দুর্গা ও ঢাকেশ্বরী
ছেলেটির সঙ্গে দেখা পলাশিতে। বড় আদবের সঙ্গে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বললো, আমাকে চিনতে পেরেছেন- আমি ‘অমুকের’ বন্ধু। আমার এক নিকটাত্মীয়র নাম বললো। তার বন্ধু হতেই পারে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাকে চিনতে হবে কেন সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমার বডি ল্যাংগুয়েজেও এই প্রশ্ন প্রকাশ পাচ্ছিল হয়তো। সহায়তার জন্য এগিয়ে এসে বললো, ‘আপনি আমাকে আরতী নাচে প্রথম পুরস্কার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।’ তাজ্জব ঘটনা। অনেক পুরোনো কাহিনী। ২০০৩ সালের। আর এই ছেলে নিজের একটি মুসলমান নাম বলছে। আরতী নৃত্য প্রতিযোগিতায় হিন্দু ছেলেরা অংশ নেয়।
সে এবার আরও খোলাসা করে বললো, সে হিন্দু নাম ধারণ করে দুর্গা পূজার সময় আরতী নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। আমার স্পষ্ট মনে পড়লো ঘটনাটি। হালকা পাতলা একটা বালক। মুখে, দু’ হাতে ধূপ জ্বালানোর পাত্র নিয়ে কত বিচিত্র ভঙ্গিমা করে দেবীর আরাধনা করে নেচেছিল ছেলেটি। রাত ১০টার কম হবে না। আমি দূর থেকে নৃত্য দেখছিলাম ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। পরনে রাতের শোয়ার ট্রাউজার। গলায় মাফলার। পাড়ায় দুর্গা দেখতে প্রতি বছর যেভাবে গেছি সে রকম বেশভূষণই আমার। হঠাৎ মাইকে আমার নাম ঘোষণা হল। কিছু বিশেষণ দিয়ে। মঞ্চে গিয়ে বসার জন্য। আমাকে নাকি আরতী নৃত্য প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের পুরস্কার দিতে হবে।
যিনি ঘোষণা দিলেন বা দেওয়ালেন তিনি স্বপন সাহা। মহানগর পূজা কমিটির নেতা আবার জাতীয় প্রেস ক্লাবেরও নেতা। আমি কিছুটা লজ্জিত অতিথির পোষাকে নেই বলে। কিছুটা লজ্জিত এতো বড় অনার দেওয়ার জন্যও। ইরাক যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য কিছু লোকে নাম জানে কিন্তু অতটা আশা করে আসিনি বলেই ড্রেস আগের মতোই আছে। এই ঢাকেশ্বরীর পাশে আজিমপুর কলনীতে আমার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেক বছর কেটেছে। এরপর পলাশি ফায়ার ব্রিগেডের পাশে বাসা নিয়ে কাটিয়েছি সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় দশ বছর।
যে সময়ের কথা বলছি তখনও পলাশিতে আমার ভাড়া বাসা। চারপাশের অনেকেই পরিচিত। এমনকি ঢাকেশ্বরী মন্দির এলাকায় যারা বাস করে তারাও অনেকে চেনে। মন্দিরের বামে অনেক ধোপার বাসা। তার একজন আমাদের বাসা থেকে কাপড় এনে পরিষ্কার করে দিয়ে যেত। অনেকটা আমাদের গ্রামের বাড়ির ধোপাদের মতো। এখানে ওরা কাপড় দিয়ে আসার সময় টাকা নিয়ে আসে। গ্রামের ধোপারা বাড়ির কাপড় নিয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে যেত আর বছর শেষে ধান নিত। আমি সন্দিহান বাংলাদেশের কোনো গ্রামে এই সিস্টেম এখন আর প্রচলিত আছে কিনা। জানি না ঢাকেশ্বরীর পাশের ধোপরাও আর এই কাজ করে কিনা।
ঢাকেশ্বরীর কিছু বাসিন্দা আমাকে আরও একটি কারণে চেনে। ১৯৯০ সালে এরশাদ আমলে এই মন্দিরটি পুড়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। আমি তখনও সাংবাদিক। দুপুর বেলা কলোনিতে ফিরে দেখি পাশ দিয়ে জেহাদি মিছিল যাচ্ছে। বেশির ভাগ দাড়িঅলা, টুপি পরা মাদ্রাসার ছেলে। জিজ্ঞেস করলাম কই যাও? একজন উত্তেজিত হয়ে বললো, কেন আজ ইনকিলাব পড়েননি? আরেকজন জানান দিল ঢাকেশ্বরী। আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি। ইনকিলাব পত্রিকায় ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে (তখনও ধ্বংস হয়নি) এমন একটি উস্কানিমূলক রিপোর্ট ছাপা হয়েছে সেদিন। এই জেহাদি দল ঢাকেশ্বরী মন্দির ধ্বংস করতে যাচ্ছে। দৌঁড়ে বাসায় গিয়ে আমার ছোট ক্যামেরাটা নিলাম পকেটে। সাদা কালো ফিল্ম ভরা ছিল।
দৌড়ে স্পটে যেতে যেতে দেখি ভাংচুর, আগুন লাগানো সারা। মূল মন্দিরের পেছনের বাড়িটাতে থাকতেন কিছু লোক। পাকা বাড়ি ছিল। দরজার সামনে অসুস্থ একজন বুড়িমা চোখে মুখে আতংক নিয়ে তখনও বসা। ওই ঘরের পাশে আরেকটা ছনের ঘর আছে তাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি একের পর এক ছবি তুলছিলাম। যারা আগুন দিচ্ছে তারা মোল্লা জাতীয় কেউ নয়, পাড়ার মাস্তান জাতীয় ছেলেরা। দু’ একজনকে চিনিও। লালবাগের ছেলে। আমাদের কলোনিতে (পলাশি ও এতিমখানার মাঝের সরকারি কলোনি, মৌচাক নামেই পরিচিত) এসে আড্ডা মারে। দাউ দাউ আগুন জ্বলছে, তার সামনে হাতে রাম দা, ছুরি নিয়ে কয়েকজন যুবক- এমন একটি ছবি তুলতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়ি। ক্যামেরা কেড়ে নিতে চায় দু’জন। বন্ধুস্থানীয়রা সহায়তার জন্য এগিয়ে আসে। প্রতিশ্রুতি দিতে হয় তাদের চেহারা দেখানো হবে না।
যাক, খবর পেয়ে ঢাকার সব মিডিয়ার সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গিয়েছিলেন কিন্তু মন্দিরের আশে পাশেও কেউ যেতে পারেননি। কয়েকজনের ক্যামেরা কেড়ে নেওয়া হয়। একমাত্র ‘ভাগ্যবান’ সাংবাদিক হিসেবে আমার ছবি সে দিন রয়টার্স কিনে নিয়ে প্রচার করে, যদিও আমি ফটোগ্রাফার না। শুনেছি সাদা-কাল ওই ছবি (তখন পত্রিকা সাদা কালই ছিল) বহির্বিশ্বের অনেক দেশের পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। আমি কিছু ছবি মন্দিরের কাউকে যেন পরে তাদের প্রকাশনার জন্য দিয়েছিলামও। সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’-এ আমার এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে ছবিগুলো প্রকাশ পেলে ঢাকার অনেক সাপ্তাহিক পত্রিকাতেও এসেছিল তখন।
ইনকিলাব জঘন্য কাজটিতে উস্কানি দিয়েছিল সত্য তবে মূল ইন্ধন এখানে ছিল স্থানীয় জাতীয় পার্টির এমপি ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতের লোকদের। তারাই পোড়ানোর কাজে অংশ নিয়েছে। ভাংচুর করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তখনকার এরশাদ বিরোধী চরম আন্দোলকে অন্যদিকে ধাবিত করা। পরদিন জেনারেল এরশাদ সেখানে গিয়ে মায়া কান্না করে আসেন। হাসনাত সঙ্গে ছিলেন। ছিলেন যারা পোড়ানোয় অংশ নিয়েছে এমন ছেলেরাও। ক্ষমতা বদল হলে হাসনাত পরে বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। সেই চেনা, অতি পরিচিত ঢাকেশ্বরী মন্দিরে অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে আরতী নৃ্ত্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিতরণ শেষ করলাম। বিচারকরাও ছিলেন আমাদের সঙ্গে।
সেদিনের আরতী নৃত্য বিজয়ী ছেলেটির সঙ্গে নতুন করে পরিচয়ের পর যেমন বিস্মিত হয়েছিলাম তেমনি তার কুসংস্কারমুক্ত জীবন দেখে মুগ্ধও হয়েছিলাম। আমার জীবনে যে কত শখ ছিল দুর্গার সামনে ধূপ নিয়ে এমন একটি নৃত্য কেমন হয় পরীক্ষা করে দেখার, সেটা হয়নি কখনো। কাউকে কোনও দিন বলতেও পারিনি। সেটি দেবীকে খুশি করার জন্য নয়, নৃত্যটার মধ্যে একটা ছন্দময় মাদকতা আছে। আর এই ছেলেটি সেটিতো করেছেই বাড়তি হিসেবে পুরস্কারও ছিনিয়ে নিয়েছে। ছোটকালে আমাদের গ্রামে আমার ক্লাসমেট অপূর্ব যখন দুর্গার সামনে ধীর লয়ের বাজনার তালে তালে দেবীর সামনে আরতী নাচতো আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম। কখনো কখনো নাচতে গিয়ে তাদের হাতে থাকা অনেকগুলো ধূপদানির কোনটি থেকে জ্বলন্ত কয়লা পড়ে যেত। তারা সেটাকে উপেক্ষা করেও নাচতো। ঢাক ঢোলের এই নাচের মধ্যে একটা নেশা আছে। হুস ঠিক রাখা কঠিন।
কুসংস্কার আমাদের সমাজে এতো প্রবল ছিল যে আগে আমাদের গ্রামে দেখেছি হিন্দুরা মুসলমানের ছোঁয়া কোন জিনিস খেত না। দুষ্ট ছেলেরা কলসী ছুঁয়ে দিলে কলসী কাঁধে নেওয়া মেয়েটি বা বউটি মাটির কলসটি ভেঙে ফেলতো। সবচেয়ে বেশি দেখতাম বারুণী বা বৈশাখী মেলা থেকে ফেরার পথে ছেলেদের কাণ্ড। হিন্দু মেয়েরা মিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার কিনে নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরতো মুসলমান ছেলেরা জাস্ট হাত দিয়ে বাক্স ছুঁয়ে দিলেই হল। মেয়েরা সেটা রাস্তায় রেখে চলে যেত আর ছেলেরা তা মজা করে খেত। সেইসব বোকা মেয়ে বোধ হয় এখন আর নেই। ছোঁয়াছোয়ির কুসংস্কারও নেই বললেই চলে।
এখন কোথাও কোথাও মূর্তি ভাঙার মতো অসুস্থতা লক্ষ করা যায় বটে কিন্তু আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিমরা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সংস্কারমুক্ত এবং অন্ধত্বমুক্ত। হৃদ্যতাও তাদের কমেনি। বরং বেড়েছে। পরস্পরের অনুষ্ঠানে মোটামুটি ভেদাভেদ না করেই তারা যোগ দিচ্ছেন।
কথা হচ্ছিল কলাবাগান মাঠে আয়োজিত পূজা মাঠের স্বেচ্ছাসেবক রোহিত বর্ধনের সঙ্গে। সে গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র। পূজোয় মুসলমানদের অংশগ্রহণ কেমন লাগে জানতে চাইলে বলে, ‘ভালইতো। আমরাওতো যাই তাদের ঈদের অনুষ্ঠানে। অবশ্য কুরবানী ঈদে বাসা থেকে যেতে দেয় না।’ বলার অপেক্ষা রাখে না গরু নিয়ে হিন্দুদের বাড়াবাড়ি রকম কুসংস্কার দু’ সম্প্রদায়ের বন্ধনে একটা সীমান্তরেখা টেনে রেখেছে। ভারতে গরু নিয়েতো এখন রীতিমত হানাহানি চলছে। বাংলাদেশে কুরবানী ঈদে বেশির ভাগ হিন্দু বন্ধুকে দাওয়াত দেওয়া হয় না বা তারাও দাওয়াতে আসেন না। তবে রমজানের ঈদে সমস্যা হয় না। ইফতার পার্টিতো বলা যায় এখন সার্বজনীন পার্টি। অবশ্য আমার কিছু কিছু হিন্দু সহকর্মী আবার কুরবানিতেই ফোন করে দাওয়াত নেয়। সেগুলোকে হিসাবে ধরা ঠিক হবে না।
বাঙালি হিন্দুদের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা এ অঞ্চলে দু’ সম্প্রদায়ের মধ্যে হৃদ্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। সেকালে মাইকে গান শোনা, আরতী নৃত্যই ছিল মণ্ডপে মণ্ডপে দেবী দেখতে যাওয়ার প্রধান উপলক্ষ্য। বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান অনেকে দ্বিধাহীনভাবে যেত। একালে যোগ হয়েছে মণ্ডপে বড় বড় শিল্পিদের গভীর রাত পর্যন্ত নাচ গান। ভিডিও ওয়ালের মাধ্যমে তার প্রদর্শনী। এখনও মুসলমানরা সবাই যায় বলা যাবে না, তবে অনেকেই যায় উৎসবে যোগ দিতে। ধর্ম বিশ্বাস যার যার একান্ত। উৎসবটা সবার হোক।
আমার কাছে দুর্গা পূজার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে মানুষের মিলনমেলা। আনন্দ-গানের পাশাপাশি খাওয়া দাওয়া। মিষ্টি জাতীয় পণ্য কেনা। দুর্গার সৌন্দর্যের চেয়ে আমি মানুষের সৌন্দর্য দেখি পূজার মণ্ডপে মণ্ডপে। প্রতিদিন সুন্দর সুন্দর পোষাক পরে, সবচেয়ে আকর্ষণীয় সাজটি দিয়ে তরুণ-তরুণীরা যায়, শিশুরা যায় সেখানে। বয়স্করাও সাজ সজ্জায় পিছিয়ে থাকে না। এক দিন নয়, দুদিন নয়- টানা ৫টি দিন, নির্দিষ্টস্থানে মিলিত হয় সবাই। পৃথিবীর বুকে বাঙালির দুর্গা পূজোর মতো এতো দীর্ঘদিনের, এতো বর্ণাঢ্য অন্য কোনও ফেস্টিভ্যাল আছে কিনা আমার জানা নেই- যেখানে ধর্মও আছে সার্বজনীনতাও আছে অনেকাংশে।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
[email protected]
এইচআর/পিআর