দাদাগিরি যখন বাউন্ডারির বাইরে


প্রকাশিত: ০২:১২ এএম, ২৮ মে ২০১৫

ক্রিকেটে ভারতের দাদাগিরি নিয়ে নতুন করে আর বলার কিছুই নাই। সর্বশেষ বিশ্বকাপ ফাইনালে ট্রফি দেয়ার সময় নিয়ম ভেঙে আইসিসি প্রেসিডেন্টকে উঠতে দেয়া হয়নি মঞ্চেই। আইসিসির সংবিধান লঙ্ঘনকেও গ্রাহ্যের মধ্যে নেননি আইসিসির প্রভাবশালী ভারতীয় কর্মকর্তা শ্রীনিবাসন। নিয়ম ভেঙে আইসিসির সভাপতির বদলে বিশ্বকাপ ফাইনালের ট্রফি তুলে দিয়েছেন শ্রীনিবাসন নিজেই।

দেড় দশকেরও বেশি সময়  ধরে টেস্ট ক্রিকেট খেলছে বাংলাদেশ। ক্রিকেট বিশ্বের সব প্রতিষ্ঠিত দেশেই টেস্ট সিরিজ খেলেছে টাইগাররা। কিন্তু আজ অবধি ভারতের মাটিতে টেস্ট সিরিজ খেলার সৌভাগ্য হয়নি বাংলাদেশের। তবে এবারের বাংলাদেশ সফরের আগে সব দাদাগিরি বাউন্ডারি সীমানার বাইরে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছে ভারত। বাংলাদেশ সফরে তারা আসছে পূর্ণ শক্তির দল নিয়েই।

বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স এবং সম্প্রতি পাকিস্তানকে তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করা  বাংলাদেশকে সমীহ না করে আর কোনো পথই খোলা নাই ক্রিকেটের মোড়ল ভারতের সামনে। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের এই যে বদলে যাওয়া মানসিকতা এটা অনুধাবন করার জন্য প্রয়োজন পড়ে না বিশেষজ্ঞ হওয়ার। বিশ্বকাপের আগের কথাই ধরা যাক না। গত বছর জুন মাসে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে বাংলাদেশ সফরে আসে ভারত। ওই সফরে সেরা একাদশের প্রায় কাউকেই পাঠায়নি ভারতীয় টিম ম্যানেজম্যান্ট। নিয়মিত অধিনায়ক মহেন্দ্র ধোনি, বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, মোহাম্মদ সামি, রবিচন্দ্র অশ্বিনদের ছাড়াই ওই সিরিজ খেলেছে দলটি। বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের বদলে যাওয়ার মানসিকতার আরেকটি উদাহরণ সম্প্রতি স্টার স্পোর্টসের বিজ্ঞাপন।
 
স্বভাবতই এবারে বাংলাদেশ সফরকে ভারত কিভাবে নিচ্ছে বড় হয়ে ওঠে এই প্রশ্নটা।  ভারত দল ঘোষণার আগেই বেশ কিছু খবর আসা শুরু করল মিডিয়াতে। কোহলি, ধোনিসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটার বাংলাদেশ সফরে না আসার জন্য আবেদন করলেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাছে। গত ৬/৭ মাস (অস্ট্রেলিয়া সফর, বিশ্বকাপ এবং আইপিএল) ধরে টানা ক্রিকেট খেলে ক্লান্ত ভারতের সিনিয়র ক্রিকেটাররা বিশ্রামের কথা বলে এড়াতে চাইলেন বাংলাদেশ সফর। ধোনি , কোহলিরা কিছু চাইবেন আর সেটা হবে না এটা একটা বিরল ঘটনা! খেলা চলাকালীন গার্লফ্রেন্ড আণুশকাকে নিয়ে ড্রেসিংরুমে আড্ডা দেয়ার মত ঔদ্ধত্যও দেখাতে পারেন কোহলি। এত বড় ঘটনার পরও মিডিয়াতে কিছু সমালোচনা ছাড়া আর কিছুই হয়নি কোহলির। এমন যে কোহলি তার চাওয়াও থেকে গেল অপূর্ণ। বাংলাদেশ সফরে আসতেই  হচ্ছে তাকে। এটা নিশ্চয়ই এমনি এমনি ঘটেনি। বাংলাদেশ সফর যে মোটেও সহজ হবে না এটা খুব ভালোভাবেই আঁচ করতে পেরেছে ভারতীয় ক্রিকেট কর্ণধাররা। এই সফর নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই পূর্ণ শক্তির দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরের যাওয়ার কথা বলে আসছেন ভারতীয় ক্রিকেটের ফাদার ফিগার সুনীল গাভাস্কর। এই বাংলাদেশকে হারানো খুবই কঠিন হবে প্রায় নিয়মিতভাবে এমন কথা বলে আসছেন  সাবেক ভারত অধিনায়ক গাভাস্কর।  একই সুর প্রতিধ্বনিত  হয়েছে ভারত ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সফল অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীর কণ্ঠেও। সব মিলিয়ে চরম বাস্তবতার কাছে কোহলিদের আবদার আর ধোপে টেকেনি।

এবারের বাংলাদেশ সফর নিয়ে ভারত কতটা সিরিয়াস সেটা অনুধাবন করা যায় তাদের হোমওয়ার্ক দেখেই। বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচকে সামনে রেখে তারা ফিরিয়ে এনেছে ডানহাতি অফ স্পিনার হরভজন সিংকে। ২০১৩ সালের পর থেকে দলের বাইরে ৪১১ টেস্ট শিকারী এই বোলার। দু`বছর পর হরভজন সিংকে টেস্ট দলে ফেরানো প্রসঙ্গে ভারতীয় এক্সপার্টদের ভাষ্য,  বাংলাদেশে বাহাতি ব্যাটসম্যানদের সংখ্যা অনেক। এই বাহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে হরভজনের ভালো করার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাহাতি  স্পিনারের চেয়ে ডানহাতি হরভজন বাংলাদেশের বাহাতিদের বেশি সমস্যায় ফেরতে পারবে, এভাবেই হিসাব কষেছে ভারতীয় টিম ম্যানেজম্যান্ট। বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম শক্তি ভারতীয়দের যে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে এটা তারই এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের বদলে যাওয়ার মানসিকতার আরেকটি উদাহরণ সম্প্রতি স্টার স্পোর্টসে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপন। এখন আর নাবালক নয় বাংলাদেশ ক্রিকেট, সাবালক হয়ে উঠেছে- এই সফরকে সামনে রেখে এমন বিজ্ঞাপন চিত্র প্রচার করছে স্টার স্পোর্টস। এর আগে ভারতীয় মিডিয়ায় হয় চরমভাবে উপেক্ষিত ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট অথবা নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে । শুধু স্টার স্পোর্টসের বিজ্ঞাপন নয়, ভারতের সব মিডিয়াতেই খুবই ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে।

বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল ভারতের। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে জগমোহন ডালমিয়া। কিন্তু এসময়ে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ যে মর্যাদা পাচ্ছে তা আগে কল্পনাও করা সম্ভব ছিল না। বিশ্বকাপ ইস্যুকে কেন্দ্র করে শ্রীনিবাসনদের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করল বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে ক্রিকেট সম্পর্কের অবনতি নিয়ে উঠল অনেক কথাই। কিন্তু কোনো কিছুরই প্রভাব পড়েনি। গত মাসে পশ্চিমবঙ্গ সফরকারী বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৭ দলকে এক প্রীতি ভোজে আপ্যায়িত করে দুদেশের  ক্রিকেট সম্পর্কের শক্ত গাঁথুনির কথাই যেন সবাইকে জানিয়ে দিলেন আবারও ভারত ক্রিকেট বোর্ড প্রধানের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়া ডালমিয়া। এখানেই শেষ নয়। শ্রীনিবাসনের কারণে আইসিসি সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করা আ হ ম মোস্তফা কামালকে আমন্ত্রণ জানানো হলো আইপিএল ফাইনাল খেলা দেখার।
 
ক্রিকেটে গ্লোবালাইজেশনের স্বপ্নদ্রষ্টা ডালমিয়া, এভাবে বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। আর  বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে যে ক্রিকেট গ্লোবালাইজেশন সম্ভব না এটা খুব ভালোভাবেই জানে ক্রিকেট অন্তপ্রাণ মানুষেরা। গত কয়েকটা বছর উপমহাদেশ ক্রিকেটের জন্য ছিল একটা অস্থির সময়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সন্ত্রাসী তৎপরতা উপমহাদেশে ক্রিকেট তথা বিশ্ব ক্রিকেটকেই ঠেলে দেয় হুমকির মুখে। ঠিক এরকম একটা অস্থির সময়ে পরপর দুটো এশিয়া কাপ আয়োজন ছাড়াও টি২০ বিশ্বকাপের সফল আয়োজক বাংলাদেশ। গত বছর টি২০ বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচের সময় প্রায় সব ভারতীয় সাংবাদিকই , বাংলাদেশের এই সফল আয়োজন নিয়ে প্রসংশায় ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। অনেকেই বলেন, এই সময়ে এত বড় আয়োজন এত সুন্দরভাবে সম্পূর্ণ করা ভারতের পক্ষেও সম্ভব ছিল না।
 
সব কথার এক কথা, ক্রিকেট আয়োজনের দিক থেকে বাংলাদেশকে দূরে ঠেলতে পারে এমন সাধ্য কারও নাই। আয়োজনের সামর্থ্যের সঙে ময়দানী দক্ষতা যদি একই সমান্তরালে থাকে  তাহলে আর যাই হোক বাংলাদেশের ওপর কারও দাদাগিরিই খাটবে না। বিশ্বকাপ ও বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠের লড়াই দিয়েই সব দাদাগিরিই বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন মাশরাফি মর্তুজা- মুশফিকুর রহিমরা।



এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।