যেখানে ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ দর্শক
* আসন্ন বিপিএলে অংশ নেয়ার জন্য ক্রিকেট দুনিয়া জুড়েই সাজ সাজ রব। এরই মধ্যে এ আসরে অংশ নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে প্রায় দুশোর মত বিদেশি ক্রিকেটার।
*অনূর্ধ-১৯ টি২০ বিশ্বকাপ নিয়ে কেটে গেছে অনিশ্চয়তা। এই যুব বিশ্বকাপের আয়োজক থাকছে বাংলাদেশই।
* ভারত -পাকিস্তানকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ আয়োজক হওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের সামনে।
* পশ্চিম বাংলা অনূর্ধ-১৭ দল খেলছে বাংলাদেশে।
* আগামী ২০ তারিখ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে শেখ কামাল ফুটবল টুর্নামেন্ট। এই আসরে অংশ নিচ্ছে ভারতের ঐতিহ্যবাহী ইস্ট বেঙ্গল মোহামেডান ছাড়াও উপমহাদেশের সেরা ক্লাবগুলো।
ঠিক এমন সময়ে এত সব ক্রীড়া আয়োজন, যখন বাংলাদেশের ওপর চলছে এক ধরনের ‘আন্তর্জাতিক ক্রীড়া অবরোধ’। বাংলাদেশ সফর স্থগিত করেছে অস্ট্রেলিয়া। পরপরই একই কারণে (নিরাপত্তা ঝুঁকি) বাংলাদেশ সফরে আসেনি দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দল।
বিত্তের সঙ্গে চিত্তের লড়াই চিরন্তন। পেশাদারিত্বের চূড়ায় থাকা বিশ্ব ব্যবস্থায় বিত্তের জয়জয়কার হবে এটাকেই শিরোধার্য জ্ঞান করে সবাই। বিত্তের মাপকাঠিতেই মূল্যায়ন করা হয় সব কিছুকেই। ঠিক এরকম একটা সময়ে গোলটা বাঁধিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকটেপ্রেমী সর্বোপরি বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা। একটু পেছনে যাওয়া যাক। বাংলাদেশ তখনো টেস্ট স্ট্যাটাসসমৃদ্ধ হয়নি। ১৯৯৮ এর মিনি বিশ্বকাপখ্যাত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। টেস্ট স্ট্যাটসের দল না বিধায় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ওই প্রথম আসরে খেলার সুযোগ পায়নি আয়োজক বাংলাদেশ। এর মাত্র বছর খানেক আগে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে টাইগাররা। আয়োজক অথচ শুধুই দর্শক। দেশবাসীর ভীষণ মন খারাপ। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরু হতেই দেখা গেল অভাবনীয় দৃশ্য! সব দুঃখ ভুলে ঢল নামলো দর্শকের।
ওই আসরের একটা ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা-দক্ষিণ আফ্রিকা। দিবা/রাত্রির ওই ম্যাচে বৃষ্টি হল অনেকটা সময়। খেলা বন্ধ থাকল বেশ কয়েখ ঘণ্টা। ৪/৫ ঘণ্টা পর খেলার উপযুক্ত হল মাঠ। খেলা যখন শেষ হল তখন প্রায় মধ্যরাত। তখনো মাঠে উপস্থিত বেশ কয়েক হাজার দর্শক। খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়েও খেলা উপভোগ করেছে দর্শকরা। এই ক্রিকেট প্রেমকে কি বিত্তের মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করা সম্ভব? ২০১১ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত আয়োজক হওয়ার গৌরব অর্জন করল বাংলাদেশ। ওই বিশ্বকাপে টিকিট নিয়ে যা ঘটল সেটা আর নতুন করে না বললেও চলে। টিকেটের আশায় আগের রাত থেকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে সব বয়সের মানুষ। ১৬ ঘণ্টা /২০ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষের টিকিট সংগ্রহ করার এই বাংলাদেশকে যেন নতুন করে দেখল বিশ্ববাসী।
ক্রিকেট বিশ্বে সার্বজনীন উৎসবের প্রতীক বাংলাদেশ। ক্রিকেটপ্রেমী হিসাবে বিশেষ খ্যাতি আছে ভারতীয় দর্শকদেরও। তবে স্পোর্টসম্যানশিপের পরীক্ষায় ভারতীয় দর্শকরা কতখানি উত্তীর্ণ সে প্রশ্নটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়। দলকে হারতে দেখলে প্রায়শই খেপে ওঠে ভারতীয় দর্শকরা। গ্যালারি থেকে মাঠের মধ্যে বোতল, জুতা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে মাঝে মধ্যেই। দর্শকদের উন্মত্ততায় বিশ্বকাপের ম্যাচও শেষ হতে পারেনি, এমনটা ঘটেছে ক্রীড়া প্রেমের তীর্থভূমি বিবেচিত ইডেন গার্ডেনেও। মাঠের ভেতরে খেলার পরিবেশ তথা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হয় আয়োজক ভারতকে। সম্প্রতি এমন অক্রিকেটীয় ঘটনা দেখল ক্রিকেট বিশ্ব। কটকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দ্বিতীয় টি২০ ম্যাচ হারের মুখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন ভারতীয় দর্শকরা। মাঠে ক্রিকেটীয় পরিবেশ বজায় রাখা সর্বোপরি মাঠের নিরাপত্তায় দর্শকদের ভূমিকাকে অস্বীকার করার জো নাই। আর এই পরীক্ষায় সবার জন্যই অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের দর্শকরা।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় সঙ্কট নিরাপত্তা ঝুঁকি। নিরাপত্তাহীনতা গ্লোবাল ইস্যু। এর জন্য কম খেসারত দিতে হচ্ছে না স্পোর্টসকেও। কিন্তু এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজনীতি কিংবা কূটনীতির যে খেলা সেটাও চলে এসেছে সামনে। অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ সফর স্থগিত করার কথাই ধরা যাক না। বাংলাদেশ সফর বাতিল করাটা যতটা সহজ হয়েছে ভারত সফর বাতিল করাটা অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সম্ভব ছিল না সম্প্রতি এমন কথা বলেছেন অস্ট্রেলিয়া কিংবদন্তির ক্রিকেটার ইয়ান চ্যাপেল। নিরাপত্তা ঝুঁকি যতই থাকুক না কেন, ভারত সফরে আসতেই হত অস্ট্রেলিয়াকে এমনটাই মনে করছেন চ্যাপেল। ভারত সফর বাতিল করা যে সহজ নয় এমনটা আমরা আগেও দেখেছি।
২০০১ সালের শেষ দিকে ভারত সফরে এসেছিল ইংল্যান্ড। ওই সফরের আগে বড় ধরনের বোমা হামলার ঘটনা ঘটে ভারতে। এ অবস্থায় নাক উঁচু ইংলিশরা ভারত সফর করবে কি-না তা নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। এদিকে ভারতের নিরাপত্তা শংকা নিয়ে একটার পর একটা রিপোর্ট করে চলেছে ইংলিশ মিডিয়া। এই সফরের বিপক্ষে কথা বলছেন সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটাররা। ওই সময় বিসিসিআই (ভারত ক্রিকেট বোর্ড) প্রেসিডেন্ট ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অকৃত্তিম বন্ধু জগমোহন ডালমিয়া। ইংলিশ মিডিয়ার নর্তন- কুর্দন দেখে ডালমিয়া দিলেন পাল্টা হুমকি- Either show up or shut up (হয় আসো নয় মুখ বন্ধ কর)। ডালমিয়ার এক হুমকিতেই চুপসে গেল ইংলিশরা। সুড় সুড় করে ভারত সফরে আসল নাসির হোসেনের নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ড। অংশ নিল নির্ধারিত তিন টেস্টের সিরিজেই। টাকা থাকলে যে নিরাপত্তা কেনা যায়, আছে এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ।
টাকা ও শক্তিশালি ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের বাইরে ভিন্ন এক লড়াই বাংলাদেশের। এ লড়াইয়ে বাংলাদেশের সবেেচয় বড় পুঁজিটাই ক্রিকেট প্রেম। বিশ্ব সেরা ক্রিকেটাররা প্রদর্শন করবে তাদের সৌকর্য আর তা প্রাণ ভরে উপভোগ করবে এদেশের দর্শকরা, আর ভালোবাসার মঞ্চে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ নেবে টাইগাররা। এর চেয়ে ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন আর কি হতে পারে? বাংলাদেশে কোন একটা বড় আসর বসলে, টাইগারদের কারও সিরিজ সেরা হওয়ার সম্ভাবনা (অবশ্য এশিয়া কাপে একবার সিরিজ সেরা হয়েছিলেন সাকিব আল হাসান) নাও থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিটা আসরেই এদেশের দর্শকরা যে ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ তা নিয়ে কোন সংশয়ই নাই।
শরৎচন্দ্রের নারী চরিত্র চিত্রণ সম্পর্কে বলা হয় ‘দুঃখের আগুনে পোড়া খাঁটি সোনা।’ বাংলাদেশ ক্রিকেটকে একইভাবে বলা যায়- ‘হৃদয়ের তাপে-ভাঁপে পোড়া খাঁটি সোনা’।
এইচআর/পিআর