‘প্রতিষ্ঠার দুই দশক পরও হয়নি পানি শোধনাগার প্ল্যান্ট’
খাল-বিল, নদী-নালার দেশে ভালোমানের সাঁতারু বের করে আনার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জেলায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে সুইমিংপুল। যে সব সাঁতারু শুধু এসএ গেমস নয়, দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে এশিয়ান গেমস, এমনকি অলিম্পিক গেমসেও।
শুধু সাঁতারু বের করে আনাই নয়, বিভিন্ন ক্রীড়া ডিসিপ্লিনে খেলোয়াড়দের শরীরচর্চার অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবেও খুব প্রয়োজন সাঁতার। সাধারণ মানুষের সাঁতার শেখাটাও জীবনের অন্যতম প্রয়োজনীয় বিষয়।
সবকিছু সামনে রেখে সারাদেশে অন্তত ২৩টি সুইমিংপুল নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নির্মাণের পর অধিকাংশ পুলই পড়ে রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। কোনো কোনো পুলে তো একদিনের জন্যও কেউ নামতে পারেনি। কোথাও পানি নেই, কোথাও পাম্প নষ্ট, কোথাও নোংরা পানি- নানা অব্যবস্থায় পড়ে রয়েছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সুইমিংপুলগুলো।
অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত এসব সুইমিংপুল নিয়েই জাগো নিউজের ধারাবাহিক আয়োজন। ৯ম পর্বে আজ থাকছে পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সুইমিংপুলের চালচিত্র...
**১৯৯৯ সালে পাবনায় স্থাপিত হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সুইমিংপুল
**এখানে প্রশিক্ষণ নিয়েই দেশসেরা সাঁতারু হয়েছেন মাহফিজুর রহমান সাগর
**গত অর্থবছরে ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হচ্ছে পাবনা স্টেডিয়ামের পাশাপাশি সংস্কারকাজ করা হয় সুইমিংপুলেও
**কিন্তু বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও স্থাপন করা হয়নি পানি শোধনাগার কেন্দ্র
**পানি শোধন ব্যবস্থা না থাকায় সাঁতারুদের চর্মরোগের ঝুঁকি বাড়ছে
**প্রয়োজন নেই, তবুও শেড ছাড়া নির্মিত হয়েছে দর্শক গ্যালারি
সাঁতারে বাংলাদেশের মধ্যে যে কয়টি জেলা এগিয়ে, তার মধ্যে একটি পাবনা। এখান থেকে বেরিয়ে এসেছে দেশ সেরা অনেক সাঁতারু। শুধুমাত্র জাতীয় পর্যায়েই নয়, পাবনার সাঁতারুরা কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও।
এসএ গেমস, এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস কিংবা অলিম্পিক- সবগুলো আন্তর্জাতিক আসরেই দেশের পতাকা বহন করেছেন পাবনার কৃতী সাঁতারুরা। অথচ এমন একটি জেলায় অবস্থিত সুইমিংপুলটি শিকার নানা অবহেলার।
পাবনা শহীদ আমিন উদ্দিন স্টেডিয়ামে প্রায় ২৩ বছর আগে ১৯৯৯ সালে স্থাপিত হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সুইমিংপুল। প্রতিষ্ঠার এতগুলো বছর পরও এখানে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়নি। ফলে পানি নষ্ট হয়ে সাঁতারুদের চর্মরোগের (স্কিন ডিজিজ) ঝুঁকি বাড়ছে। যদিও শিগগির দীর্ঘদিনের দাবি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন পাবনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তারা।
জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছরে শুরু হওয়া পাবনা স্টেডিয়ামে ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নানা উন্নয়নকাজের পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সুইমিংপুলেও সংস্কারকাজ সমাপ্তির পথে। দর্শকদের কথা ভেবে সুইমিংপুলে নির্মিত হয়েছে দর্শক গ্যালারি। তবে এতে শেড না থাকায় এটি অনেকটা অব্যবহৃতই থেকে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাবনা সুইমিংপুলের কেয়ারটেকার খায়রুজ্জামান উৎপল জানান, তিনি ১৯৯৯ সাল থেকে এখানে কর্মরত। পাম্প ড্রাইভারটিও পরিচালনা করেন। যখন এখানে চাকরিতে যোগদান করেন তখন তিনি ছিলেন একজন খেলায়াড়। পাবনার ক্রীড়াঙ্গন সম্বন্ধে তার রয়েছে ভালো ধারণা।
উৎপল জানান, পাবনায় ১৯৯৯ সালের আগে আধুনিক সুইমিংপুল ছিল না। তবে এখনে শান বাঁধানো একটি ঘাটে সুইমিং করানো হতো। সেই পুকুরে প্রশিক্ষণ নেওয়া সাঁতারুদের অনেক রেকর্ড ছিল। পাবনা জেলা এবং রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের মধ্যে সাঁতারের লড়াই অনুষ্ঠিত হতো। কখনো পাবনা জেলা, কখনো রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড চ্যাম্পিয়ন হতো।
তিনি জানান, সাঁতারে স্বাধীনতার আগে যেমন পাবনার অনেকেই কৃতিত্ব বয়ে এনেছেন, তেমনি স্বাধীনতার পরও অনেক কৃতী সাঁতারু তৈরি হয়েছে এই জেলা থেকে। এক্ষেত্রে আব্দুল হামিদ রিপন, হামিদ, আলো, আমির হোসেন উজ্জ্বলসহ অনেকের কথা এখনও তার মনে আছে।
এই কেয়ারটেকার জানান, সুইমিংপুল হওয়ার পর একবার ছোট আকারে সংস্কারকাজ হয়েছিল। তবে এবারই সবচেয়ে বড় উন্নয়নকাজ সম্পন্ন হচ্ছে। গ্যালারি নির্মাণসহ, পুলের টাইলস পুরোটাই পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন করে পানির পাম্প বসানো হয়েছে।
তবে নানা সমস্যায় জর্জরিত হলেও, পাবনার সুইমিংপুল কখনো বন্ধ থাকেনি। শুধু করোনার জন্য দুই বছর সাঁতার বন্ধ রাখতে হয়েছিল। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর আবারও পুলে সাঁতার চর্চা শুরু হয়েছে।
খায়রুজ্জামান জানান, শুরুর দিকে সুইমিংপুলটি উদ্বোধনের পর একটি ক্যাম্প শুরু হয়। ওই ক্যাম্পেই অংশ নিয়েছিলেন এক সময়ের দেশসেরা সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর এবং এখান থেকে একমাসের সাঁতার প্রশিক্ষণ নেন তিনি। যিনি ২০১২ অলিম্পিকের মার্চপাস্টে বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছিলেন।
মাহফিজুর রহমান সাগরের মতো অনেক প্রশিক্ষণার্থী এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সফলতার মুখ দেখেছেন। এছাড়া ‘সেরা সাঁতারুর খোঁজে বাংলাদেশ’- নামে নৌবাহিনী একটা ক্যাম্প করেছিল পাবনায়। সে সময় পাবনা সুইমিংপুলের প্রশিক্ষার্থী রবিউল আওয়াল নামের একজন সুযোগ পেয়েছিলেন। যিনি ২০২১ সালে নবম বাংলাদেশ গেমসে অংশ নিয়ে পদক জিতেছিলেন।
পাবনা সুইমিংপুলে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক কৃতী সাঁতারু বেরিয়ে এসেছেন। যারা দেশে এবং দেশের বাইরে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। অথচ সাঁতারুদের দীর্ঘদিনের দাবি, এখানে পানি শোধনাগার ব্যবস্থা স্থাপন করার। এ নিয়ে তারা একের পর এক প্রতিশ্রুতি শুনে যাচ্ছেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
খায়রুজ্জামান উৎপল বলেন, ‘করোনার পর আবার সাঁতার প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। সাঁতার তো হয় মূলত গরমের সময়। তখন শেডবিহীন গ্যালারিতে দর্শক বসতে পারবে বলে মনে হয় না। শেড থাকলে গ্যালারির সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপশি দর্শকরাও আরামে সাঁতার প্রতিযোগিতা উপভোগ করতে পারতেন।’
প্রতি বছর ৮ কিংবা তার নিচের বয়সী বাচ্চাদের সাঁতারের প্রশিক্ষণের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বাছাই শেষে তাদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করে নির্বাচিত করা হয়।
পাবনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি রেজাউল হোসেন বাদশা বলেন, ‘শীতকালে পানি ঠান্ডা থাকায় সাঁতার প্রশিক্ষণ মাস তিনেক বন্ধই থাকে। গ্রীষ্মকালে সাঁতার হয়। আর এ সময় টানা রোদ থাকে। তাই গরম ও রোদের মধ্যে দর্শক শেডবিহীন গ্যালারিতে বসে সাঁতার দেখবেন বলে মনে হয় না।’
তিনি জানান, ‘প্রতিষ্ঠার প্রায় এক যুগ পর, ২০১৪ সালে পাবনা সদর (পাবনা-৫) আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স এ সুইমিংপুলে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য আবেদন জানান। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এর অনুমোদনও দেয়; কিন্তু এখন পর্যন্ত এই প্ল্যান্ট স্থাপন হয়নি পাবনা সুইমিংপুলে। অথচ শোধন করতে না পারলে পানি নষ্ট হয়ে যায়। সে পানিতে সাঁতার কেটে সাঁতারুদের চর্মরোগে ভোগার আশংকা বেড়ে যায়। এক্ষত্রে কয়েক মাস পরপর সনাতনী পদ্ধতি অবলম্বন করে সুইমিংপুলের পানি বদলানো হয়।’
পাবনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শহীদুল হক মানিক বলেন, ‘এখানে জরুরি ছিল পানি শোধনযন্ত্র। তা না করে স্থাপন করা হয়েছে দর্শক গ্যালারি। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট না থাকায় জাতীয় পর্যায়ের কোনো প্রতিযোগিতাই আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ দর্শক গ্যালারির চেয়ে জরুরি ছিল পানি শোধনের জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন।’
সুইমিং কোচ রায়হান হোসেন জিতু বলেন, ‘দুই বছর করোনার জন্য প্রশিক্ষণ বন্ধ ছিল। এখন আবার প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। পুলে নতুন ফিল্টার মেশিন এসেছে। এখন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যাট বসলেই সুইমিংপুলটি পরিপূর্ণতা পাবে।’
আমিন ইসলাম জুয়েল/আইএইচএস/