ডিজিটাল হাট: অব্যবস্থাপনা বন্ধে নতুন পদক্ষেপ
# পশু দেখে ক্রেতা সন্তুষ্ট হলেই টাকা যাবে ব্যাপারীর অ্যাকাউন্টে
# কোরবানির পশু পছন্দ না হলে রয়েছে ফেরৎ দেওয়ার সুযোগ
পবিত্র ঈদুল আজহায় হাট ঘুরে পছন্দের পশু কেনা চিরায়ত এক ঐতিহ্য। তবে এখন সেই হাটে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় শামিল হয়েছে পশুর হাটও। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে খামার থেকেই হাজারো পশু বিক্রি করছেন ব্যাপারীরা। ঘরে বসে পছন্দের পশু কিনতে পারছেন ক্রেতারা। আধুনিক এ ব্যবস্থাপনার নাম ‘ডিজিটাল হাট’।
২০২০ সালের ঈদুল আজহার সময় করোনার বিস্তার রোধে দেশে ডিজিটাল হাটের আনুষ্ঠানিক বিকাশ ঘটে। ২০২১ সালে এ হাট সারাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তবে ২০২২ সালে ডিজিটাল হাটের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমতে থাকে। কারণ, কিছু ব্যাপারী অনলাইনে পশুর এক রকম ছবি দেখিয়ে ক্রেতাকে দিতেন আরেক রকম পশু। অনলাইনে পশু বিক্রির টাকা লেনদেনে অসচ্ছতারও অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে করোনার বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় অনলাইনে পশু কেনায় আগ্রহ কমেছে মানুষের।
আরও পড়ুন>> ডিজিটাল হাটে ৫০ হাজার পশু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা
চলতি বছরও আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে ডিজিটাল হাটের কার্যক্রম চলছে। চলতি বছর ডিজিটাল হাটে ৫০ হাজার পশু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এবার অনলাইনে ২০ শতাংশ কম পশু বিক্রি হতে পারে। করোনার পর এবং পশুর দামের কারণে বিক্রি কিছুটা কম হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিজিটাল হাট
২০২০ সালে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ), ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব), আইসিটি বিভাগের এটুআই ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে প্রথমে ‘ডিএনসিসি ডিজিটাল হাট’র আয়োজন করা হয়েছিল। এরপর এ হাট জনপ্রিয়তা পাওয়ায় পুরো কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব নেয় সরকার। ২০২১ সালে এ হাটের নাম দেওয়া হয় ‘ডিজিটাল হাট’। এখন এ হাট আয়োজনে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, একশপও যোগ হয়েছে।
ই-ক্যাব সূত্র জানায়, এরই মধ্যে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় পর্যায়ের হাটগুলো যুক্ত রয়েছে ডিজিটাল হাটে। এরই মধ্যে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) ব্যবস্থাপনায় এবং সরকারের এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রকল্পের একশপের কারিগরি সহায়তায় অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
আরও পগুন>> আরও পড়ুন: জনপ্রিয় হচ্ছে অনলাইনে ভাগে কোরবানি
ডিজিটাল হাটে পশু বেচাকেনার জন্য ওয়েবসাইট চালু করেছে আইসিটি বিভাগ। এ ওয়েবসাইটে ‘নিরাপদ থাকাটাই জরুরি এখন, হাটে না গিয়েও হাট যখন তখন’, ‘এক ক্লিকে হাট থেকে হাতে’, ‘ডিজিটাল হাট থেকে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে কিনতে পারেন পছন্দের কোরবানির পশু’- এমন স্লোগানে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এ ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, সেখানে দেশের বিভিন্ন এলাকার ৬০টি পশুর খামার যুক্ত হয়েছে। পশুর ক্যাটাগরিতে গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, উট, মহিষ রাখা হয়েছে। ক্রেতাদের যে পশু পছন্দ, ক্যাটাগরিতে ক্লিক করলেই তার বিস্তারিত তথ্য পাচ্ছেন।
গরু ক্যাটাগরিতে (দেশি ষাঁড়) ৬৪৫ কেজি ওজনের একটি ষাঁড়ের ছবি দিয়েছেন গাজীপুরের কাদের এগ্রো লিমিটেড। ষাঁড়টির দাম চাওয়া হয়েছে পাঁচ লাখ আট হাজার টাকা (একদাম)। সেখানে লেখা, ‘নিজস্ব খামারে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে ধানের কুঁড়া, গমের ভুসি, অ্যাংকর ডালের ভুসি, ছোলার ভুসি, ঘাস ও খড় খাওয়ানো হয়। কোনো ধরনের মোটাতাজাকরণের ওষুধ বা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয় না। এমনকি মোটাতাজাকরণে কোনো ধরনের ফিড খাওয়ানো হয় না। অর্থাৎ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ানো হয়।’
ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা তিন বছরে প্রায় ১০ হাজার খামারিকে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেছি। বিভিন্নভাবে তারা অনলাইনে পশু বিক্রি করেছেন এবং অনেকে প্রত্যক্ষভাবেও এর সুফল পেয়েছেন। ভবিষ্যতে এ হাটের আরও প্রসার ঘটবে।’
পশুর স্বাস্থ্য সনদ ও দাম
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রতিটি উপজেলায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে। অনলাইনে পশুর ছবি আপলোড করার আগে গবাদিপশুর স্বাস্থ্য সনদ নিতে হবে। এটি দেবেন সংশ্লিষ্ট ভেটেরিনারি সার্জনরা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রির জন্য খামারিদের সংশ্লিষ্ট অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযোগে সহযোগিতা করবে এবং আপলোড করার ক্ষেত্রে মালিকের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, গবাদিপশুর বয়স, ওজন, মূল্য ও ছবি দেবে।
আরও পড়ুন>> ঈদের আগে সক্রিয় জাল টাকা চক্র, টার্গেট পশুর হাট
এরপর পশু পছন্দ ও দাম নির্ধারণ হবে। কর্তৃপক্ষ ক্রেতা ও বিক্রেতাকে ভেরিফাই করে একটি অনলাইন পেমেন্ট লিংক ক্রেতার জন্য প্রেরণ করবেন। সেই লিংকে পেমেন্ট করবেন ক্রেতা। এরপর বিক্রেতা ঠিকানা অনুযায়ী পশু ডেলিভারি করবেন। পুরো বিষয়টি ডিজিটাল হাট ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তদারকি করবে বলে জানান ডিজিটাল হাটের মাঠ পর্যায়ের সমন্বয়ক ই-ক্যাবের নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন।
ডিজিটাল হাটে বিক্রি কমছে
ই-ক্যাব সূত্র জানায়, ২০২০ সালে ডিএনসিসি ডিজিটাল হাটের প্রথম বছরে ২৭ হাজার পশু বিক্রি হয়েছিল। এরপর ডিজিটাল হাটের মাধ্যমে ২০২১ সালে ৩ লাখ ৮৭ হাজার কোরবানির পশু বিক্রি হয়। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে এ প্ল্যাটফর্মে প্রায় ৬০ হাজার পশু বিক্রি হয়েছিল। চলতি বছর ডিজিটাল হাটে ৫০ হাজার পশু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ কম।
অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির হার কেন কমছে তা জানতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। তাদের মতে, ২০২০ সালে করোনার বিধিনিষেধের সময় ডিজিটাল পশুর হাট চালু হয়েছিল। এখন সেই বিধিনিষেধ নেই। এর মধ্যে পশুর দাম অনেক বেড়েছে।
আরও পড়ুন>> ব্যাপারীদের প্রত্যাশা গরুর দাম বাড়বে, ক্রেতাদের আশা কমবে
এছাড়া ২০২১ ও ২০২২ সালে পশু বিক্রিতে কয়েকটি অনিয়ম ধরা পড়েছে। এর মধ্যে অনলাইনে কেনা পশু অনেক গ্রাহকের পছন্দ হয়নি। অর্থাৎ অনলাইনে পশুর যে ছবি দেখে পছন্দ করেছিলেন, বাস্তবে তেমনটি পাননি। এতে অনেক গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল।
তবে এবার সেই সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিজিটাল হাট বাস্তবায়নে সরকারের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে ডিএনসিসি। এ হাটে মানুষের সময় বাঁচবে। তবে বিগত বছরগুলোতে পশু বিক্রি এবং লেনদেনে কয়েকটি অব্যবস্থাপনার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে অনলাইনে এক পশু দেখিয়ে অন্য পশু হস্তান্তরের অভিযোগটি বেশি উঠেছিল। তখন টাকা ফেরত নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এবার অব্যবস্থাপনা দূর করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন একজন ক্রেতা অনলাইনে পশু কিনলে তার দাম বা মূল্য সরাসরি ব্যাপারী পাবেন না। ওই টাকা প্রথমে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে থাকবে। ক্রেতা যখন পশু হাতে পাবেন, পশু দেখে সন্তুষ্ট হবেন, সেই টাকা তখন ব্যাপারীর অ্যাকাউন্টে যাবে। এজন্য ক্রেতাকে অনলাইনে নির্দিষ্ট অপশনে গিয়ে সন্তুষ্টির কথা জানাতে হবে। অন্যথায় পশু পছন্দ না হলে ক্রেতা তা ফেরত দিতে পারবেন। এতে কারও প্রতারণার সুযোগ থাকবে না।
এমএমএ/ইএ/এমএস