‘জিনের তৈরি’ মসজিদে একদিন

দিনাজপুরের ঐতিহাসিক সুরা মসজিদ নিয়ে কিংবদন্তি আছে মসজিদটি নাকি এক রাতেই জিনেরা তৈরি করেছে আর এ কারণেই মসজিদটির নাম সুরা মসজিদ। মসজিদটি দেখার জন্য আমি ও আমার শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম। বাহন মোটরসাইকেল। আমাদের গাড়ি ছুটে চলল গ্রামীণ পথ ধরে। রাস্তার দুপাশে সবুজ ধানের ক্ষেত, আর মাঝে সরু রাস্তা—সব মিলিয়ে প্রকৃতির এক মোহনীয় সৌন্দর্য।
মসজিদের পথে
ঘোড়াঘাট উপজেলায় পৌঁছে স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করতেই তারা সুরা মসজিদের রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এই পথে গেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সুরা মসজিদ দেখতে পাবেন।’ গ্রামের সরু রাস্তা ধরে এগোতেই চোখে পড়ল এক পুরনো স্থাপত্য, মাটির লালচে রঙের ইটের তৈরি এক বিশাল মসজিদ।
মসজিদের সৌন্দর্য ও স্থাপত্যশৈলী
প্রথম দর্শনেই মনে হলো, এ এক ঐতিহাসিক নিদর্শন। সুরা মসজিদ আকারে ছোট হলেও এর স্থাপত্যশৈলী অসাধারণ। এটি প্রায় ১২.১২ মিটার লম্বা ও ৭.৯৮ মিটার প্রশস্ত, যেখানে মূল নামাজের কক্ষের আয়তন ৫.১৮ মিটার × ৫.১৮ মিটার। মসজিদের ছাদে একটি একক গম্বুজ রয়েছে, যা পুরো স্থাপনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এর চার কোণে অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ (স্তম্ভ) দেখা যায়, যা সুলতানি স্থাপত্যশৈলীর পরিচয় বহন করে।
মসজিদের দেয়ালে রয়েছে পোড়ামাটির অলংকরণ, যেখানে ফুল, লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশার অপূর্ব সমন্বয় করা হয়েছে। এর প্রধান প্রবেশদ্বারটি পূর্বদিকে অবস্থিত, যা উঁচু ও সুদৃশ্য খোদাই করা কারুকাজে শোভিত। ভেতরে রয়েছে একটি মিহরাব, যা দৃষ্টিনন্দন নকশায় সুসজ্জিত। এখানকার কালো ও বেলে পাথর বাঙলার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত রাজমহল থেকে আনা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়াও এই মসজিদে গ্রানাইটসহ নানা মূল্যবান পাথরের অস্তিত্ব রয়েছে।
পুরো মসজিদটির নির্মাণশৈলীতে স্পষ্টভাবে সুলতানি ও মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলীর ছাপ পাওয়া যায়, যা একে বাংলার মুসলিম ঐতিহ্যের একটি অমূল্য নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করে।
মসজিদের পাশেই রয়েছে বড় একটি পুকুর। গাছপালায় ঘেরা এই স্থান যেন প্রকৃতির সাথে মিশে গেছে। বাতাসে এক ধরনের প্রশান্তি, মনে হলো শতাব্দীর প্রাচীনতা আজও এখানে জীবন্ত। মসজিদের ভেতরে ঢুকে মনে হলো যেন অতীতের কোনো এক ইবাদতগাহে বসে আছি।
ধারনা করা হয় প্রাচীন স্থাপত্যের সাক্ষী এ মসজিদটি প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে নির্মিত। তবে এ মসজিদ নিয়ে অনেক লোককথা রয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, মসজিদটি মুঘল সম্রাট শাহ সুজার সময় তৈরি হয়, তাই অনেকে একে ‘শাহ সুজা মসজিদ’ বলেও ডাকে। তবে সবচেয়ে বেশি যে কাহিনি শোনা গেল তা হলো-এটি নাকি এক রাতেই জিনেরা বানিয়েছিল!
- আরও পড়ুন:
নান্দনিকতার ছোঁয়ায় দৃষ্টিনন্দন হাজিবাড়ি জামে মসজিদ
সাজেকে সবুজের বুক চিড়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, আমাদের ফিরতে হবে। মসজিদের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে মনে হলো, সময়ের সাথে সাথে আধুনিক স্থাপত্য বদলালেও ইতিহাসের এসব নিদর্শন আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে থাকবে চিরকাল।
যারা ইতিহাস ভালোবাসেন, পুরনো স্থাপত্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য সুরা মসজিদ অবশ্যই একবার ঘুরে দেখার মতো স্থান!
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাস কিংবা ট্রেনে দিনাজপুর যাওয়া যাও। বাসে ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে দিনাজপুরগামী বাসগুলো ছেড়ে যায়। বাস সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে নাবিল পরিবহন, এস আর ট্রাভেলস, এস এ পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, কেয়া পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন ইত্যাদি। নন-এসি এবং এসি মানভেদে বাস ভাড়া ৬৫০ থেকে ১৪০০ টাকা।
বাসে পলাশবাড়ী অথবা গোবিন্দগঞ্জ নেমে সূরা মসজিদ যেতে পারবেন। গোবিন্দগঞ্জ থেকে অটো/ভ্যান দিয়ে যেতে পারবেন। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা এবং গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা একদম কাছাকাছি। সেক্ষেত্রে দিনাজপুর না গিয়ে গাইবান্ধা থেকে যাওয়া সহজ হয়।
ট্রেনে ঢাকা কমলাপুর অথবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আন্তঃনগর একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস, ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। শ্রেণিভেদে এইসব ট্রেনের টিকেটের মূল্য ৫৯৫ টাকা থেকে ২,০৯৭ টাকা।
এরপর গাইবান্ধা নেমে বাস বা সিএনজিতে পলাশবাড়ী যেতে হবে। তারপর পলাশবাড়ী থেকে অটো বা সিএনজি দিয়ে সূরা মসজিদ যেতে পারবেন।
যেখানে থাকবেন
সুরা মসজিদের আশেপাশে থাকার কোনো আবাসিক হোটেল নেই। তাই আপনাকে থাকতে হলে দিনাজপুর অথবা গাইবান্ধা শহরে এসে থাকতে হবে।
জেএস/জেআইএম