নতুন করে পাবো বলে
২০১৬ সালের ঈদুল ফিতর। খুব ভোরে সিলেটের কদমতলী নেমেই ফিরতি টিকিট কাটার উদ্দেশ্যে রেলস্টেশন। বাসে এসে, ফেরাটা অন্তত ট্রেনে হোক। তবে ঈদের দিন হওয়ায় স্টেশন বন্ধ। অগত্যা আবার কদমতলী গিয়ে বাসের টিকিট। রিকশাযোগে কিনব্রিজ পার হওয়ার সময় রবিরশ্মি স্বাগত জানালো। সারা দিনই রুদ্র ছিল রবি, মাঝে মাঝে মেঘের ব্যর্থ চেষ্টা। যা হোক, সিলেট শহরে পৌঁছতেই দেখি, কাঁচাপাকা নাতিদীর্ঘ কেশ ও শ্মশ্রুমণ্ডিত আশরাফ ভাই তার পাগলা ঘোড়ায় (মোটরবাইক) করে আমাদের এগিয়ে নিতে আসছেন। আমাদের আশরাফ ভাই। ঈদের দিন হলেও শুধু আমাদের জন্য তার বাড়ির বাইরে আসা। এক-দুই কথা বলে বন্দর বাজারে নাস্তা খেতে খেতে আলাপ।
কথা ছিল ৩ দিনের নামে বান্দরবান যাবো। বন্ধু জেমসের ক্যালাক্যালিতে ২ দিনের নামে সিলেট। টিকিট কাটার পর অনিবার্য কারণে তা ১ দিনে ঠেকল। তা-ও সই। এবার সফরে শুধু আমি আর জেমস।
ঈদের দিন বলে আশরাফ ভাই আমাদের সঙ্গ দিতে পারবেন না, আমরাও চাই সে পরিবারকে সময় দিক। সঙ্গে না থাকলেও এমন ব্যবস্থা করবেন তিনি, সঙ্গসম। এমনিতে সুবহানিঘাট থেকে বাস ছাড়ে তবে ঈদের দিন তা-ও আবার এতো সকালে বাস পাবো না, তাই সিএনজি অটোরিকশা রিজার্ভ করে জাফলংমুখী। আমাদের চালক সানোয়ার ভাই। শহর ছাড়াতেই নির্মল-শীতল হাওয়া আলিঙ্গন করলো। পথে চোখে পড়লো, মানুষজন আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, ঈদের দিন এতো সকালে টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট পরে এরা আবার কই যায়! অবচেতন মনে হাসলাম। দেখলাম, পাঞ্জাবি-টুপি পরে মুসল্লিরা ঈদের নামাজে যাচ্ছে। কোথাও দেখলাম খোলা মাঠে চিরায়ত বাংলার অনুষঙ্গ, গ্রামীণ মেলা বসেছে যেখানে সব বয়সীরাই চির তরুণ, চির নবীন।
পথে বেশিরভাগ সময় ডান দিকে তাকিয়ে ছিলাম উচাটন মনে, কখন পাবো জৈন্তা পাহাড়ের দেখা! পেলাম একসময়। মেঘালয় রেঞ্জের এই পাহাড়ের অঙ্গে অঙ্গে ছোট বড় ঝরনা, কিছু আছে দুধসাদা, কিছু ঘোলা প্রস্রবণ। প্রত্যেকেই পূর্ণ যৌবনদীপ্ত। এরা কেউ বারমাসী, কেউ বর্ষা-মৌসুমি। প্রতিবেশী দেশের সুন্দরের আস্বাদন নিজ ভূম থেকে হলো। কী আর করা। অটোরিকশা থামিয়ে জেমস হলো তাদের ছবিয়াল। মায়া বাড়িয়ে আবার পথচলা। পথে দেখা পেলাম আরও অনেক ঝরনার।
তামাবিলের কাছে আসতেই মনে হলো, অটোরিকশা ছেড়ে উটের পিঠে চড়লাম। একে তো সক্ষমতার অতিরিক্ত ওজন নিয়ে পাথরবাহী ট্রাকের চলাচল, তার ওপর সংস্কারহীনতায় বেহাল দশা এই পথের। জাফলং পর্যন্ত পথ ওরকমই, ওখান থেকেই মূলত পাথর আসে কিনা। জাফলং বাজারে সানোয়ার ভাইকে রেখে আমরা লোকালে নৌকায় পার হলাম পিয়াইন নদী। নদীতে ব্যস্ত কয়লাজীবীরা। বর্ষায় পানি অনেক বেড়েছে, ঘোলা। আঙুল উঁচিয়ে জেমসকে দেখালাম জিরো পয়েন্ট আর জাফলং ব্রিজ। ছবিয়াল জেমস। পাড়ে নেমে হেঁটেই সংগ্রাম নামের খাসিয়াপুঞ্জি পার করে একেবারে উত্তরের ঘাটে। আজ আমরাই প্রথম। আবারও খেয়া পারাপার তবে এবার আমাদের সঙ্গী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দীপ্রজিৎ। জীবনের প্রথম ভ্রমণে নিজেই নিজের সঙ্গী, তবে সারাদিন আমাদের সঙ্গেই ছিল।
খাল পার হয়ে কিছুদূর হাঁটতেই চাক্ষুষ প্রমাণ সংগ্রামপুঞ্জি ঝরনা। শ্বেতশুভ্র জলধারা উদার-উদ্যাম। পাহাড়ের গা বেয়ে পাথুরে পদক্ষেপে আছড়ে পড়ছে তা। জেমসের ছবিয়াল ভূমিকার পর আমাদের চর্মচক্ষু দর্শন। ঝরনার নিচ থেকে মাত্র ১০ ফুট ওপর পর্যন্ত নাকি বাংলাদেশ, তার ওপরে পুরোটাই ভারত। সংগ্রামপুঞ্জি ঝরনাকে বিদায় জানিয়ে পশ্চিমের পথ ধরলাম। ১০ মিনিট হাঁটলেই নাকি আরেকটা ঝরনা তবে এর সন্ধান জানেন খুব কম লোক। আমাদের সন্ধানদাতা বিনয়দা (বিনয় ভদ্র)। নির্ধারিত সময়েরও কমে কর্ণগোচর হলো জলপ্রবাহের। কিছুটা উত্তরে যেতেই দেখা পেলাম তার। উমকেরং। আগেরজনের চেয়ে সে কিছুটা সৌম্য তবে তার জল পতিত নৃত্যের ঢঙে। উঁচু কোনো কিছু থেকে লাফিয়ে নয়, শায়িত হয়ে প্রবাহিত। আবারও জেমস তার স্বতন্ত্র ভূমিকায় অবতীর্ণ। পুনর্মিলনের আশায় উমকেরংকেও বিদায়।
খালপাড়ে গিয়ে দেখি, চোখে রোদচশমা আর হাতে সেলফি স্টিক নিয়ে সংগ্রামপুঞ্জি ঝরনা দেখতে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পর্যটক। ঈদ আনন্দ বলে কথা। আগমনের মতো নির্গমন করে সানোয়ার ভাইয়ের অটোরিকশায়। এবার গন্তব্য লালাখাল। এই সফরের সব স্পটই জেমসের আবদারের। লালাখাল ঘাটেও দেখলাম পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড়। ঈদ উপলক্ষে মাঝিরা চড়াদামে পর্যটকদের টাকা খসাচ্ছে। তবে আমরা অনায়াসেই ও সস্তায় নৌকা পেলাম, সিদ্দিক ভাইয়ের কল্যাণে। সিদ্দিক ভাই লালাখাল চা বাগানের বড় কর্মকর্তা, আশরাফ ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচয়। গতবার লালাখাল এসে তার পরিচিত নৌকাতেই ঘুরেছিলাম। নৌকা নিয়ে আসলো সিদ্দিক ভাইয়ের ছেলে সৈকত, গতবার ছিল সৈকতের বড় ভাই সাগর। অনেকটা জোর করেই প্রথমে সিদ্দিক ভাইয়ের বাড়িতে নেওয়া হলো। ভাবির বানানো পিঠা যেন অমৃত, ভাত খাওয়াতে চাইলেও আমরা হাসিমুখে সেখান থেকে চলে এলাম। এরপর লালাখাল পরিভ্রমণ। শুকনো মৌসুমেই লালাখাল সুন্দর, তখন পানি থাকে সবুজ, বর্ষায় ঘোলা। জিরো পয়েন্ট হয়ে বাঁক নিতে নিতে জেমসের ক্লিকের পর ক্লিক। আমি ভাবছিলাম, আজ নীলাকাশের আমন্ত্রণে এই রৌদ্রকরটি ঘর-বাহির স্বার্থক।
এবার রাতারগুলের পথে। দীপ্রজিতের সঙ্গে ততক্ষণে বেশ জমে গেছে আমাদের। বর্ষায় কষ্টগম্য পথ অতিক্রম করে যখন রাতারগুল ঘাটে, তখন বিকেল ৬টা। এবারও আশরাফ ভাইয়ের পরিচিত এক নৌকায়। তটিনী গোয়াইনের গা বেয়ে তিরতির করে নৌকা এগিয়ে চলছিল রাতারগুলের দিকে। রাতারগুলের কাছে পৌঁছতেই অদ্ভুত রোমাঞ্চ আঁকড়ে ধরল। রাতারগুল আমাদের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠি। পরক্ষণেই আমরা শঙ্কিত। রাতারগুল জানান দিচ্ছে, কৃত্রিমতায় যেন তাকে না হারাই। এ আবেদন এড়াবার নয়। রাতারগুল দেশের একমাত্র স্বাদুপানির জলাবন। মূলত বৈঠা বাওয়া নৌকাতেই যেতে হয় সেখানে, ইঞ্জিনচালিত জলযান তার ত্রাস, যদিও অনেকেই ত্রাস হয়েই যায় সেখানে। গতবার আমরা বন থেকে অনেক চিপস আর বিরিয়ানির অপচনশীল প্যাকেট উদ্ধার করেছিলাম, পিকনিক পার্টি আসে কিনা প্রায়ই। উদ্ধার করেছিলাম ৫টি বড় কারেন্টজাল। গর্ব করছি না। মানুষ ক্রমেই তার প্রকৃতস্থতা হারিয়ে প্রকৃতিকেও করে তুলছে সঙ্গীন। সেখানে প্রকৃতি রক্ষায় আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াস।
ভারাক্রান্ত হৃদয়েই প্রবেশ করলাম বনে। ছবিয়াল জেমস বেতিব্যস্ত ক্যামেরায়, আর আমার চর্মচক্ষু। এখানেও অনেক পর্যটক, কেউ কেউ হল্লা করে আউলে দিচ্ছে বনের পরিবেশ। তাতে রেগে গেলেও আমরা সান্দ্র-শান্ত হলাম অন্য নৌকার এক মাঝির লোকজ সুরে। নিমজ্জিত হলাম বনের আন্তরিক আতিথেয়তায়, মিতভাষী হয়ে বনের সৌন্দর্য আস্বাদনেই মনোযোগী হলাম। একসময় দেখা পেলাম বনধ্বংসী সেই ওয়াচ টাওয়ারের। সরকার এই বনে আরও অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার সবগুলোই জলাবনের বৈশিষ্ট্যবিরোধী। আন্দোলন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না তথাকথিত উন্নয়ন। ভালো-খারাপ সংমিশ্রিত মন নিয়েই বন থেকে বের হলাম। ততক্ষণে সাঁঝের মায়া। আকাশে এক-দুই-তিন করে তারা জ্বলে উঠছে, এক কোণে সরু এক ফালি চাঁদ। নৌকা স্থির রেখে বেশ কিছুক্ষণ আমরা নিশ্চুপ। মাথার ওপর ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে বাদুর আর চামচিকে, নদীতীরে ঝোপে ফিঙেদের কিচিরমিচির। নাহ! অপার্থিব নয়, নয় অলৌকিক, এই আমাদের বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড।
শেষ হয়েও হইলো না শেষ। পাড়ে নেমে অটোরিকশায় উঠতেই সানোয়ার ভাইও বুঝে গেল এবারকার মতো সাঙ্গ হতে চলেছে আমাদের সংক্ষিপ্ত সফর। শহরে পৌঁছে দীপ্রজিৎকে বিদায় জানিয়ে আমরা গেলাম আমার এক পিসির বাসায়। রাত্র আহার সেখানেই। বাসে চড়েই ঘুম আসলো না। সারাদিনের প্রতিটা মুহূর্ত ভেবেই সময় পার হচ্ছিলো। যতবার আসি প্রকৃতির সান্নিধ্যে, তাকে যেন নবরূপে লাভ করি। হোক সে চির কিংবা অচির চেনা।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা-সিলেট রুট খুবই অভিন্ন, বাসভাড়া ননএসি ৪৭০ টাকা, এসি ৯৫০-১২০০ টাকা। ট্রেনভাড়া ১৬০-১১০০ টাকা। সিলেট শহর থেকে রিজার্ভ সিএনজি ১৫০০-২০০০ টাকা, মানুষ বেশি হলে রিজার্ভ লেগুনা ২০০০-২৫০০ টাকা। রিজার্ভই সুবিধাজনক। লালাখালে নৌকাভাড়া ৫০০-১০০০ টাকা।
থাকার ব্যবস্থা
সিলেট শহরে হোটেল, মোটেল অহরহ। তবে ঘুরতে গেলে মোটামুটি মানের হলেই ভালো। কেননা সারা দিন তো ঘোরাফেরাই হবে। উচ্চমানের হোটেল নিলে টাকা অপচয়। ৮শ’ টাকা থেকে ওপরে আধা লাখেরও রুম আছে। কোনরকম বা মোটামুটি থাকার জন্য জিন্দাবাজারের গোল্ডেন সিটি মন্দ না। খাবারের জন্য সিলেটে চিন্তার কিছু নেই। তবে পাঁচ ভাই, পানসি, উন্দাল সুপরিচিত।
এসইউ/আরআইপি