কুমিল্লা শিক্ষা সফরের একগুচ্ছ সুখস্মৃতি

মোহাম্মদ এনামুল হক
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেও কলেজে পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গেলো। তবে এ নিয়ে মন খারাপ করার সুযোগই ছিল না। কারণ ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বার্ষিক শিক্ষা সফরের দিন! আমাদের জন্য এটি ছিল একেবারে শেষ সফর। তাই সবার মধ্যেই ছিল এক অন্যরকম উচ্ছ্বাস। কলেজে পৌঁছানোর পরই চোখে পড়ল সবার প্রস্তুতি। মুখে একরাশ আনন্দের ঝলক। গন্তব্য কুমিল্লা। বাসের আসন নির্ধারণ করা হলো। আমরা সিনিয়র হওয়ায় সম্মানজনক ভাবে সামনের দিকে বসার সুযোগ পেলাম।
সকাল আটটায় চট্টগ্রাম কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে আমাদের রঙিন যাত্রা শুরু হয়। যথারীতি পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুভ সূচনা করা হয়। এর পরপরই বাসে পরিবেশন করা হয় সুস্বাদু সকালের নাস্তা। যেখানে ছিল মানসম্মত ডিম, কেক, স্যান্ডউইচ, পানি আর কিছু হালকা খাবার। এরপর শুরু হয় ধুমধাড়াক্কা আনন্দ! প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথমদিকে কিছুটা লজ্জায় থাকলেও একটু পরেই পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায়। বাসভর্তি সবাই তখন গানের সুরে দুলছিল, কেউ কেউ নাচছিল, কেউ আবার মজার মজার কথা বলে সবাইকে হাসিয়ে দিচ্ছিল। কেউ ছবি তুলছিল, কেউ ভিডিও করছিল। মুহূর্তগুলো যেন ক্যামেরায় বন্দি হয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকছিল।
ঠিক বারোটার মধ্যে আমরা কুমিল্লায় পৌঁছাই। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল কুমিল্লা বার্ড। নির্ধারিত টি-শার্ট পরে আমরা বার্ডের ভেতরে প্রবেশ করি। চারদিকে সবুজের সমারোহ, পাখির ডাক, প্রশান্তিময় পরিবেশ—সবকিছু যেন এক স্বপ্নময় জগতে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের। সবাই যার যার মতো ছবি তুলছিল, কেউ কেউ ভিডিও করছিল, শিক্ষকদের সঙ্গেও আনন্দ ভাগাভাগি হচ্ছিল। রাশেদা বেগম ম্যাম হঠাৎ করে পাশে থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের দেখে হাত নাড়লেন, শিশুরাও উচ্ছ্বাসভরে হাত নাড়িয়ে সাড়া দিলো। মুহূর্তটা যেন ভালোবাসার এক সেতুবন্ধন তৈরি করল।
বার্ড থেকে বেরিয়ে আমরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওয়ানা দিই। সেখানে আমাদের জন্য আগে থেকেই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শহীদ মিনারের পাশে বসে খাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে আল্পনা আঁকা হচ্ছিল। তাই আমরা একটু দূরে গিয়ে বসে ছোটখাটো এক চড়ুইভাতি জমিয়ে ফেলি। খাবারের মেন্যু ছিল সুস্বাদু কাচ্চি বিরিয়ানি, সঙ্গে কোমলপানীয় এবং বিশুদ্ধ পানি। সবাই খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত, আনন্দে মাতোয়ারা। খাওয়া শেষে আমরা পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে যত্নবান ছিলাম। যাতে কলেজের সুনাম অক্ষুণ্ণ থাকে। এক আপু এসে বললেন, ‘আপনারা যদি এগুলো ফেলে দেন, আমি নিয়ে যেতে পারি।’ আমরা আনন্দের সঙ্গেই অনুমতি দিলাম। কারণ পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাই আমাদের লক্ষ্য।
জোহরের নামাজ আদায় করে আমরা যাত্রা করি ময়নামতি শালবন বিহারের দিকে। শালবন বিহারের অপূর্ব সৌন্দর্য আমাদের মন ভরিয়ে দিলো। কেউ ছবি তুলল, কেউ ভিডিও করল, কেউ প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেল। আমাদের শিক্ষকরা এতটা আন্তরিক ছিলেন যে, তারা নিজেরাই আমাদের ডেকে নিয়ে ছবি তুলিয়ে দিলেন। মনে হলো, এ সফর শুধু শিক্ষামূলক নয়, হৃদয়ের গভীরে গেঁথে যাওয়ার মতো এক আবেগময় অভিজ্ঞতা। এরপর ময়নামতি জাদুঘরে পৌঁছে জানা গেল, পাঁচটার পর প্রবেশ নিষিদ্ধ! আমরা অনেক অনুরোধ করেও গেট খোলাতে পারলাম না। কর্তৃপক্ষ নিয়মের প্রতি কঠোর। তাই আমরা মন খারাপ না করে চলে গেলাম বৌদ্ধ বিহারে।
বৌদ্ধ বিহার ঘুরে সন্ধ্যায় আবার চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পথে মাগরিবের নামাজের জন্য বাস একবার থামানো হলো। সবাই নামাজ শেষে আবার বাসে উঠলেন। এরপর রাতের নাস্তা পরিবেশন করা হলো। যাতে ছিল কমলা, বরই, কেক, চকলেটসহ কয়েকটি মুখরোচক খাবার। সবাই নাস্তা সেরে নিলাম কিন্তু মজা তখনো শেষ হয়নি! বাসের ভেতরে গান-বাজনা চলতে লাগলো। ফার্স্ট ইয়ারের শিক্ষার্থীরা নতুন উদ্যমে নাচতে শুরু করল। সবাই তাতে গলা মিলিয়ে গাইলো। হাসি-আনন্দ, উল্লাসে ভরা বাসের সেই মুহূর্তগুলো মনে হচ্ছিল, যেন কোনো উৎসব চলছে।
রাত সাড়ে ৯টায় চট্টগ্রাম কলেজে পৌঁছানোর পর শিক্ষকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে সবাই যার যার বাসার পথে রওয়ানা দিলাম। তবে মনে হচ্ছিল, এই সফর যেন কখনোই শেষ না হয়। একগুচ্ছ সুখস্মৃতি নিয়ে আমরা ফিরে এলাম। যা আজীবন আমাদের মনে গেঁথে থাকবে, ঠিক যেন এক স্বপ্নের মতো। অসাধারণ সফরটি সুন্দর ও সফল করতে যথেষ্ট কষ্ট করেছে বন্ধু নাঈম বিন ইদ্রিস। সফর সফল করতে যাদের ভূমিকা ছিল, তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। তারা কষ্ট না করলে এত সুন্দর হতো না। আয়োজনের তত্ত্বাবধানে ছিল নাঈম। তার প্রতি রইল আন্তরিক ভালোবাসা।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম।
এসইউ/জেআইএম