আমার কবিতাভাবনা


প্রকাশিত: ০৫:৪২ এএম, ০৪ আগস্ট ২০১৫

যেদিন থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেছি; অনুভব করেছি, খাওয়াপরার মতো কেউ একজন এ দায়িত্ব আমার উপর আগেই দিয়ে রেখেছে। সেই থেকে যা কিছুই ঘটে, যা কিছুই করি-দেখি-বলি তার অনিবার্য কিছুকে সুন্দরের অর্ঘ্য পরিয়ে সুনির্বাচিত শব্দে উপস্থাপনের তাড়না তৈরি হয়েই চলেছে। যা থেকে সামান্য বিচ্যুত হলে, নিজের অস্তিত্ব হাতড়াতে হিমশিম খাই।   

ওবায়েদ আকাশ-এর ৪টি কবিতা

উচ্ছৃঙ্খল ঘড়ি

ঘুমন্ত মায়েদের মধ্যে বড় হচ্ছে শিশুদের হাত-পা-মগজ
জীবিত মায়েদের মধ্যে বড় হচ্ছে স্বপ্নের হাত-পা-মগজ

বুনো কালো হাতির দাঁত থেকে গড়ে উঠেছে এই অনন্য রাজবাড়ি
যার প্রতিটি কক্ষের নিচে- কৃষি সমাবেশে
শেখানো হচ্ছে উপাসনাগৃহের নানান পদ্ধতি, আর কোথাও
জানলা ভেঙে উপচেপড়া মেঘে, সাঁতারের সমূহ কলা

প্রকাণ্ড কাঠবিড়ালি তার লেজ থেকে ছুড়ে মারছে
মানুষের শিকারের গূঢ় অভিলাষ। আর ঘুমন্ত পাতাদের ওপর
উড়ে উড়ে নিশ্চিন্ত করছে পাখিদের ভবিষ্যৎ জীবন

সূর্যের সুখ্যাতি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে প্রকাণ্ড হাতির পাল
তাদের হারানো দাঁত ও নির্বিঘ্ন বাঁচার দাবিতে
কলাপাতায় মোড়ানো হচ্ছে ভবিষ্য যুদ্ধের সাহস

কচি সবুজ আকাশের দিকে মানুষের দৃষ্টি পড়ে আছে
উড়ন্ত আকাশ কেটে কেটে নির্মিত হচ্ছে চাঁদমুখ
                                সভ্যতার উচ্ছৃঙ্খল ঘড়ি

গাছের গভীরে

গাছের ভেতর উঁকি দিলে
তোমার মুখ পাতায় ঢেকে যায়

তোমার কিছু করণীয় থেকে
প্রতিটি পাতার দীর্ঘশ্বাস বিবেচনা করে থাকি

আর ভাবি একদিন শুকিয়ে যাওয়া সমুদ্রের বাসিন্দা
আজ কী করে নিরেট বৃক্ষবাসী হলে

বৃক্ষদের বাকলের নিচে ঘুমিয়েছে অপার পৃথিবী
শীত ঋতুর নামে যা শুধু সংগোপন লুকিয়ে রেখেছ

আর ভুখানাঙা জলাশয়ে ভরে গেছে হলুদ পত্রালি
আজ তার গভীরে শুয়ে সুনিপুণ দীর্ঘশ্বাস শেখো

চাও বা না চাও, চারিদিকে
গৃহগুলো শীতের আগুনে পুড়ছে
গাছের গভীরে ঢুকে মায়াকাননের চাঁদ
তোমার মুখ ইতিউতি করে খুঁজছে

আর প্রতিবার ঘুমিয়ে গেলে
পৃথিবীর নিভৃতি সকল
উলটে-পালটে দেখছে তোমার মায়া
 
আমার বলতে

চরাঞ্চল জুড়ে একা একা আছড়ে পড়ত
                       পদ্মা যমুনার ঢেউ

আমার নিজস্ব ঘরবাড়ি, প্রতিবেশি মানুষের মুখে
                        ভয়ে ভয়ে রক্ত উঠে যেত

ক’দিন মাত্র পর আমি মধ্য পদ্মার ভেতর একমাত্র
আশ্রয়ের খুঁটি আঁকড়ে ধরে
প্রবল স্রোতে কাঁপতে কাঁপতে জেনেছি:
আমার বলতে আজ পৃথিবীতে অনেক কিছুরই জন্ম হয়েছে
এতদিন যা স্ত্রী, সন্তান, ভাইবেরাদরে সীমাবদ্ধ ছিল

এই স্রোতে তারাও তো কোথাও
আশ্রয়ের খুঁটি আঁকড়ে ধরে আমার মতোই নতুন আনন্দে নাচছে

এই পৃথিবীর তাবৎ ভূ-সম্পত্তি- খ্যাত অখ্যাত
প্রিয় পরিজনের অতিথি আজ তারা

শুধু আমি ছাড়া এই পদ্মা এই যমুনা তাদের
হারানো পৃথিবী ফিরিয়ে দিয়েছে

শুধু একটু আধটু কৌতূহলী যারা- ভাঙনের চাঙড় ঠেলে
লুকিয়েচুরিয়ে দেখছে আমার মুখ

প্রশ্ন উত্থিত হচ্ছে

তোমার দিকে তেড়ে আসছে বুনো বিছুটির শ্বাস
যারা তোমার নিজের হৃৎপিণ্ডের ভেতর পালানোর ব্যাপারটি
একপ্রকার নিশ্চিত করেছে, বলা যায়

এবার তুমি চাঁদের রন্ধনশালায়- তোমার প্রিয় হাঁসের স্নায়ু
কাঁঠালের ঘ্রাণ- নিশ্চিন্তে রান্না করে চেখে নিতে পারো

নির্ধারিত কলঙ্কের ওপর চড়িয়ে দিতে পারো
তোমার দুরন্ত নৌযান

জলের প্রশ্রয় থেকে মাছেদের প্রস্থান প্রশ্নে
সামুদ্রিক আইনের ভাষায় ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা চলছে
ষড়যন্ত্রের শেষে সুগন্ধি ফোয়ারার মুখ

ফোয়ারার প্রতিটি বুদ্বুদ থেকে প্রশ্ন উত্থিত হচ্ছে-
কে কেন পালাতে চায়- প্রিয় মুখ, রক্তকরবী ছিঁড়ে


লেখক পরিচিতি :
ওবায়েদ আকাশের জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৩ জুন, বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার সুলতানপুর গ্রামে। একাডেমিক পড়াশোনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশা সাংবাদিকতা। বর্তমানে দেশের ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ‘দৈনিক সংবাদ’-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :
পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ (বর্তমান সময়, ২০০১), নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ (মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৩), দুরারোগ্য বাড়ি (মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৪), কুয়াশা উড়ালো যারা (বিশাকা, ২০০৫), পাতাল নির্মাণের প্রণালী (আগামী, ২০০৬), তারপরে, তারকার হাসি (আগামী, ২০০৭), শীতের প্রকার (বৃক্ষ, ২০০৮), বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা (শুদ্ধস্বর, ২০০৯), যা কিছু সবুজ, সঙ্কেতময় (ইত্যাদি, ২০১০), প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায় (ইত্যাদি, ২০১১), রঙ করা দুঃখের তাঁবু (ইত্যাদি, ২০১২), বিবিধ জন্মের মাছরাঙা (দীর্ঘ কবিতার সংকলন, ইত্যাদি, ২০১৩), তৃতীয় লিঙ্গ (দীর্ঘ কবিতার সংকলন, শুদ্ধস্বর, ২০১৩), উদ্ধারকৃত মুখমণ্ডল (বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত নির্বাচিত কাব্য সংকলন, ২০১৩), হাসপাতাল থেকে ফিরে (কলকাতা, উদার আকাশ, ২০১৪), ৯৯ নতুন কবিতা (ইত্যাদি, ২০১৪)।

অনুবাদ :
‘ফরাসি কবিতার একাল / কথারা কোনোই প্রতিশ্রুতি বহন করে না’ (ফরাসি কবিতার অনুবাদ, জনান্তিক, ২০০৯) 
‘জাপানি প্রেমের কবিতা/ এমন কাউকে ভালবাস যে তোমাকে বাসে না’ (জাপানি প্রেমের কবিতা, জনান্তিক, ২০১৪) 

গদ্যগ্রন্থ :
‘ঘাসের রেস্তরাঁ’ (বৃক্ষ, ২০০৮) ও ‘লতাপাতার শৃঙ্খলা’ (ধ্রুবপদ, ২০১২), চারদিকে উদ্যানের সৌরভ (ধ্রুবপদ, গল্পগ্রন্থ, ২০১৪)।

সম্পাদনা গ্রন্থ :
‘দুই বাংলার নব্বইয়ের দশকের নির্বাচিত কবিতা’ (শিখা, ২০১২)।
সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন : শালুক (১৯৯৯-)

পুরষ্কার ও সম্মাননা:
‘শীতের প্রকার’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম শ্রেষ্ঠ তরুণ কবি পুরষ্কার ২০০৮’;
‘শালুক’ সম্পাদনার জন্য ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার ২০০৯’।
এবং সামগ্রিক কাজের জন্য লন্ডন থেকে ‘সংহতি বিশেষ সম্মাননা পদক ২০১২’। 

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।