দেশের জন্য খেলে সত্যিই ক্রীড়াবিদরা কিছু পান না?
তারকা আরচার রোমান সানার জাতীয় দল থেকে অবসর ঘোষণা এবং গণমাধ্যমে তার দেওয়া বক্তব্যের পর দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা ক্রীড়াবিদরা যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রোমান সানা সরাসরি দেশের ওপর অভিযোগ এনেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে সাফল্য আনা এই আরচার গণমাধ্যমে অভিযোগ করে বলেছেন, ‘দেশ তো কিছু দিলো না।’
ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক এবং ক্রীড়ামোদীরা এ নিয়ে নিজেদের মতো করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। অনেকেরই অভিযোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে ট্রফি ও পদক আনা ক্রীড়াবিদরা যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন না। অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করলেও কেউ তাদের খোঁজ রাখেন না। অভিযোগের তীরটা সরকারের দিকেই বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে, যেসব ক্রীড়াবিদ বিভিন্ন সময় দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছেন তাদের পাশে সরকার কতটা ভরসা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
রোমান সানা এমন এক সময়ে জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছেন যখন তিনি ফর্মহীন। পারফরম্যান্সের অবনতিতে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পরই না পাওয়ার আক্ষেপগুলো প্রকাশ করছেন তিনি।
এটা ঠিক, দেশে অনেক অযোগ্য লোক মাঝে-মধ্যে যোগ্যদের চেয়ে বেশি মূল্যায়িত হন। আরচার রোমান সানার যে অর্জন তার সিকিভাগ না থাকা অনেক ক্রীড়াবিদও সরকারের কাছ থেকে বড় সহযোগিতা পেয়েছেন। আসলে সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে চাওয়ার ওপর। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সহযোগিতা চেয়ে পাননি এমন ক্রীড়াবিদ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
রোমান সানা কি পেয়েছেন? এটা এখন ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্ন সামনে এনে অনেকে সরকারের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছেন। অথচ ক্রীড়াবিদদের জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার উদাহরণ ভুরিভুরি। খেলাধুলা করে শতশত ক্রীড়াবিদ তাদের জীবনযাত্রা বদলে ফেলেছেন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া উপহারে অনেক ক্রীড়াবিদের বাড়িতে নতুন ঘর উঠেছে, দালান উঠেছে। গরীব বাবা-মায়ের সন্তানরা খেলাধুলা করে দেশের জন্য সম্মান এনে দেওয়ায় তাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নারী ফুটবলাররা এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
কেবল দলীয় খেলাতেই নয়, ব্যক্তিগত ইভেন্টে আন্তর্জাতিক পদক জেতা ক্রীড়াবিদদের টাকা ও ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন। কোনো ক্রীড়াবিদ অসুস্থ হলে কিংবা পারিবারিকভাবে অস্বচ্ছল হলে তা প্রধানমন্ত্রীন নজরে আসলেই তারা সহযোগিতা পেয়েছেন। গত ৫ বছরের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে ক্রীড়াবিদদের সহযোগিতা করেছেন তা নজিরবিহীন।
ক্রীড়াবিদদরা সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন গত ৫ বছরে। তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি দুস্থ, অসহায় ও সাফল্য এনে দেওয়া ক্রীড়াবিদ এবং তার পরিবারকে সহযোগিতা করতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।
রোমান সানার জাতীয় দল থেকে অবসর ও দেশ তাকে কিছু দেয়নি তার এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে সাবেক এই ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘রোমান সানার সব চাওয়াই পূরণ করা হয়েছে। সে প্রধানমন্ত্রীর হাতে মিষ্টি খেতে চেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বাসায় এনে তাকে নিজের হাতে মিষ্টি খাইয়েছেন। এর চেয়ে সম্মানের কি হতে পারে? প্রধানমন্ত্রী রোমানের বাবা-মায়ের খোঁজ খবর নিয়েছেন। রোমান সানার মা অসুস্থ জানার পর প্রধানমন্ত্রী ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। রোমান সানা আর কোনো সমস্যার কথা বলেনি। কিছু চায়ওনি। চাইলে অবশ্যই পেতো। এখন যে কথাগুলো পাবলিকলি বলছে, এগুলো আমাকে বললেও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আরো সহযোগিতা এনে দিতে পারতাম। কারণ, প্রধানমন্ত্রী ক্রীড়াবিদদের জন্য যা করেছেন এবং করছেন সে জন্য তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। যখন যা চেয়েছি, তখন তাই পেয়েছে। এমন কি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি তিনি দিয়েছেন।’
রোমান সানা বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপিতে চাকরি করেন। আরচারি খেলেছেন বলেই তিনি সরকারের একটা প্রতিষ্ঠানে এই চাকরি পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও তাকে ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন তার মায়ের চিকিৎসার জন্য। তারপরও তিনি বলছেন, ‘দেশ তো কিছু দিলো না।’
গণমাধ্যমে দেওয়া তার এই বক্তব্যকে কিভাবে দেখছেন? সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে বলেছেন, ‘এ কথা রোমান কিভাবে বলেছে সেটা তার বিবেকের ওপরই ছেড়ে দিলাম।’
ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠকদের সহযোগিতা পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন জাতীয় পুরস্কার পাওয়া সাবেক ফুটবলার আবদুল গাফফার। ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠকদের সরকারের সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্রীড়াবান্ধব। তিনি নিজে ক্রীড়াবিদদের খোঁজ-খবর রাখেন। যখনই কারো সমস্যার কথা জেনেছেন, তিনি টাকা দিয়ে, ফ্ল্যাট দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। যে যখন আবেদন করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা পেয়েছেন। এ বিষয়ে সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলও বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন। সরকার ক্রীড়াবিদদের জন্য কিছু করছে না-এমন অভিযোগ কেউ করলে তা কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে করছে।’
রোমান সানা জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে ‘দেশ তার জন্য কিছু করেনি’- এমন কথা বলায় হতাশ হয়েছেন সাবেক তারকা ফুটবলার গাফফার। তিনি বলেছেন, ‘রোমান সানা এটা বলে অন্যায় করেছে। কারণ, সে বাংলাদেশ আনসারে চাকরি করে। এটা সরকারের প্রতিষ্ঠান। তার শিক্ষাগত যোগত্যা কী? আরচারি খেলে দেশের সুনাম অর্জন করাতেই এই চাকরি তাকে দিয়েছে আনসার। প্রধানমন্ত্রী তাকে বাসায় নিয়ে নিজের হাতে মিষ্টি খাইয়েছেন। তার মায়ের চিকিৎসার জন্য ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। রোমান আরো কিছু চাইলে তাও দিতেন প্রধানমন্ত্রী। সেই রোমান দেশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আনছে। আমি বলবো রোমান সানা অকৃতজ্ঞ। দেশাত্ববোধ থাকলে এমন কথা বলতে পারতো না। তার এই বক্তব্যের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সেটা রাজনৈতিকও হতে পারে।’
২০১৮ সাল থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক এবং অন্যান্য ক্রীড়াসেবীদের ১০০ কোটি ৬৮ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে।
টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ছাড়াও অনেক ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠককে ফ্ল্যাটও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ফ্ল্যাট পাওয়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- তায়কোয়ানদো খেলোয়াড় শাম্মী আক্তার (আরো ২৫ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র), আবাহনী সমর্থক গোষ্ঠির সভাপতি আসাদুজ্জামান বাদশা (আরও ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র), শ্যুটার শারমিন আক্তার, সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা, ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত, শ্যুটার শাকিল আহমেদ, সাবেক দ্রুততম মানবী সুলতানা লাভলী, প্রয়াত ফুটবলার বাদল রায়ের পরিবার (আরও ২৫ লাখ টাকা), প্রয়াত ফুটবলার মোনেম মুন্নার পরিবার, প্রয়াত হকি সংগঠক জাহিদুর রহমান পুশকিনের পরিবার, সাবেক ফুটবলার শেখ আশরাফ আলী।
আরআই/আইএইচএস/