আট মাস ধরে নেই ঘরোয়া হকির কোনো খেলা
ঈদের ছুটি শেষে খুলে গেছে মওলানা ভাসানী স্টেডিয়াম ঘিরে থাকা বিভিন্ন দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। স্টেডিয়ামের চারপাশ ফিরে পাচ্ছে আগের পরিবেশ। ক্রেতা-বিক্রেতাদের আগমনে সরগরম হয়ে উঠছে স্টেডিয়াম পাড়া; কিন্তু মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের মধ্যে প্রবেশ করে দেখা গেলো অন্যরকম নীরবতা। একটা দম বন্ধ হওয়া পরিবেশ। কোথাও কোন টু-শব্দটি নেই।
এই স্টেডিয়ামের একটা অংশ জুড়ে আছে হকির কার্যালয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে ফেডারেশনে গিয়ে দেখা গেলো সব দরজা বন্ধ। রীতিমতো একটা পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠানের মতো। ফেডারেশনের এক কর্মচারীকে ফোন দিয়ে জানা গেলো, রোববার পর্যন্ত ফেডারেশনের কার্যালয় বন্ধ।’ খোলা থাকলে কি কর্মকর্তারা আসেন? ওই কর্মচারীর উত্তর- ‘তেমন কেউ আসেন না।’
দেশের তিন প্রধান খেলার মধ্যে একটি ধরা হয়ে থাকে হকিকে; কিন্তু সেই হকি এখন যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। গত বছর নভেম্বরের মাঝামাঝিতে শেষ হয়েছে প্রিমিয়ার লিগ। এরপর আর ঘরোয়া হকির কোন খেলা হয়নি। ৮ মাস ধরে হকির টার্ফে পড়েনি স্টিক-বল। ডিসেম্বরে ভাসানী স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক আসর বসেছিল। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ আয়োজন করেছিল এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। আয়োজক হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশও খেলেছিল এশিয়ার মর্যাদাপূর্ণ এই টুর্নামেন্টে।
তারপর বাংলাদেশ জাতীয় দল এশিয়ান কাপ বাছাই, এশিয়ান গেমস বাছাই ও এশিয়া কাপ খেললেও ঘরোয়া হকির কোন খবর নেই। হকি খেলাটা এখন বেঁচে আছে কেবল তিন সার্ভিসেস সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কল্যাণে। এই তিন সংস্থায় প্রায় ১০০ হকি খেলোয়াড় চাকরি করছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০ জন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে।
সার্ভিসেস সংস্থায় চাকরি করেন এমন একজন হকি খেলোয়াড় বলেলেন, ‘ভাই খেলা হচ্ছে না। হকি খেলোয়াড়রা কি করবেন? আমরা বাহিনীতে চাকরি করে বলে খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। না হলেও উবার বা পাঠাও চালিয়ে বাঁচতে হতো।’
২০১৮ সালে সর্বশেষ হয়েছে প্রথম বিভাগ ও দ্বিতীয় বিভাগ হকি লিগ। চার বছর ধরে এই দুই লিগের কোন খবর নেই। এখন আর হয় না স্বাধীনতা দিবস কাপ, বিজয় দিবস কাপ, শহীদ স্মৃতি টুর্নামেন্ট, অফিস লিগ, জাতীয় যুব হকি, জাতীয় হকি এবং মেয়েদের খেলা। হকির বিশাল ভেন্যু মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের কোটি কোটি টাকায় বসানো টার্ফটি পড়ে আছে বেকার। হকি ছাড়া দেশে আর কোন ফেডারেশন নেই যারা দীর্ঘ আট মাস খেলো আয়োজন না করে বসে আছে।
হকিতে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে দেখে অনেক খেলোয়াড়ই ভিন্ন পেশা পেছে নিচ্ছে। যারা অন্য কোথায় যেতে পারছে না তারা হতাশায় ভুগছেন। এ অবস্থায় খেলোয়াড়দের মুখের দিকে তাকিয়ে খেলা শুরুর উদ্যোগ নেওয়ার মতো কোন কর্মকর্তা নেই ফেডারেশনে। অথচ এই ফেডারেশনের দু’জন সহসভাপতি এশিয়ান হকি ফেডারেশনের সদস্য হয়ে বসে আছেন। দেশের হকি নিয়ে তাদেরও কোনো মাথাব্যথা নেই।
হকি খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতি নামে একটা সংগঠন আছে নামকাওয়াস্তে। দেশে খেলা হচ্ছে না, তা নিয়ে মাথা ব্যথ্যা নেই তাদেরও। হকি অঙ্গনের কেউ মারা গেলে তার মরদেহে ফুল দিতেও এই সংগঠনের কাউকে দেখা যায় না। তাহলে এমন সংগঠন থেকে লাভ কী? এমন প্রশ্ন করা হলে হকি খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফুল হক প্রিন্স বলেছেন, ‘করোনার সময় আমাদের সংগঠন ফেডারেশনের চেয়ে বেশি অনুদান দিয়েছে দুস্থ খেলোয়াড়দের।’
কিন্তু ৮ মাস ধরে যে খেলা হয় না তা নিয়ে খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির উদ্যোগ কী? প্রিন্স বলেছেন, ‘আমরা বসে নেই। কি করা যায় সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি। আগামী সপ্তাহে আমরা হকি ফেডারেশনের সভাপতির সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছি। আমরা আর সহ্য করবো না। ঘরোয়া হকি শুরুর তারিখ ঘোষণা না দিলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যবো।’
সর্বশেষ তিনটি টুর্নামেন্টে জাতীয় দলে যারা খেলেছেন তারা প্রায় সবাই বাহিনীর খেলোয়াড়। যে কারণে জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা বেশি সমস্যায় নেই। কিন্তু এর বাইরে যারা আছেন তাদের অবস্থা খুবাই খারাপ। না পারছেন খেলতে, না পারছেন অন্য কোনো কাজ করতে। অনেকে অবশ্য অন্য পেশা বেছে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
কেন দীর্ঘ সময় ধরে খেলা নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেছেন, ‘ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত আমাদের জাতীয় দল চারটি ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্ট খেলেছে। জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক ব্যস্ততার কারণে আমরা ঘরোয়া হকিতে নজর দিতে পারিনি। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা কাপ হকির তারিখ দিয়েও আমরা আয়োজন করতে পারিনি। কারণ, জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের পাওয়া যায়নি। এখন আমরা প্রথম বিভাগ ও জাতীয় যুব হকি নিয়ে কাজ করছি। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘরোয়া হকির বিভিন্ন আসর হতে থাকবে।’
প্রথম বিভাগ লিগ শুরুর উদ্যোগ নিয়েও থমকে গেছে ফেডারেশন। কারণ, খেলার জন্য ক্লাবগুলো ফেডারেশনের কাছে অর্থ সহায়তা চেয়েছে। হকি ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘আমাদের সভাপতি দেশে বাইরে আছেন। তিনি ফিরলে প্রথম বিভাগের ক্লাবগুলোর দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করবো। তিনি সিদ্ধান্ত দেবেন।’
আরআই/আইএইচএস