপাড়াতেই কয়েকটি বাড়িতে চাইলে থাকা যায়। খুশি হয়ে যা দিবেন, তাতেই খুশি তবে তাতে যেন ন্যায্যতা নিশ্চিত হয়।

যা করবেন: স্থানীয় মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবেন। গাইডকে, ড্রাইভারকে, লজিংয়ে খুশি হয়ে বেশি টাকা দিতে চাইলে বলে নিবেন যে, তাদের বেশি টাকা দেওয়া হচ্ছে খুশি হয়ে; তারা যেন অন্যদের কাছ থেকে এরকম বেশি টাকা না নেয়।

যা করবেন না: চলতি পথে তা যেখানেই হোক, চিৎকার করবেন না। অপচনশীল দ্রব্য যেখানে সেখানে না ফেলে সঙ্গে রাখবেন, শহরে এসে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবেন। ক্যামেরার চেয়ে চর্মচক্ষুকে বেশি গুরুত্ব দেবেন।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।