অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাস
স্থবিরতা কাটেনি ক্রীড়াঙ্গনের, সহসাই কিছু ফেডারেশনে নতুন সভাপতি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্বে এসেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে দেশের কঙ্কাল চেহারা। দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের কাছাকাছি।
আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, অর্থনীতি থেকে শুরু করে ক্রীড়াঙ্গন- সবকিছুই বিপর্যস্ত। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সব কাঠামোই হয়ে পড়েছে ভঙ্গুর। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত নতুন সরকার সবকিছু পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। এক কথায় দেশ সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে।
প্রথম এক মাসে কেমন করলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তার কাঁটাছেড়া শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার শুরু হলেও এখনো স্থবির হয়ে আছে ক্রীড়াঙ্গন।
জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন থেকেই বন্ধ আছে ঘরোয়া সব খেলাধুলা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছু অংশগ্রহণ আছে। যেমন, জাতীয় ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর, জাতীয় ফুটবল দলের ভুটান সফর, নারী ক্রিকেট দলের শ্রীলংকা সফর, জাতীয় দাবা দলের অম্পিয়াডে অংশ নিতে হাঙ্গোরি সফর, স্কোয়াশ দলের নেপাল এবং অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবল দলের নেপাল থেকে সাফ শিরোপা এনে দেওয়া।
এ ছাড়া দেশে আর কোনো খেলাই এখন নেই দৃশ্যপটে। দীর্ঘ ১৬ বছর রাজনীতিতে আবদ্ধ করা হয়েছিল ক্রীড়াঙ্গন। আওয়ামী রাজনীতির ছত্রছায়ায় যারা ক্রীড়াঙ্গনে দাপট দেখিয়েছেন, যারা দুর্নীতি করেছেন সরকারের পতনের পরই তাদের কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন, অনেকে মামলার আসামী হয়েছেন, অনেক গা ঢাকা দিয়েছেন। কেউ বিদেশে পালিয়েছেন, কেউ কেউ ঘাপটি মেরে আছেন অজ্ঞাত স্থানে। সবকিছু মিলিয়ে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ছে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলো। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের খেলাধুলায়।
যে সব ফেডারেশনের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সিডিউল আছে, ঘরোয়া খেলার সূচি আছে- তাদের বেশিরভাগই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে। ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের আর্থিক বিষয়গুলো নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ দৈনন্দিন কাজের জন্য ব্যাংক থেকে টাকাও তুলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা অনুপস্থিত থাকায়। অনেক ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে আসা-যাওয়াই বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু আছে তালাবদ্ধ। হাতে গোনা কিছু ফেডারেশনের বাতি জ্বললেও গাল-গল্প করেই চলে যাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ক্রীড়া সংস্থা ও মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন অ্যাডহক কমিটি গঠণের নির্দেশ দিয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। ক্রীড়াঙ্গন কিভাবে সংস্কার করা যায় ক্রীড়া সাংবাদিকদের কাছ থেকে তার মতামত নিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের লক্ষ্যে তৈরি সার্চ কমিটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। ক্রীড়া প্রশাসন প্রত্যাশা করছে সময়মতো সার্চ কমিটি তাদের সুপারিশমালা দিলে নতুন করে ক্রীড়াঙ্গন ঢেলে সাজাতে পারবে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে-বেশিরভাগ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনে অভিভাবকশূন্যতায় খেলাধুলায় স্থবিরতা তৈরি হওয়া। হকি দলের জার্মান সফর বাতিল, ঢাকা থেকে কমনওয়েলথ কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপ সরে যাওয়া মিলিয়ে ঘরোয়া আসরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়াও হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত।
ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি পরিবর্তন হয়েছে নাজমুল হাসান পাপনের পদত্যাগের পর। কিন্তু যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় তিনটি ফেডারেশনের সভাপতি অপসারণ করলেও সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়নি নতুন কাউকে।
বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সভাপতি পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ও সাধারণ সম্পাদক ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান দু’জনকেই সরিয়ে দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সভাপতি পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমদকে এবং বাংলাদেশ ব্রিজ ফেডারেশনের সভাপতি সাবেক আমলা জাহাঙ্গীর আলমকে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় তিনজন সভাপতি ও একজন সাধারণ সম্পাদককে অপসারণ করায় ওই জায়গাগুলো শূন্য হয়ে আছে।
বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ অ্যাডভোকেট আবদুর রকিব মন্টু, যুগ্ম সম্পাদক সারাফাত হোসেন, বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকটি ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির কয়েকজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করলেও তা অফিসিয়ালি জানা নেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। কারণ, সবাই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন নিজ নিজ ফেডারেশনে।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ফুটবল ও ক্রিকেট ছাড়া বাকি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোর সভাপতি মনোনয়ন দেয়া। সভাপতি সরিয়ে দেওয়ার এখতিয়ারও এই মন্ত্রণালয়ের। আগস্টের মাঝামাঝিতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মাধ্যমে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোর সভাপতিদের অবস্থানের প্রতিবেদন জমা নিয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই মন্ত্রণালয় সভাপতি পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, ‘সভাপতি নিয়োগের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের। কাউকে নিয়োগ দেওয়া, কাউকে সরিয়ে দেওয়া সবকিছুর এখতিয়ার মন্ত্রণালয়ের। সার্চ কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া এবং তার ভিত্তিতে ক্রীড়াঙ্গনে পুরোপুরি সংস্কার সময় সাপেক্ষ। তাই পদ শূন্য হওয়া, গ্রেফতার হওয়া, অনুপস্থিত থাকা, নিস্ক্রিয় ও আত্মগোপনে থাকা সভাপতিদের জায়গায় নতুন সভাপতি নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে মন্ত্রণালয়। সহসাই কিছু ফেডারেশন পেয়ে যাবে নতুন সভাপতি।’
নতুন সভাপতি নিয়োগ দেওয়া হলে তারা ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সক্রিয়দের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত খেলাধুলা শুরু করতে পারবেন। তাহলে ক্রীড়াঙ্গনের স্থবিরতা কাটতে শুরু করবে।
আরআই/আইএইচএস