ভূমিতে ইন্টারনেটের আলো আকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট
লাল সবুজের বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করলেও ডিজিটাল বাংলাদেশের কাজ শুরু খুব বেশি দিনের নয়। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেন। সেই হিসেবে ২০২০ সালে ডিজিটাল যাত্রার একযুগ পার হলো মাত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ উদ্বোধন করেন। সেই থেকে বাংলাদেশের ডিজিটাল যুগ শুরু হলেও মাঝখানে অন্য সরকারগুলো এ নিয়ে তেমন কোনো কাজ করেনি।
শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণাটি এখন বস্তুত রাষ্ট্রসত্তার অংশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে অনেক দূর। এর অংশীদাররা ‘আরও বেশি কিছু’ চাইছেন।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সুদক্ষ দিকনির্দেশনায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবরূপ লাভ করেছে। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ব্যবহার শুরু হবে। দ্বিতীয় স্যাটেলাইটটির ধরন নির্ধারণে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
দেশে টেলিডেনসিটি ৯৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও ইন্টারনেট ডেনসিটি ৬৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। ডাক ব্যবস্থার আধুনিকায়নের লক্ষ্যে দেশের ৮ হাজার ৫০০টি ডাকঘরকে ডিজিটাল ডাকঘরে রূপান্তর করা হয়েছে।
২০০৬ সালে প্রথমবার সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় ক্যাবলেও যুক্ত হয়েছে। অপেক্ষা এখন তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ সূত্র জানায়, তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের জন্য প্রস্তুত বাংলাদেশ। এ সংক্রান্ত প্রকল্পও পাস ও অর্থের সংস্থান হয়েছে। ২০২৩ সালে এটি চালু হতে পারে। এজন্য খরচ হবে ৬৫ থেকে ৭২ মিলিয়ন ডলার। এই কনসোর্টিয়ামে যুক্ত রয়েছে বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, ইউএই, ইয়েমেন, জিবুতি, মিসর, তুরস্ক, ইতালি ও ফ্রান্স। এটি মূলত সিঙ্গাপুর থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত কাজ করবে। তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল থেকে বাংলাদেশ ১২ টেরাবাইট ব্যান্ডউইথ পাবে। যার মধ্যে ৬ টেরাবাইট পাওয়া যাবে পূর্ব এবং ৬ টেরাবাইট পাওয়া যাবে পশ্চিম প্রান্ত থেকে।
তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সম্পর্কে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটি একটি যৌথ কনসোর্টিয়ামের কাজ। কনসোর্টিয়ামের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। আমরা প্রাথমিকভাবে একটা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। এ কাজটা ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে করা হয়েছিল। সেখানে চায়নিজ ও আমেরিকার একটি কোম্পানি অংশ নিয়েছিল। চায়নিজ কোম্পানির প্রাইজ খুব কম ছিল। কিন্তু মার্কিন কোম্পানি চায়নিজ কোম্পানিকে দেয়ার ব্যাপারে আপত্তি করে। সেটার একটা জটিলতা ছিল। কনসোর্টিয়ামে বৈঠকের মাধ্যমে এটি সম্পন্ন করার কথা। আমরা তো আসলে ১৬ পার্টনারের একজন। আর যেটা বুঝি যেটা হচ্ছে সম্মিলিতভাবে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব। আমাদের এই মার্কিন চীন বিরোধের ভেতরে ঢোকার কোনো ইচ্ছাও নেই। আমরা আশা করি এখন পর্যন্ত কার্যক্রমের যে পরিধি আছে সেটা সম্ভবত ২০২৩ সালে চালু হওয়ার কথা। আমরা আশা করছি, ২০২৩ সালেই চালু হবে। আমাদের দলিলপত্র স্বাক্ষর করা এবং যে অর্থ টুকু দেয়া এটুকুই কাজের মধ্যে পড়ে। আমরা এ প্রকল্প পাস করে বসে আছি। অর্থের সংস্থানও হয়েছে।’
জানা যায়, প্রায় ৪ হাজার ইউনিয়ন এবং সাড়ে ১৮ হাজারটি প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেটে সংযুক্ত হয়েছে। প্রায় ৮ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রায় ১৫ লাখ জনকে আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। তরুণদের উদ্ভাবন বিকাশে ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ৩৯টি হাই-টেক পার্ক নির্মাণের কার্যক্রম চলছে। ৬৪টি জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নির্মাণাধীন ৫টি হাই-টেক ও আইটি পার্কে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হওয়ায় এতে ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে এবং ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। ৯৬৪টি সরকারি সেবাকে ডিজিটাল সেবায় রূপান্তর করা হয়েছে। ব্লক চেইন, আইওটি, এআই, রোবোটিকস, বিগ ডেটার মতো ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে এবং এ লক্ষ্যে ২৭টি বিশেষায়িত ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। ২০৪১ সালের জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে ২০২৫ সালের মধ্যে শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সারাদেশের মোট ৪৯ হাজার ৪৮১টি মৌজার আরএস স্বত্বলিপি চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে এবং তা ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবপোর্টালে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে। দেশের মোট ৫১০টি উপজেলা ও সার্কেল ভূমি অফিসে ই-নামজারি চালু হয়েছে। ই-নামজারি চালু করায় সরকার গৌরবজনক ‘United Nations Public Service Award-2020’ এবং ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশনের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার-২০২০’ অর্জন করেছে।
অবশ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুফল পুরোপুরি নিশ্চিত করার প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জ দেখছেন অনেকে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের আপাত চ্যালেঞ্জগুলোগুলো হলো- শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর ও ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ উন্নয়ন, সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর ও জনগণের সব সেবা ডিজিটালকরণ ও তাদের হাতের নাগালে পৌঁছানো, শিল্প-বাণিজ্য তথা অর্থনীতির ডিজিটাল রূপান্তর, ডিজিটাল সংযুক্তি, ডিজিটাল জীবনধারা এবং বাংলাদেশকে জন্মের প্রতিজ্ঞায় স্থাপন করা।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জাগো নিউজকে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির সুবর্ণ যুগে বাস করছি আমরা। এখন দেশে প্রতিবছর এক লাখ কম্পিউটার বা ল্যাপটপের চাহিদা রয়েছে। করোনার সময় এ চাহিদা আরও বেড়েছে। প্রতিবছর ২৫ লাখ টিভি, ৩০ লাখ রেফ্রিজারেটর ও চার কোটি মোবাইল বিক্রি হয়। এসব পণ্য আমরা যদি দেশেই তৈরি করতে পারি তাহলে আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির প্রেসিডেন্ট শাহিদ-উল-মুনীর জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে আইসিটি খাতে খুব ভালো করেছে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেয়ার পর তরুণদের মধ্যে বেশ সাড়া পড়ে যায়। কোভিড-১৯ এর কারণে অনেক দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশের কারণে আমাদের অর্থনীতি সচল রয়েছে। করোনার সময় আমরা অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস, কেনাকাটা, ডাক্তারি পরামর্শ থেকে শুরু করে অনেক কিছু করতে পেরেছি। এজন্য শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের এ পলিসিগুলো প্রশংসিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ডিজিটাল কাজে ব্যবহারের জন্য ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ যেন সহজেই কিনতে পারে সেজন্য সরকার থেকে কিস্তির ব্যবস্থা করলে তার সুফল সবাই পাবে।
এইচএস/এসএইচএস/এইচএ/জেআইএম