জীবনে জীবন মেলাবার গল্প

জুয়েল থিওটোনিয়াস
জুয়েল থিওটোনিয়াস জুয়েল থিওটোনিয়াস
প্রকাশিত: ০৮:৩৩ এএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
ছবি: শামীমা মিতু

আমি ছুটছি। খুব তাড়া আমার। ছুটতে ছুটতেই সবার আগে থাকা সানভীকে আমার ব্যাকপ্যাকটা ধরিয়ে দিয়ে এবার আমি সবার আগে। বগালেকে সেনাক্যাম্পের ঠিক আগের ঢালে দু’জনকে জিজ্ঞেস করতেই আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিলো সেনাক্যাম্প, নয়তো লজে কাজটা সারতে হবে। শুনতে শুধু বাকি ছিল, আবার ছুট। ক্যাম্প বরাবর পৌঁছানোর পর পথিমধ্যে এক সেনাসদস্য গতি রোধ করল, দৌড়ানোর কারণ জানতে চাইলে কোনরকমে ইশারায় বুঝিয়ে আবার দৌঁড়। এক্কেবারে পয়লা লজেই কাজটা সারলাম। কাজ সেরে বাড়তি বিলম্ব না করে ক্যাম্পে গেলাম নিবন্ধন করতে, সেখানেই বাকিদের সাথে পুনর্মিলিত হলাম।

রুমা বাজারে প্রায় গলা পর্যন্ত মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে, আগামী কয়েকদিনের রসদ কিনে, গাইড তৌহিদের ঠিক করা জিপে চড়ে বসেছিলাম। রসদ কেনার কারণ, তৌহিদ গাইড প্লাস রাঁধুনি। বগালেকের আগে কমলা বাজার পর্যন্ত ব্যাপক চড়াই-উৎরাই পেরোনোর সময় ঝাঁকুনি-দুলুনি, নাচন-কোদন আর সুড়সুড়িতে পেটের খাবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে হজম। এ অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, কিসের টানে যে মানুষ ফ্যান্টাসি কিংডম আর নন্দন পার্ক যায়! যাকগে, যার যার ব্যাপার। জিপ থেকে নেমে এবার হণ্টন। আমি ছিলাম সবার পিছে। সবসময়ই পিছে থাকি, আর সানভী থাকে সবার আগে, প্রতি ট্রেকিংয়ে আমরা এটাই করি। প্রথম চড়াই পেরোতে গিয়েই প্রকৃতি আমাকে ডাকতে শুরু করলো। তা-ও শুধু জল সিঞ্চন নয়, তারচেয়েও বেশি কিছু। এরপরই আমার সেই ছোটা। আমাকে রুখে সাধ্য সাহস কার? এমন বিশ্রী চাপ লেগেছিল যে বগালেক পর্যন্ত যেতে আশপাশের সৌন্দর্যের আস্বাদ নিতে পারিনি।

সেবার গিয়েছিলাম কেওক্রাডং-তাজিনডং ট্রেকিংয়ে। ২০১৪ সালের অক্টোবরে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনাকে সঙ্গী করে এই সফর নিয়ে ব্যাপক কল্পনা-জল্পনা, একাধিক সভা-সমাবেশ, এমনকি খাওয়া-দাওয়াও করলাম। ৮ জন যাওয়ার কথা থাকলেও শেষমেশ ৬ জন চূড়ান্ত। সানভী, তোড়া, মিতু, ইশরাক, নাঈম আর আমি। ৬ জনের ৫ জনই কর্মজীবী। ঢের কষ্ট, কায়দা, কসরত করে ছুটি ছাটা মেলে। তাছাড়া কয়েক মাসের জমানো টাকা বহুল কাঙ্ক্ষিত এ সফরের পুঁজি। স্পটের খোঁজ, রুট ম্যাপ ঠিক করা, গাইড ঠিক করার দায়িত্ব-কর্তব্য যথার্থই সম্পাদন করলো সানভী। খরচাপাতির হিসাবও সারলাম ২ জন মিলে। যাওয়ার দিন রাতে ফকিরাপুল বাস কাউন্টারে মিলিত হলাম সবাই। টিকেট আগের দিন কাটা ছিল। বাসে চড়ে যারপরনাই উত্তেজনায় ঘুম হয় হয়না অবস্থা। চট্টগ্রাম পৌঁছতেই সবাই অস্থির হয়ে উঠলাম। কখন বান্দরবান পৌঁছব! বান্দরবান পৌঁছে শরীরের সঙ্গে মনের আড়মোড়া দিলাম। প্রায় প্রকৃতিহীন রাজধানীতে বসবাস করে শরীর-মন জরাগ্রস্ত ছিল। নাস্তা সেরে পাবলিক সিস্টেমে ইজিবাইকে চড়ে বাসস্ট্যান্ড, সেখান থেকে বাসে করে সদরঘাট। বান্দরবান থেকে রুমা ও থানচির পথ পুরোটাই চিম্বুক রেঞ্জ দিয়ে। মাঝে ওয়াই জংশন, সেখান থেকে রুমা ও থানচির পথ আলাদা। পুরো পথের কোথাও উদ্ধত খাড়া, কোথাও আবার ধা করে অধঃপতন। আর প্রতিটা মোড় নতুন নতুন সৌন্দর্যের অবগুণ্ঠন খুলে নিজেকে মেলে ধরে। উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঢেউ তো আছেই। সদরঘাট নেমে আলসেমি করে প্রথম জিপ ছেড়ে দিলাম। দ্বিতীয় জিপ আসতে দেরি হওয়ায় দিলাম হাঁটা। কেননা আজকের গন্তব্য কেওক্রাডং, যতো রাত হোক। পলক ফেলা ছাড়া অবিরাম দৃষ্টিতে পার্বত্য বাংলার অকৃপণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে রুমায় সদ্য কৈশোর পার করা গাইড তৌহিদের সাদর অভ্যর্থনা। গাইড সমিতির ফর্ম পূরণ করে সবজি আর মুরগি দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ। পেটে ছুঁচো ডন মারছিল কিনা।

keokara

সেনাক্যাম্পে নিবন্ধনের সময় আমার কাণ্ড নিয়ে হেসে লুটোপুটি খেলো সবাই, নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা সেনাসদস্য লুটোপুটি না খেলেও হাসল। বিকেল ৪টার ভেতর নিবন্ধন সারতে হয়। নতুবা বগালেকে প্রবেশ বা এখান থেকে বের হওয়া যাবে না। নিবন্ধন সেরে বগালেকের সৌন্দর্য যথাসম্ভব স্বল্প সময়ে আকণ্ঠ পান করলাম সবাই, সাথে মিতুর ক্যামেরায় কয়েকটা স্ন্যাপ। তবু যেন তৃষ্ণা মেটে না। তৃষ্ণাকে নিয়েই কেওক্রাডংয়ের পথে ট্রেকিং। সাথে থাকল বগালেকের লজগুলোতে থাকার অভিপ্রায়। পথে তোড়াকে জোঁক ধরল, বাংলা জোঁক, চীনা জোঁক। আর তোড়ার সে কি তাণ্ডব নৃত্য? এই মেয়েটাকে খালি জোঁক ধরে।

বগালেক থেকে কেওক্রাডংয়ের ট্রেইলটা অসাধারণ। চিংড়ি আর পাতা ঝরনার সঙ্গে ক্ষণিকের মিতালী ভুলবার নয়, বিশেষ করে চিংড়ি ঝরনার সঙ্গে। সামনের দিক ছাড়া ৩ দিক দিয়ে পাহাড় ও গাছপালায় ঘেরা বিশ্বাস্য সুন্দর। নিজে দেখেছি বলেই বিশ্বাস্য। পাহাড়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে বলেই চিংড়ি আর পাতার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে সাঁঝবাতির রূপ নিলো আমাদের টর্চ আর আমাদের ভ্যানগার্ড তৌহিদ। পরদিন অমাবস্যা, স্বভাবতই চারদিক নিকষ কালো অন্ধকার, সাথে ঘন গাছপালা, তবে আকাশ নক্ষত্রখচিত। এমন অবস্থাতেই ঢালু পথের পাশে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম, কানে এলো হারমন পাড়া থেকে ভেসে আসা পাহাড়ি বাদ্যযন্ত্রের মাতাল করা সুর। অনুষ্ঠান আছে নিশ্চয়ই। বাদ্যের প্রতিটি তাল আমাদের হৃদয়ে স্পন্দিত হচ্ছিলো। অনুভব করলাম, এ সুরে আছে যেমন আছে নির্মল আনন্দ, তেমনি আছে শত বছরের শোষণ-বঞ্চনা-কান্না। সম্বিৎ ফিরতেই দেখি সামনে কালো রঙের অতিকায় কী যেন ধীর পায়ে উঠে আসছে। কাছে আসতেই দেখি একটা গয়াল, সাথে ২ জন মুরং। আন্দাজ করলাম, হারমন পাড়ায় নেওয়া হচ্ছে। গয়ালটা আরেকটু হলেই পারা দিয়ে মিতুর ক্যামেরা ছাতু করে দিতো। দোষটা আমাদের, অসাবধান ছিলাম।

বিশ্রাম শেষে আবার পথ চলা, সাথে দুষ্টুমি, গান, আর তৌহিদের কাছ থেকে পাহাড়ের খবরাখবর। মাঝে মধ্যেই বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, এতটা বন্ধুর পথ এই প্রথম কিনা, তবে শুচি শীতল বাতাসে ক্লান্তি চটজলদি মিইয়ে যাচ্ছিল। দার্জিলিং পাড়ায় এক মুহূর্ত দেরি করিনি। কেওক্রাডংয়ের কাছাকাছি গিয়ে সানভী, তোড়া আর নাঈম শিশুতোষ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠলো, কে আগে চূড়ায় পৌঁছবে। বাকিরা পরে উঠলাম। ওদিকে তৌহিদ গেলো কেওক্রাডংয়ের সত্ত্বাধিকারী লাল মুন থন বমের (লালা বম) বাড়িতে কথা বলতে। সেখানেই আমরা খাবো আর রাতে থাকবো।

keokara

কেওক্রাডংয়ে জিপে চড়েও যাওয়া যায়। আসলে সবকিছু এতো সহজে পেয়ে গেলে তার মূল্য দেয় না মানুষ। যাই হোক, কেওক্রাডংয়ে উঠে মনেই হয়নি তাকে জয় করলাম। সে সগৌরবে গৌরবান্বিত। তাকে হারানো বা জয় করার কিছু নেই। আসলে জয় করলাম নিজেকে। চূড়ায় বিশ্রাম নিতে নিতে নিজেদের আজকের মতো সফল ও তৃপ্ত মনে হলো। কেওক্রাডং সরকারি হিসাবে সর্বোচ্চ চূড়া, ৩২০০ ফুটের কিছু বেশি। এ নিয়েও আছে বিতর্ক। সরকারি হিসাবে তাজিনডংকেও সর্বোচ্চ চূড়া বলা হয়েছে যদিও উচ্চতা ২৮০০ ফুট। তবে বেসরকারি হিসাবে সর্বোচ্চ চূড়া ত্লাংময় বা সাকা হাফং, উচ্চতা ৩৫০০ ফুট।

রাত ৯টা বেজে যাওয়ায় সেনাবাহিনী বেশিক্ষণ থাকতে দিলো না তবে নিবন্ধন করিয়ে নিলো। খাওয়ার আগে ঝিরি থেকে তোলা পানি দাঁত কপাটি দিতে দিতে শরীরে ঢাললাম, তবে নিশ্চিন্ত ছিলাম ঝিরির পানিতে ঠান্ডা লাগে না বলে। ঝিরির পানি এমনিতেই ঠান্ডা, তার ভেতর হেমন্তকাল। খাবারের মেন্যু ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, পাহাড়ি খাসি আর ডাল। যেন অমৃত দিয়ে পেট পূজা করছিলাম, তাই খাবার টেবিলে কথা হচ্ছিল কম। পরদিন ভোরে উঠতে হবে নয়তো পিছিয়ে পড়বো, এই ভয় দেখিয়ে, গল্প গল্প করতে তৌহিদ ঘুম পাড়িয়ে দিলো।

তৌহিদ পাখির ডাকে ভোরে ঘুম ভেঙে বারান্দায় দাঁড়াতেই হেমন্তের মিঠে কড়া রোদ আলিঙ্গন করলো, যেন ওঁৎ পেতেই ছিল। বাসি মুখেই সবাই চূড়ায় উঠলাম, অবলোকন করলাম কেওক্রাডংকে। দূরের পাহাড়সারি আকাশ সমান নীল, আমরা মেঘের অনেক ওপরের স্তরে। ঝটপট কিছু ছবি তুলে নিচে নেমে নাস্তা সারলাম খিচুড়ি আর ডিম ভাজি দিয়ে। লালা বমের পরিবার আর সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তাদের সাথে বেশ সখ্যতা হয়েছিলো, ঢাকা ফেরার পর এক সেনাসদস্য তো কয়েকদিন যোগাযোগ রেখেছিলো কিন্তু আমরা আর না রাখায় সে ধৈর্যহারা হয়েছিলো। ১০ মিনিটের পদব্রজে দেশের সর্বোচ্চ গ্রাম পাসিং পাড়া, সেখানেও কাল বিলম্ব করিনি।

keokara

আজ সবাই অনেক ফিট। গতকাল প্রথম দিন হওয়াতে বেশ হ্যাপা গিয়েছিল, তবে খেলোয়াড় ইশরাকের নির্দেশনায় শারীরিক কসরতে তা কাটিয়ে উঠছিলাম। অনেকটা পথ বাকি এমনটা জেনেই পথে দেখা একপাল গয়ালের সঙ্গে। গয়াল দ্য ট্রেকার, আসলেই তাই। তাজিডংয়ের চূড়াতেও ওদের পায়ের ছাপ পেয়েছি। দেখা হলো পুষ্প-বৃক্ষ-বিহঙ্গের সঙ্গে। পড়ন্ত বিকেলে বাকত্লাই পাড়ায় পৌঁছার আগে বাকত্লাই ঝরনার রব শুনলাম, তৌহিদ জানালো সময় থাকলে যাওয়া যাবে। সময় আর হয়নি পরে। বাকত্লাই পাড়াতেই আজ যাত্রাবিরতি। এক দিদির বাসায় মাল-সামান রেখে বাকত্লাই ঝিরিতে পাড়াবাসীদের সঙ্গে দাপালাম, কেউ কেউ কাপড়ও কাঁচলো। ঝিরির দ্বিতীয় ধাপে স্নান করলাম, তৃতীয় ধাপ কাপড় কাঁচার, প্রথমটা পান করা ও রান্নার।

রাতে তৌহিদের রান্না করা খিচুড়ি খেয়ে পাড়ার উঠানে, অমাবস্যায় কেউ কাউকে না দেখলেও গান আড্ডা ছিল আমাদের সেতু, যোগ দিয়েছিল গিটার সমেত পাড়ার ২ দাদা। তৌহিদের সতর্কবার্তায় আবারও তাড়াতাড়ি ঘুমযোগ ও পরদিন ভোরে ঘুমবিয়োগ। আজকের সকাল বেশি উজ্জ্বল, রবির কিরণ অনেক বেশি দীপ্তিময়। সানভীর কথায় সোনাঝরা রোদ্দুর। আগের রাতের খিচুড়ি গরম করে খেয়ে রওনা হওয়ার আগে সানভী আমাদের কাছে চিরুনি চাওয়াতে আমরা দম ফাটিয়ে হাসলাম। সানভী সবসময় দুর্ধর্ষ ট্রেকিংয়ে বিশ্বাসী। সে পানাহার না করে, দাঁত না মেজে, স্নান না করে, মলত্যাগ না করে, কাপড় না বদলে ট্রেকিংয়ের পক্ষে। আর সে কিনা চিরুনি চায়! হাসতে হাসতে বাকত্লাই সেনা ক্যাম্প পেরোনোর সময় ঘটলো বিপত্তি। আগের রাতে নিবন্ধন না করায় আমাদের আটকালো, তৌহিদ বেদম ঝারি খেলো ক্যাম্প প্রধানের, তবে সবার মুঠোভরে আমলকি দিলো যা কিনা পথে টনিকের কাজ দিলো।

আমরা পথে পরে থাকা কাঁচা হরিতকিও খেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম উন্মুক্ত বক্ষের পাহাড়ি বৃদ্ধাকে যে কিনা আমাদের মতো কথিত সভ্য মানুষের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে বুকে হাত ভাঁজ করে পথ চলছিল। প্রকৃতি তো আসলে নগ্নই, তার আবার লজ্জা কিসের, লজ্জা আমাদের কথিত সভ্যদের তৈরি যা অত্যন্ত হীন। মধ্যগগনে সূর্য মাথায় নিয়ে পৌঁছলাম সিমপ্লাম্পি পাড়ায়। ঠিক পেছনেই তা-জিন-ডং। আমরা সবচেয়ে উঁচুটা অর্থাৎ মাঝখানের জিন এর চূড়ায় উঠবো। পাহাড় এখানে আকাশে হেলান দিয়ে ঘুমায় না, সদা জাগরুক অতন্দ্র প্রহরী। কাঁধের বোঁচকা রেখে পানি ও শুকনা খাবার নিয়ে ঝিরি পথ, বনস্পতির ছায়াবীথি আর উন্মুক্ত জুম ক্ষেত পেরিয়ে, একেবারে শেষ দিকে কিছুটা হাঁচরে পাঁচরে চূড়ায়। সফলতা ও তৃপ্তির হাসি আবার হেসে, ছবি তুলে, সিমপ্লাম্পি পাড়ায় জুমের কাঁচা মরিচ দিয়ে খিচুড়ি খেয়েই রওনা।

keokara

এবার ঝিরি ও পাহাড়ি পথ মিলিয়ে। বিশ্রাম নেওয়ার সময় সবাই খেয়াল করলাম সানভীর পশ্চাদ্দেশ রক্তে ভেজা, জোঁক মিয়া মন-প্রাণ ভরে রক্ত পান করে ঢেঁকুর তুলে পরে গিয়েছে। সন্ধ্যা নামতেই ঝিরিতে চিংড়িদের চোখে আলো ফেলে বেশ কয়েকটা ধরলো নাঈম। সেগুলো রাতে গাইড কাম রাঁধুনি তৌহিদের খিচুড়ির স্বাদ বাড়িয়েছিল। আশ্রয় নিলাম কাইতন পাড়ার কারবারির বাড়িতে। খাওয়ার আগে ঝিরির শীতল জলে অবগাহন, সানভীকে দেওয়া জোঁকের ভালোবাসার কামড়ও তাতে নিরাময় হলো। সে সময় পাড়ার ছেলেমেয়েরা ভিড় করে আমাদের দেখছিল, শহুরে চিড়িয়ারা কী করে তা দেখতে। খাওয়ার সময়ও কারবারির পরিবারসহ পাড়ার অনেকেই আমাদের দেখতে এসেছিল। খাওয়ার পর তোড়া পাড়াবাসীর সাথে ভাষা বিনিময় করলো, আমি তাতে যোগ দিলাম। তাদের ভাষা মুরং আর আমাদের ভাষা গারো, মধ্যস্থতাকারী ভাষা বাংলা। অতল ঘুমে নিমজ্জিত হবার আগে, আমরা পাড়ার উঠানে কিছুক্ষণ হেঁটেছিলাম, দেখেছিলাম মেঘমুক্ত আকাশে তারার মেলা, নিশুতি রাতে নীরব-নিস্তব্ধ পাড়ার চারপাশে ঝিঁঝিঁ আর ঝিরির কুলু কুলু ধ্বনির ঐকতান।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঝিরির পাড়ে অপার্থিব সৌন্দর্য। পাথর ছুঁয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী, হেমন্তের কুয়াশা, স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়া, চারিদিক বনরাজির গুরুগম্ভীর দাঁড়িয়ে থাকা, ওপরে ছেঁড়া তুলোর মেঘ, কমলা রোদ, আর প্রকৃতির সন্তান এই আদিবাসীদের মাঝে আমি অতি তুচ্ছ। প্রথম প্রথম প্রকৃতির কাছে গিয়ে তাকে নিজের মতো করে চাইতাম। একসময় প্রকৃতি আমাকে বলল, ‘আমি আমার মতো করে নিজেকে তোমার কাছে মেলে ধরব এবং সেটাই তোমাকে গ্রহণ করতে হবে তা যেমনই হোক।’ জয়তু প্রকৃতি।

বোর্ডিং পাড়ায় কলা আর বিস্কুট দিয়ে নাস্তা করার সময় দেখলাম কাঠ মহাল, গাছ কেটে বন উজাড়। ভোগবাদী, লোভী মানুষের হিংস্র ছোবল এখানেও পড়েছে এবং প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর মদদেই। স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদ এখানে ধোপে টেকে না।

keokara

আমরা যাচ্ছি থানচি। বিদায় যাত্রা এবারকার মতো। বেশিরভাগ পথ খাঁড়া পাহাড়ের দেয়াল ঘেঁষে, পাশাপাশি ২ জন কোনভাবেই চলার মতো না। ছায়াঘেরা স্থানে কোথাও পিচ্ছিল, বিশেষ করে গাছের ডাল দিয়ে বানানো সিঁড়িগুলো শিহরণ জাগায়, পা হরকালে পড়ি তো মরি। তোড়া তো একসময় ভয়ে আর শারীরিক অক্ষমতায় কান্না জুড়ে দিলো, সে আর এগোবে না। তা কি আর হয়? বুঝিয়ে সুঝিয়ে নেওয়া হলো। তাকে নিয়ে পিছিয়ে পড়েছিলাম তবে পথ চিনে নিয়েছি বিস্কুট, লজেন্স আর চিপসের প্যাকেট দেখে। মন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়েছিলো। আসলে প্রকৃতির মাঝে অপচনশীল জিনিস দিয়ে আমরা পথ চিনতে চাই না। বাকিরা আমাদের অপেক্ষায় ছিল, মিলিত হতেই তৌহিদ দূরে এক মোবাইল টাওয়ার দেখিয়ে বলল ‘ঐ যে থানচি’। দেখে শুনে অনুভূতি ভালো-খারাপ। চমৎকার এক সফর সাঙ্গ হচ্ছে। থানচির ঝুলন্ত সেতু পার করে দুপুরের খাওয়া খেলাম কব্জি ডুবিয়ে। এরপর বাসে করে বান্দরবান। আবারও সেই উদ্ধত খাড়া, ধা করে পতন, মোড়ে মোড়ে অবগুণ্ঠনহীন নতুন নতুন সৌন্দর্য, পাহাড়ের ঢেউ, মাঝে চিম্বুকে বিরতি। সূর্য যখন পাটে, তখন বাস বান্দরবান শহরের মুখে। রাতের খাবার খেয়ে তৌহিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকামুখী রাতের বাসে। আনন্দ, দুঃখ আর জীবনে জীবন মেলাবার গল্পের ঝাঁপি নিয়ে সবাই ঘুম। গিয়েছিলাম ট্রেকিংয়ে তবে সময় নিয়ে যেতে চাই, থাকতে হবে সেখানে, তবেই না সমৃদ্ধ হবে জীবনে জীবন মেলাবার গল্প। পরের বছর আবার গিয়েছিলাম বগালেক, কেওক্রাডং। সেটাও ট্রেকিংয়ে। তবে তাজিনডংয়ে না, অনিন্দ্য সুন্দর ৩টি ঝরনা দেখতে, ভরা বর্ষায় বিধ্বস্ত পাহাড়ে, ভয়ংকর সুন্দরে। সে আরেক গল্প।

কীভাবে যাবেন
ঢাকা-বান্দরবান বাসভাড়া তো জানাই আছে। অসংখ্য বাস যায় বান্দরবান। নন এসি ৬২০ টাকা, এসি ৯০০-১৫০০। বান্দরবান নেমে রুমা-থানচি বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত অটো ভাড়া ২০ টাকা, সেখান থেকে টিকিট কেটে সদরঘাট ২শ’ টাকা, এরপর চান্দের গাড়িতে ৩০-৪০ টাকা। ৩ দিনেই কেওক্রাডং থেকে ঘুরে আসা যায়। গাইডের খরচ ৩ হাজারেই হবে। বর্তমানে তাজিনডং যেতে হয় থানচি হয়ে। রুমা-থানচি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসভাড়া ২শ’ টাকা। থানচিতে গাইড ঠিক করতে হবে।

কোথায় থাকবেন
রুমায় গাইড অফিসে যোগাযোগ করে গাইড ঠিক করতে হবে। কেওক্রাডং পর্যন্তই যাওয়া যায় এখন, এর বেশি যেতে দেয় না সেনাবাহিনী নিরাপত্তার কারণে। চাইলে প্রথম দিনই কেওক্রাডং যাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে রাতেও ট্রেক করতে হবে। নয়তো বগালেক পর্যন্ত। আদিবাসীদের বাড়িতে লজিং ব্যবস্থায় থাকা ১৫০, খাওয়া ৮০-১২০ টাকা।

সঙ্গে যা রাখবেন
জাতীয় পরিচয়পত্র, না থাকলে জন্মনিবন্ধন সনদ; গাইড অফিসে ও সেনাক্যাম্পে নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজন। পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও পানি। পানির জন্য বোতল। ঝরনা, ঝিরি, গ্রাম বেশ দূরে দূরে, সেক্ষেত্রে যথেষ্ট পানি ও শুকনা খাবার সাথে রাখতে হবে। মশা, মাছি তাড়াতে ওডোমস। জোঁকের জন্য সরিষার তেল-গুল অথবা কেরোসিন। ওষুধ রাখতে হবে সাধারণত যা লাগে সেগুলো, ব্যান্ডেজ, তুলা, অ্যান্টিসেপ্টিক। অপচনশীল কিছু ক্যারি করার জন্য পলিথিন নিতে হবে। ট্রেক শেষ করে বান্দরবান শহরে এসে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে ময়লাগুলো। গরমে গেলে জার্সি পরা ভালো, তাতে ঘামলে জামা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যাবে না। শীতে গেলে শীতের পোশাক থাকবে। বর্ষায় ছাতা বা বর্ষাতি। পায়ে ট্রেকিং স্যান্ডেল যেটা রুমা-থানচিতেই কিনতে পাওয়া যায়, দাম ১২০ টাকা।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।