স্মার্টফোন বিক্রি করার আগে সাবধান

শেখ আনোয়ার
শেখ আনোয়ার শেখ আনোয়ার , বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ০১:৫৬ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

নব-বিবাহিত এক ব্যক্তি তার বান্ধবীর কাছে স্মার্টফোনে মেসেজ পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু ধরা পড়েন তার স্ত্রীর কাছে। এ নিয়ে মানোমালিন্য। শেষ পর্যন্ত ছাড়াছাড়ি। বিরক্ত হয়ে সব নষ্টের গোড়া স্মার্টফোনটা অনলাইনে বিক্রি করে দেন সেই লোক। যিনি কেনেন তিনি জেনে গেলেন আগের মালিকের গোপন প্রেমের খবরাখবর!

তবে অনেক চেষ্টা করেও তিনি গোপন অভিসারের কথা গোপন রাখতে পারেননি। অথচ বিক্রির আগে তিনি মেমরি কার্ডসহ সব ডেটাই মুছে ফেলে ছিলেন। এমন কি সকল অ্যাপস ডিলিট করেও দিয়েছিলেন। তাহলে কীভাবে ঘটলো এই ঘটনা? এর জন্য দায়ী উচ্চ প্রযুক্তির ডেটা রিকভারিং অ্যাপস বা সফটওয়্যার।

ডিজিটাল যুগের কল্যাণে স্মার্টফোনের মতো কম্পিউটার যন্ত্রের এসব ‘অ্যাপস’ বা সফটওয়্যার এখন চাহিবা মাত্র হাতের মুঠোয় চলে আসতে বাধ্য। টাকা-পয়সা খরচ করতেও হয় না। স্মার্টফোনের প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করে নিলেই কাজ শেষ। একেবারে হাতের মুঠোয় এসে উপস্থিত যন্ত্রপাতি মেশিন। অথচ এসব অ্যাপস ধ্বংস করে দিতে পারে কারো ব্যক্তিগত জীবন।

আজকাল নতুন বা আরও দৃষ্টিনন্দন স্মার্টফোন সেট কেনার জন্য পুরোনো ফোনসেট বিক্রি করে থাকেন অনেকে। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, এটা অনেকটা নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরি হস্তান্তরের মতো। স্বাভাবিকভাবেই ব্যবহারকারী অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্য সংরক্ষণ করে রাখেন তার স্মার্টফানের মধ্যে। কিন্তু এসব মুছে ফেলা অতোটা সোজা কাজ না। যা ভাবছেন তার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন কাজ। স্মার্টফোন বিক্রির কথা মাথায় উঠলেই সবাই যে ব্যাপারটা সবার আগে ভাবেন তা হলো, এর সব ডেটা মুছে ফেলা। কিন্তু বিল্ট ইন বা প্লে স্টোরের ডাউনলোড করা অ্যাপস দিয়ে এই মুছে ফেলা তথ্য প্রায় পুরোটাই উদ্ধার করা এখন পান্তা ভাত।

ধরা যাক, ভার্জিনিয়ার কথা। সেদেশের এক নিরাপত্তা সেবা দানকারী সংস্থা (ট্রাস্ট ডিজিটাল) অনলাইন কেনাবেচা মাধ্যম থেকে দশটা বিভিন্ন মডেলের স্মার্টফোন কেনে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এসব স্মার্টফোনের নিরাপত্তার ব্যাপারে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা যায় কি না তা দেখা। স্মার্টফোনগুলোর প্রতিটি খুবই উচ্চ প্রযুক্তির এবং এগুলো করপোরেট ব্যবহারের জন্য এ সময়ের আধুনিক গুণগত উচ্চমান মান সম্পন্ন স্মার্টফোন।

ট্রাস্ট ডিজিটালের উৎসুক অ্যাপস ইঞ্জিনিয়াররা প্রতিটি স্মার্টফোন থেকে বলতে গেলে প্রায় সব তথ্যই পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এর মধ্যে একটিতে ছিল অবরুদ্ধ দুই প্রেমিক-প্রেমিকার তীব্র আবেগী কথোপকথন। অন্যগুলোতে যা পাওয়া যায় তার মধ্যে বহু কোটি ডলারের ফেডারেল পরিবহন কন্ট্রাক্ট প্রাপ্তির লক্ষ্যে একটি কোম্পানির পরিকল্পনা। পাওয়া যায় আরেকটি কোম্পানির ৫০ হাজার ডলারের সফটওয়্যার কেনার প্রদেয় বিল সংক্রান্ত ই-মেইল। ছিল অনেকগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের গোপন পাসওয়ার্ড ইত্যাদি। এভাবে নিলামে কেনা পুরোনো সেলফোন থেকে ২৭ হাজার পৃষ্ঠা পর্যন্ত ডেটা পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে।

প্রিন্টের পর স্তূপ হওয়া কাগজের উচ্চতা হয় আট ফুট। দেখা গেছে, বিক্রি হওয়া অধিকাংশ ফোনের ব্যবহার ব্যক্তিগত। অথবা বহু গুরুত্বপূর্ণ গোপন করপোরেট তথ্যে সেগুলো ঠাসা। অনেকেই হয়তো সময় বাঁচাতে ব্যক্তিগত স্মার্টফোনে এসব তথ্য সেভ করে রাখেন। কিন্তু স্মার্টফোন বিক্রির সঙ্গে এসব তথ্য যে পাচার হয়ে যায় সেই খবর তারা রাখেন না।

ট্রাস্ট ডিজিটালের কেনা এক ফোনে পাওয়া যায় সিলিকন ভ্যালির এক তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর যাবতীয় গোপন তথ্য। এসব তথ্যের মধ্যে আরেকটি কোম্পানির সঙ্গে ভবিষ্যৎ চুক্তির বিস্তারিত গোপনীয় বিষয়াদী উল্লেখ ছিল। সে সঙ্গে ছিল সম্ভাব্য একজন জাপানি অংশীদারের সঙ্গে বিনিময় করা ই-মেইল। ট্রাস্ট ডিজিটালের অনুমান প্রধান নির্বাহী সেই কর্মকর্তা তার পুরোনো ফোনটা দিয়েছিলেন পরিচিত সাবেক রুমমেটকে। তিনি কিছুদিন এটা ব্যবহারের পর ৪০০ ডলারে বিক্রি করে দেন। এক্সপার্টরা এ ফোন থেকে একেবারে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত দু’ পক্ষের চালাচালি করা আইডি মেইলগুলো উদ্ধার করতে সক্ষম হন।

পুরোনো স্মার্টফোন বদলানো খুবই স্বাভাবিক বিষয়। স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক কোম্পানির দোলাচালে এখন মুক্ত বাজার অর্থনীতির হাওয়া লেগেছে। ৮ জিবি র্যাম এখন প্রযুক্তি বাজারে পান্তা ভাত। ডিজিটাল গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে প্রতি ১৮ মাসে ব্যবহারকারী তার স্মার্টফোন বদলায়। আরও উন্নত মডেলের, আপডেট ভার্সন আরেকটি নতুন স্মার্টফোন কেনেন। এরপর পুরোনোটা ছুঁড়ে ফেলে দেন অব্যবহৃত বস্তুর মতো। কিংবা ভালোবেসে কাউকে দান করে দেন। আবার নানান কারণে হারিয়েও ফেলেন কেউ কেউ।

অথচ ভেবে দেখেছেন কি সেখানে থেকে গেছে বন্ধু আত্মীয় স্বজনের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ফোন নম্বর। এসব নম্বরের কারণে প্রতারিত হতে পারেন আপনি আমি এবং যে কেউ। ট্রাস্ট ডিজিটালের কেনা সবগুলো ফোনই শীর্ষস্থানীয় প্রস্তুতকারকদের এবং সর্বশেষ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ। এসব ফোনে তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা ফ্ল্যাশ মেমোরি চিপের মধ্যে। যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় পকেট কম্পিউটার, ডিজিটাল ক্যামেরা তথা সংগীতের অডিও ভিডিওর যাবতীয় ন্যানো যন্ত্রপাতিতে। এসব কিছু ঠাসা থাকে স্মার্টফোনে। আর কে না জানে ফ্ল্যাশ মেমোরির কথা। রাস্তাঘাটে ফুটপাতের হকারের কাছেও পাওয়া যায়। যেমনই সস্তা তেমনি টেকসই। স্মার্টফোনের চিপ, মাদারবোর্ড, মেমরি কার্ড নষ্ট হওয়ার কথা বলা হলেও মনে রাখা দরকার, এটি থেকে স্থায়ী তথ্য মুছে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত মন্থর।

অবশ্য স্মার্টফোন প্রস্তুকারকরা নিরাপদে তথ্য মুছে ফেলার নির্দেশনা স্মার্টফোনের প্যাকেটের সঙ্গে সরবরাহকৃত কাগজপত্র দিয়ে থাকেন ক্রেতাদের। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, এ নির্দেশনা অনুসরণ করা জটিল হওয়ায় কেউ আর এসব ঝামেলায় যেতে চান না। অন্যদিকে দেখা গেছে, চীন, কানাডা, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ইত্যাদি জনপ্রিয় স্মার্টফোন কোম্পানিগুলো এ নির্দেশনা সেবা দিতে তারা তাদের ওয়েবসাইট, অ্যাপস ইত্যাদির কথা বলে থাকেন।

কিন্তু ক্রেতার পক্ষে তা খুঁজে বের করা বেশ কষ্টকর। সেখানে বলা থাকে, আপনার এই স্মার্টফোনটা একেবারে তথ্যমুক্ত করতে চাইলে ফোনের পেছনের একটা বাটনে চাপ রাখা অবস্থায় একই সঙ্গে আরও তিনটা বাটনে চাপ দিতে হবে ইত্যাদি। তার মানে কী! কাজটা করতে হবে একই সঙ্গে দু’জন মানুষকে। তাই ট্রাস্ট ডিজিটালের প্রধান টেকনিক্যাল অফিসার নর্ম লডারমিলস পুরোনো স্মার্টফোন বিক্রির ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। এগুলো হ্যাকার বা চোরের হাতে পড়লে কী অবস্থা দাঁড়াতে পারে কল্পনা করা যায়?

এরপরও কেউ কেউ হয়তো বলবেন-আরে ধুর! যখন বিক্রি করবো, তখন স্মার্টফোনের সব ডেটা মুছে ফেলবো! কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত রেকর্ড বা অপরাধের প্রমাণ মুছে ফেলা অতো কী সোজা? এমন ভাবার কোনো কারণই নেই। তাই সাবধান! আপনার বিরুদ্ধে বড় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য হয়তো আপনার স্মার্টফোনটাই প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।

কেএসকে/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।