২৪ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া চাঁদপুর অরুন নন্দী সুইমিং পুলের
খাল-বিল, নদী-নালার দেশে ভালোমানের সাঁতারু বের করে আনার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জেলায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে সুইমিংপুল। যে সব সাঁতারুরা শুধুমাত্র এসএ গেমস নয়, দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে এশিয়ান গেমস, এমনকি অলিম্পিক গেমসেও।
শুধু সাঁতারু বের করে আনাই নয়, বিভিন্ন ক্রীড়া ডিসিপ্লিনে খেলোয়াড়দের শরীরচর্চার অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবেও খুব প্রয়োজন সাঁতার। সাধারণ মানুষের সাঁতার শেখাটাও জীবনের অন্যতম প্রয়োজনীয় বিষয়।
সবকিছুকে সামনে রেখে সারা দেশে অন্তত ২৩টি সুইমিংপুল নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নির্মাণের পর অধিকাংশ পুলই পড়ে রয়েছে জরাজীর্ণ অবস্থায়। কোনো কোনো পুলে তো একদিনের জন্যও কেউ নামতে পারেনি। কোথাও পানি নেই, কোথাও পাম্প নষ্ট, কোথাও নোংরা পানি- নানা অব্যবস্থায় পড়ে রয়েছে কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত সুইমিংপুলগুলো।
অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত এসব সুইমিংপুল নিয়েই জাগোনিউজের ধারাবাহিক আয়োজন। পঞ্চম পর্বে আজ থাকছে চাঁদপুরের অরুন নন্দী সুইমিংপুলের চালচিত্র...
* ২০০৭ সালে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সুইমিংপুলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। উদ্বোধন জয় ২০০৮ সালে।
* আন্তর্জাতিক সাঁতারু এবং চাঁদপুরের কৃতি সন্তান অরুন নন্দীর নামে নামকরণ করা হয় সুইমিংপুলটির।
* ২০১৮ মালের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন কারণে বন্ধ হওয়ার পর গত চারবছর বন্ধ হয়ে রয়েছে সুইমিংপুলটি।
* দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে সুইমিংপুলের ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সরঞ্জাম।
* লের নিজস্ব ভবনটিও ব্যবহার হচ্ছে পাশ্ববর্তী নির্মাণাধীন ভবনের স্টোর রুম হিসেবে।
* চাঁদপুর পৌরসভার কাছে ২৪ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া হওয়ায় পানির মোটরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
নানান জটিলতায় দীর্ঘ ৪ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে চাঁদপুরের একমাত্র সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অরুন নন্দী সুইমিংপুল। যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাঁতারু এবং চাঁদপুরের কৃতি সন্তান অরুন নন্দীর নামে নামকরণ করা হয়েছে।
মূলতঃ এই সুইমিংপুলের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জাতীয় মানের সাঁতারু তৈরি ও খেলোয়াড়দের শারীরিক গঠনের উদ্দেশ্যেই পুলটি নির্মাণ করা হয়। তবে দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে সুইমিংপুলের ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সরঞ্জাম।
বর্তমানে সুইমিংপুলের নিজস্ব ভবনটিও ব্যবহার হচ্ছে পাশ্ববর্তী নির্মাণাধীন ভবনের স্টোর রুম হিসেবে। শুধু তাই নয়, যার নামে পুলটির নামকরণ করা হয়েছে, পুরো সুইমিংপুলের ভবনের কোথাও তার কোন নেমপ্লেট পাওয়া যায়নি।
এদিকে দীর্ঘদিন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় হতাশ ক্রীড়া সংগঠক, প্রশিক্ষণার্থী ও চাঁদপুরের সাধারণ মানুষ। দ্রুত সংস্কারের মাধ্যমে সুইমিংপুলটি চালু করার দাবি তাদের।
জানা যায়, চাঁদপুরে মানসম্পন্ন সাতারু সৃষ্টি এবং শিশু-কিশোরদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্যে সুইমিংপুল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তত্ত্বাবধানে চাঁদপুর আউটার স্টেডিয়ামে ২০০৭ সালে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সুইমিংপুলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। যা ২০০৮ সালে কাজ শেষ হলে ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে উদ্বোধন করা হয়।
প্রায় সাড়ে ৪ লাখ গ্যালন পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এই সুইমিংপুলটি। শুরু থেকে এখানে প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকলেও ২০১৮ মালের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। যা এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে সুইমিংপুলের পানির মেশিনটিও নষ্ট হয়ে পড়ে আছে এবং নলকূপটি পুরোপুরি নষ্ট। নতুন নলকূপ স্থাপন ছাড়া এখন আর কার্যক্রম চালু করা সম্ভব নয়। এছাড়া পুলের ভবনও জরাজীর্ণ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
পুলে পানি না থাকার কারণে শুকিয়ে সেখানকার টাইলসগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। নিজস্ব পানি ব্যবস্থাপনার মেশিন বসানো হয়েছিল, যা বর্তমানে বিকল। এছাড়া চাঁদপুর পৌরসভার কাছে ২৪ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিলও বকেয়া রয়েছে বলে জানা গেছে। যে কারণে পানির মেশিনটির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
চাঁদপুর শহরের বাসিন্দা সজিব তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসলে প্রতিটি মানুষের সাঁতার শেখা অত্যান্ত জরুরি। আমি বেশ কয়েকদিন এই সুইমিংপুলে এসেছিলাম ছেলেকে সাঁতার প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি করাতে। কিন্তু এসে দেখি সুইমিংপুলের কার্যক্রম বন্ধ। মূলতঃ আমাদের শহরের এখন যে অবস্থা, এখানে বাচ্চাদের সাঁতার শিখানোর জন্য এখন আর তেমন কোন পুকুর নেই। বেশির ভাগ পুকুরই ভরাট হয়ে গেছে। আর খালের যে অবস্থা, তাতে এখন আর পানি থাকে না। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের নতুন প্রজন্মের কথা চিন্তা করে সাঁতার শেখানোর জন্য এখানে আসতে হয়। সুইমিংপুলটি চালুর জোর দাবি জানাচ্ছি আমি।’
শহরের নাজির পাড়া এলাকার বাসিন্দা রাকিব হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বাসার আসেপাশে সাঁতার শেখার মতো ওইরকম ভালো জায়গা নেই। তাছাড়া শহরে এমন অনেকেই আছে, যারা সাঁতার জানে না। কিন্তু এত কাছে সুইমিংপুল থাকলেও আমরা সেটা ব্যবহার করতে পারছি না। পাশাপাশি এভাবে অচল অবস্থায় পড়ে থেকে সুইমিংপুলের সরঞ্জাম নষ্ট হচ্ছে; কিন্তু এমন ভালো সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এর সুফল পাচ্ছি না। তাই আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব সুইমিংপুলটি সংস্কার করে যেন ব্যবহার উপযোগী করা হয়।’
এ সময় অরুন নন্দী সুইমিংপুলে প্রশিক্ষণ নেয়া এক প্রশিক্ষণার্থী অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘৫ বছর আগে এখানে সাঁতার শিখেছি। এখন আমি পুরোপুরি সাঁতার পারি। এখানে সাঁতার শিখে আমি নদীতেও সাঁতার কেটেছি। এরপর থেকেই আমার কাছে নদীতে বা পুকুরে নামতে ভয় লাগে না।’
শাহজাহান মিয়া নামে আরো একজন বলেন, ‘মূলতঃ প্রতিযোগিতা ছাড়া কখনোই প্রতিভাবান খেলোয়াড় বের করে আনা সম্ভব নয়। আমাদের চাঁদপুরে এত সুন্দর একটি সুইমিংপুল থাকলেও তার সদ্ব্যবহার করতে পারছি না। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।’
এ বিষয়ে আলাপকালে অরুন নন্দী সুইমিংপুলের প্রশিক্ষক জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাঁতারু বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সানাউল্লাহ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সুইমিংপুলটি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও বিভিন্ন একাডেমির মাধ্যমে সাঁতার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হতো। তবে ২০১৮ সালে আমাদের এখানের বিদ্যুত বিল বকেয়ার একটি বিষয় এবং নলকূপটি নষ্ট হয়ে যায়। মূলতঃ এরপর থেকেই এখানকার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘এখন যদি আমাকে একটি গভীর নলকূপ, মটর ও বিদ্যুত বিলের সমস্যা সমাধান করে দেয়া হয়। তাহলে আমি আবার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করতে পারবো।’
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বাবু জাগো নিউজকে বলেন, ‘অরুন নন্দী সুইমিংপুলটি চালু করার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সুইমিংপুলের নলকূপটি অত্যন্ত পুরোনো। তাই আমাদেরকে নতুন একটি নলকূপ স্থাপন করতে হবে। তাছাড়া বিদ্যুত বিল নিয়ে পৌরসভার সাথে একটি বিষয় রয়েছে।’
‘ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আমাদের একটি সভা হয়েছে এবং সভায় কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমি নিজে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ স্যারের নির্দেশে পৌর মেয়র মো. জিল্লুর রহমান জুয়েলের সাথে দুই তিনবার কথা বলেছি। অচিরেই মেয়র মহোদয় এ বিষয়ে বসে যদি একটি সমাধান কর দেন, তাহলে আগামী জুন মাসের মধ্যেই আমরা সুইমিংপুলটি পুনরায় চালু করতে পারবো ইন্সাল্লাহ।’
তিনি আরো বলেন, ‘এছাড়াও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে সুইমিংপুলটি অত্যাধুনিক করণীর বিষয়ে একটি প্রকল্প আসছে। যা এখন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আছে। সেখানে এই সুইমিংপুলের চারদিকে একটি গ্যালারি হবে। ভবনের যে রুমগুলো আছে তার আধুনিকায়ন হবে। নতুনভাবে পুলটির কার্যক্রম চালু হবে। আশা করছি আগামী মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত হবে।’
নজরুল ইসলাম আতিক/আইএইচএস/