শরণার্থী মোকাবিলায় ব্যর্থ মানবতা
মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের লড়াই এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় এ বছর ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ব নেতারা। শরণার্থীদের প্রতি মানবিক সাড়া দিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য গত জুনে বিশ্ব নেতাদের তীব্র সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শরণার্থী সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সংস্থাটির মহাসচিব সলিল শেঠি সে সময় বলেন, এ যাবৎ কালের সবচেয়ে ভয়াবহ শরণার্থী সংকটের মুখোমুখি আমরা। লাখ লাখ আশ্রয়হীন নারী-পুরুষ এবং শিশু, যারা প্রাণঘাতী যুদ্ধের মধ্যে বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই করেছে। মানব পাচারকারি চক্র এবং বিভিন্ন দেশের সরকার মৌলিক মানবিক দিকটি বিবেচনা করার পরিবর্তে স্বার্থপরের মতো নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থটুকুই শুধু হাসিল করে চলেছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে ৪০ লাখ মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এসব শরণার্থীর ৯৫ শতাংশকে আশ্রয় দিয়েছে প্রতিবেশি দেশগুলো। সিরিয়ার অভ্যন্তরেই ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। গত কয়েক দশকে এটাই সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। বর্তমানে লেবাননের প্রতি ৫ জনে একজন সিরিয়ায় শরণার্থী। গত বছরের তুলনায় এ বছর দেশটিতে শরণার্থী প্রবেশের সংখ্যা ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ ও সহিংসতা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
শুধু সিরিয়া থেকে নয়, শরণার্থীর ঢল নেমেছে ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ থেকেও। শরণার্থী সংস্থার তথ্য মতে, চলতি বছরের এপ্রিলে বুরুন্ডিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর থেকে ৬২ হাজার বুরুন্ডিয়ান পার্শ্ববর্তী তানজানিয়া, ৪৫ হাজার রুয়ান্ডায়, ডিআর কঙ্গোয় ১০ হাজার ৯শ’ ৯০ জন, ৮ হাজার ৮৫৫ জন উগান্ডায় ও ৪০০ জন জাম্বিয়ায় শরণার্থী হিসেবে নাম লিখেছে। এসব শরণার্থীদের অধিকাংশের গন্তব্য ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ইউরোপের দেশগুলোও শরণার্থীদের আশ্রয় ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
কয়েকটি দেশ শরণার্থীর স্রোত ঠেকাতে বন্ধ করে দেয় সীমান্ত। ফলে কঠিন সংকটের মুখে পড়ে শরণার্থীরা। জাতিসংঘ শরণার্থীদের জরুরি চাহিদা পূরণে তহবিল চেয়ে বারবার আবেদন জানালেও আন্তর্জাতিক মহলের কাছ থেকে তেমন কোনো সাড়া দেখা যায়নি। ইউরোপে আসা আশ্রয়প্রার্থী মানুষজনের কোথায় জায়গা মিলবে, কতজনের আশ্রয় মিলবে আর কোন দেশ কতজনকে নেবে সেসব নিয়ে এখন ইউরোপের দেশগুলো বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা আলোচনা শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি। হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্র বাধ্যতামূলক কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করছে। কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে হাঙ্গেরি। শুরুতে অষ্ট্রিয়া ও ক্রোয়েশিয়া শরণার্থীদের স্বাগত জানালেও শেষ পর্যন্ত তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়।
পরিস্থিতি চিত্র তুলে ধরে সার্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভিচা দাখিচ বলেন, পুরো ইউরোপের ওপর যেন এক লোহার পর্দা জেঁকে বসেছে। দাখিচ বলেন, ইউরোপ সীমানাবিহীন এক মুক্ত অঞ্চল হওয়ার কথা থাকলেও সদস্য রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সঙ্গে সীমানা বন্ধে মেতে উঠেছে।
ইউরোপের ২২টি দেশের জন্য বাধ্যতামূলক শরণার্থী আশ্রয় দেয়ার সংখ্যা বেঁধে দেওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে তাতে ফ্রান্স বা জার্মানির মতো বড় দেশগুলো সায় দিচ্ছে। শরণার্থীদের পুনর্বাসনে জার্মানি একটি নতুন প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। জার্মানি বলছে, তুরস্কের ক্যাম্প থেকে সরাসরি সিরিয়ার শরণার্থীদের নিয়ে আসবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তবে এ প্রস্তাব নিয়ে ইইউর অন্যান্য দেশগুলোর প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। শরণার্থী ইস্যুতে বিভক্ত ইউরোপের দেশগুলোতে ২০১৫ সালে অন্তত ১০ লাখ শরণার্থী প্রবেশ করেছে।
এসআইএস/পিআর