তোয়ালে শিল্পের সাতকাহন
গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বালীগাঁও, খঞ্জনা, ভাদগাতি, বড়নগর, চৌড়া, উত্তরগাঁও, ছয়গাতি, জুগলী, ধোলাসাধুখাঁ, বাহাদুরসাদী, ঈশ্বরপুর গ্রামের অর্ধ-শতাধিক মালিকের ৩ শতাধিক বিদ্যুৎচালিত পাওয়ার লোম রয়েছে। আর এই সকল পাওয়ার লোমে স্থানীয় এবং আশপাশের উপজেলার কয়েক হাজার শ্রমিক তোয়ালে বুননের কাজ করে থাকে।
মালিক পক্ষ বলছে, অত্যন্ত লাভজনক এই শিল্পটি দক্ষ শ্রমিক আর বিদ্যুতের কারণে অলাভজনক খাতে পরিণত হচ্ছে। আর শ্রমিকরা বলছে এই তোয়ালে শিল্পের মাধ্যমে মালিক লাভবান হলেও উপযুক্ত মজুরি, পাওয়ার লোমের পরিবেশ ভালো না থাকায় অনেকেই এ শিল্প ছেড়ে অন্যত্র কাজ করছে। তাই পরস্পর বিরোধী এমন বক্তব্যের পর তোয়ালে শিল্পের ভবিষৎ নিয়ে অনেকেই সন্ধিহান। শেষ পর্যন্ত উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি টিকে থাকবে তো?
খঞ্জনা গ্রামের মৃত করম আলীর ছেলে রবিউল ইসলাম (৩৫) দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ ধরে জড়িত আছেন এই তোয়ালে শিল্পের সঙ্গে। বর্তমানে কাজ করছেন খঞ্জনা গ্রামের জালাল উদ্দিন মালিকানাধীন কেয়া টেক্সটাইলে। এখানে তার মতো আরো ১৮/২০ জন কাজ করে। আগে শ্রমিক স্যংখ্যা আরো বেশি ছিল। কিন্তু তোয়ালে কারখানার পরিবেশ ও মজুরি বৃদ্ধি না করায় তারা অন্যত্র কাজ নিয়ে চলে গেছেন।
তিনি আরো বলেন, এই তোয়ালে শিল্পের সঙ্গে এত সময় ধরে কাজ করলেও এখন পর্যন্ত নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে কিছুই করতে পারিনি। আর অধিকার আদায়ে স্থানীয়ভাবে শ্রমিকদের কোনো সংগঠন না থাকায় মালিক পক্ষ সে সুযোগ নিচ্ছে। বিগত চার বছর আগে সাইজ অনুযায়ী ১ টাকা মজুরি বৃদ্ধি হলেও এরপর মজুরি আর বাড়েনি। এই তোয়ালে শিল্পের মালিকরা লাভবান হলেও শ্রমিকরা মরছে অর্ধাহারে-অনাহারে।
তিনি আরো জানান, আসন্ন ঈদ-উল-আযহার পর শ্রমিকদের একত্রিত করে সংগঠন তৈরি করবে। আর সেই সংগঠনের ব্যানারে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামবে তারা। প্রয়োজনে সকল শ্রমিক কর্ম বিরতির কথাও জানান তিনি।
কেয়া টেক্সটাইলে কর্মরত একই গ্রামের আদেল (২৮) জানান, বিদ্যুৎ ঠিক মতো থাকলে ১২ ঘণ্টায় দৈনিক সাড়ে তিনশ থেকে পৌনে চারশ টাকার কাজ করা যায়। বিদ্যুতের সমস্যা থাকলে দেড়শ থেকে দুইশ টাকা এমনকি কোনো দিন শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। সাইজ এবং কোয়ালিটি অনুযায়ী বিভিন্ন তোয়ালের মজুরি প্রদান করা হয়।
এই টেক্সটাইলে নারী শ্রমিক হারিছা (২৪) জানায়, মেশিনে সেলাই করলে ডজন প্রতি বড় তোয়ালে ১০ টাকা ও ছোট তোয়ালে ৫ টাকা মজুরি প্রদান করা হয়।
টেক্সটাইলে আরেক শ্রমিক ভাদগাতি গ্রামের সাত্তার (৪০) বলেন, প্রতিদিন বিকট শব্দে এবং ধূলা ভর্তি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। মালিকরা অন্য লোক দিয়ে ওই সব ধূলা পরিষ্কার করার কথা থাকলেও খরচ বাড়ার চিন্তায় তারা তা করছে না। ফলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। তবে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে স্থানীয় কোনো তোয়ালে কারখানায় নেই অগ্নি নির্বাপণের কোনো যন্ত্র।
একই টেক্সটাইলে অন্য শ্রমিক খঞ্জনা গ্রামের মাহবুব (২৮), রুহুল আমিন (২৯), দেওয়ালেরটেক গ্রামের শাহ আলম ও নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মনির হোসেনও (৫০) মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানান।
বড়নগর গ্রামের আফসার উদ্দিন মালিকানাধীন আফসার টেক্সটাইলে কর্মরত একই গ্রামের রুহুল আমিন (৪০) জানান, প্রতি ১৫ দিন অন্তর কাজের মজুরি বাবদ দেড় হাজার থেকে ষোলশ টাকা পাওয়া যায়। দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজ করে যে মজুরু পায় তা দিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর। তাই অভাবের কারণে লেখাপড়া বাদ দিয়ে অল্প বয়সের দুই ছেলে মাসুম ও শাকিলকে কাজে দিয়েছি।
একই গ্রামের সাফির উদ্দিন মালিকানাধীন আলমগীর টেক্সটাইলে কর্মরত ভাদগাতি গ্রামের মো. জনি মিয়া জানান, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সে এই তোয়ালে শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে তারা যে মজুরি পায় তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না।
বড়নগর গ্রামের মুজিবুর রহমানের বাড়ীতে তোয়ালে শিল্পের হ্যান্ডলুম মেশিনটি পরিচালনা করেন একই গ্রামের ষাটোর্ধ শামসুর রহমান। তিনি দীর্ঘ দু’যুগেরও বেশি সময় ধরে এ পেশার সাথে জড়িত আছেন। শুরু থেকেই হস্থ চালিত হ্যান্ডলুম মেশিনটি পরিচালনা করছেন। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এ মেশিনটি আজ হারিয়ে যাচ্ছে। তাই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া তোয়ালে শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট এ হস্থ চালিত হ্যান্ডলুম মেশিনটি টিকিয়ে রাখা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
কালীগঞ্জ উপজেলা পাওয়ার লোম মালিক বহুমূখি সমবায় সমিতির সদস্য ও তোয়ালে ব্যবসায়ী মো. সাফির উদ্দিন জানান, বর্তমানে তোয়ালে শিল্পের অবস্থায় খুবই খারাপ। এ শিল্পে হাতে গোনা কয়েকজনের অবস্থা ভালো হলেও অনেকের অবস্থাই খারাপ হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, শেখেরচর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ভৈরবসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে তোয়ালে নিয়ে গেলে অনেক সময় মূল্য কম পাওয়া যায়। তা যদি ফেরৎ নিয়ে আসি তাহলে পরিবহন খরচ দ্বিগুণ হয়। তাই কম দামেই বিক্রি করতে হয়। এ জন্য আমরা শ্রমিকদের তাদের যথাযথ মজুরিও দিতে পারি না। তাছাড়া কালীগঞ্জে নতুন নতুন কল-কারখানা হওয়ার কারণে বেশি মজুরি পাওয়ায় তারা ওদিকেই বেশি ঝুঁকছে। ফলে দক্ষ শ্রমিকের অভাবে আমাদের উৎপাদন কমে গেছে। এজন্য আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও তোয়ালে ব্যবসায়ী মো. রুহুল আমিন জানান, বাংলাদেশের মধ্যে কালীগঞ্জ উপজেলাটি তোয়ালে শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা। নানা প্রতিকূলতায় বহুবিদ সমস্যার কারণে লাভজনক এই শিল্পটি ধ্বংসের পথে। কিন্তু বংশ পরম্পরায় চলে আসা এই তোয়ালে শিল্প চাইলেই বাদ দিতে পারছি না। কারণ এই তোয়ালে শিল্প আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। তাছাড়া চাইলেই আমরা এখন অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবো না।
সমিতির সভাপতি ও তোয়ালে ব্যবসায়ী মো. মোস্তফা মিয়া জানান, সুতার দাম নাগালের মধ্যে থাকলেও রং, শ্রমিকের মজুরি, বুনন ও পরিবহন খরচসহ প্রতিটি কাজ করতেই অর্থের প্রয়োজন। এ কারণে এ পেশার সম্প্রসারণ নয় বরং সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। এ পেশার উৎকর্ষতা ধরে রাখার জন্য সরকার যে ঋণ চালু রেখেছে তার সুফলও আবার প্রকৃত পেশাজীবিরা পাচ্ছে না। তাই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রকৃত পেশাজীবীদের মধ্যে এর সুফল নিশ্চিত করতে হবে।
আব্দুর রহমান আরমান/এসএস