দ্রুতগতির নৌযান নিয়ে বরিশালবাসীর মিশ্র প্রতিক্রিয়া
সময় বাঁচিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ঢাকা-বরিশাল নদী পথে চালু হয়েছে দ্রুতগতির অত্যাধুনিক নৌযান এমভি গ্রীন লাইন-২ ও এমভি গ্রীন লাইন-৩ নামের দুটি ওয়াটার ওয়েজ ।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার সদরঘাটে নৌ পরিবহন মন্ত্রী মো. শাজাহান খান এই নৌযান দুটির উদ্বোধন করেন।
আর বরিশাল লঞ্চ ঘাট থেকে এই নৌযান দুটির উদ্ধোধন করা হয় বুধবার বিকেলে।
তবে ঢাকা-বরিশাল নদী পথে নৌযান দুটি যাত্রী পরিবহন শুরু করবে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে।
সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই নৌযানে দুই শ্রেণির আসন রয়েছে। ইকোনোমি শ্রেণির জন্য যাত্রী প্রতি ভাড়া ৭শ এবং বিজনেস শ্রেণির জন্য ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার টাকা। এই ভাড়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে নদী পথের যাত্রীদের মধ্যে।
নিম্ন আয়ের সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, এই দ্রুত গতির নৌ-যানে তাদের যাতায়াতের ইচ্ছে থাকলেও ভাড়া তাদের সাধ্যের বাইরে। লঞ্চে দুইশ টাকা ভাড়া দিয়ে ঢাকায় যাওয়া যায়। কিন্ত এর ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা । এই ভাড়া তাদের নাগালের বাইরে বলে জানান, নিম্ন আয়ের সাধারণ যাত্রীরা।
ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত বরিশাল সদর উপজেলার রোজিনা বেগম ও তার স্বামী জহির জানান, ওগুলো আমাদের জন্য নয়। ওগুলো বড়লোকদের জন্য। যা বেতন পাই তা দিয়ে লঞ্চের ২০০ টাকা ভাড়া দিতেই কষ্ট হয়। এতে শখ করে যাতায়াত করাও তাদের সাধ্যের বাইরে বলে জানান, এই দম্পতি ।
লঞ্চের নিয়মিত যাত্রী নগরীর মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী মো. মানিক জানান, মালামাল কিনতে তাকে নিয়মিত ঢাকায় যাওয়া আসা করতে হয়। দ্রুত গতির এই নৌ-যানের কারণে সময় বাঁচবে। তবে ভাড়া কিছুটা কম হলে সুবিধা হতো বলে তিনি জানান।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আহসান হাবিব কামাল জানান, বর্তমানে বরিশাল ঢাকা রুটে ১৪টি লঞ্চ চলাচল করছে। কিন্তু তার পরেও নৌভ্রমণে অভ্যস্থ এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ কমছে না। কতিপয় লঞ্চ মালিকদের রোটেশন প্রথার নামে যাত্রীদের বিরম্বনার ফাঁদ দক্ষিণাঞ্চলবাসীর গলার কাটা হয়ে গেথে আছে। পর্যাপ্ত লঞ্চ ব্যবস্থা থাকা সত্বেও বরিশাল এবং ঢাকা নৌবন্দর থেকে প্রতিদিন হাতে গোনা ২/৩টি লঞ্চ যাত্রী পারাপার করছে। যে কারণে প্রথম শ্রেণির কেবিন পাওয়া দুরুহ হয়ে দাড়িয়েছে যাত্রীদের জন্য। তাই এই নৌ-যান দুটি কেবিনের যাত্রীদের জন্য দুর্ভোগ কমাবে এবং ব্যবসায়ীদের সময় বাঁচাবে। ভাড়া একটু কমালে সাধারণ যাত্রীরাও সমানভাবে এর সুফল পাবে বলে জানান মেয়র কামাল।
বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য জেবুন্নেছা আফরোজ এ উদ্যোগের প্রশংসা করে জানান, এতে এ অঞ্চলের মানুষ দিনের বেলায়ও নদী পথে যানজট মুক্ত পরিবেশে ঢাকায় যাওয়া-আসা করতে পারবে। নদী পথে দিনের বেলায় চলার কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও কম থাকবে। রাতের চেয়ে দিনের এই যাত্রা যাত্রীদের জন্য অনেক নিরাপদ হবে। এছাড়া সৌখিন যাত্রীরা এ যাত্রায় দিনের বেলা প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
তবে এমভি গ্রীন লাইন ওয়াটার ওয়েজের কর্তৃপক্ষকে ভাড়া কমাতে তিনি অনুরোধ করেছেন।
বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, পদ্মাসেতু চালু হলে সড়ক পথে বরিশাল থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগবে সাড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। তাই প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে বরিশাল-ঢাকা নৌপথে দ্রুত গতির নৌযানের বিকল্প নেই। তাই ঢাকা-বরিশাল নদী পথে এ ধরনের দ্রুত গতির নৌ-যানের প্রয়োজন ছিল। এটা সময় উপযোগী একটি পদক্ষেপ। তবে সময়সূচি মেনে নৌযান দুটি নিয়মিত যাত্রীদের সঠিকভাবে সেবা দিচ্ছে কিনা সেটাই দেখার ব্যাপার।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশালের সভাপতি প্রফেসর এম. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বরিশাল-ঢাকা রুটের নৌযাত্রীরা দীর্ঘদিন ধরে লঞ্চ মালিকদের রোটেশন প্রথার কাছে জিন্মি রয়েছে। নতুন এই নৌযান চালু হলে যাত্রীরা জিন্মিদশা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে।
গ্রীন লাইন ওয়াটার ওয়েজ বরিশালের ইনচার্জ মো. বাদশা মিয়া জানান, নৌযান দুটির ভেতরের আসন বিন্যাস অবিকল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের মতো। ওয়াটার ওয়েজ দুটি বরিশাল-ঢাকা রুটে পরীক্ষামূলকভাবে চলাচল করেছে। এখন যাত্রী পরিবহনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে।
তিনি জানান, নির্ধারিত ভাড়ার মধ্যেই রয়েছে যাত্রীদের আপ্যায়নের (খাবার) ব্যবস্থা। প্রতিদিন সকাল ৮টায় এবং বিকেল ৩টায় ওয়াটার ওয়েজ দুটি ঢাকা এবং বরিশাল প্রান্ত থেকে যাত্রী পরিবহন করবে।
মো. বাদশা মিয়া জানান, বরিশালে কোম্পানির প্রধান কার্যালয় করা হয়েছে নগরীর ব্যস্ততম কাকলীর মোড়ে। এছাড়া যাত্রী সাধারণের টিকেট প্রাপ্তির সুবিধার্থে নগরীর নথুল্লাবাদ ইয়াকুব মার্কেট, প্যার্যারা রোড মীর মার্কেট এবং দক্ষিণ সদর রোড (এরিনা হোটেলের বিপরীতে) বুকিং এবং টিকেটিং অফিস করা হয়েছে। এরই মধ্যে অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান।
গ্রীন লাইন ওয়াটার ওয়েজ কোম্পানির কর্মকর্তা মো. রিপন হোসেন জানান, উড়োজাহাজের আদলে নির্মিত প্রতিটি ওয়াটার ওয়েজ প্রায় ৬শ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। যাত্রীদের জন্য রয়েছে আরামদায়ক আসনের ব্যবস্থা। দুর্ঘটনা এড়াতে নৌযান দুটির নিচের অংশে ডবল বটম (দুই স্থরের তলদেশ) আর উপরের অংশে ফাইবার ব্যবহার করা হয়েছে। অনাকাঙ্খিত কারণে নৌযান উল্টে কিংবা কাত হয়ে গেলেও তা পানির উপর ভাসবে। অন্যান্য নৌযানের মতো নিমজ্জিত কিংবা নদীর তলদেশে চলে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। নৌযান দুটি নির্মাণে ১৫ কোটি টাকার (একেকটি প্রায় সাড়ে ৭ কোটি) বেশি ব্যয় হয়েছে বলে তিনি জানান।
ভাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যান দুটি দ্রুত গতির হওয়ায় প্রচুর জ্বালানির খরচ হয়। তাই আয় ব্যয়ের সমঞ্জস্য রেখেই ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ’র বরিশালের যুগ্ম পরিচালক (বন্দর) মো. মোস্তাাফিজুর রহমান জানান, অত্যাধুনিক নৌযান দুটির উদ্বোধন ও যাত্রী পরিবহনের জন্য কেন্দ্রীয় দফতর থেকে রুট পারমিট পেয়েছে। ঈদের আগে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে অত্যাধুনিক এই নৌযান দুটি চালু হলে যাত্রীদের সুবিধা হবে।
এসএএস/আরআইপি