নিভে গেলো ক্যারিবীয় ক্রিকেটের শেষ বাতিটিও
একটা সময় আসে যখন একটা যুগের অবসান ঘটে, শুরু হয় সম্পূর্ণ নতুন একটি যুগের। রিকি পন্টিং, জ্যাক ক্যালিস, কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে, শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড় কিংবা ভিভিএস লক্ষ্মণদের যদি বলা হয় একটি যুগের প্রতিনিধি, তবে সেই যুগের অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলা যাবে শিব নারায়ন চন্দরপলকে। ব্রায়ান লারাদের একটা যুগ ছিল। স্টিভ ওয়াহ, শেন ওয়ার্ন, লারা, ওয়াসিম আকরামদের সেই যুগের বিদায়ের হাহাকার কিন্তু বুঝতে দেননি প্রথমে উল্লেখ করা নামগুলো।
তবে সর্বশেষ যুগের প্রতিনিধিদের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে কেন যেন একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে। ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাটসম্যানদের অভাবটা স্পষ্টতই ধরা পড়ছে। টি-টোয়েন্টির ডামাঢোলে এখন ব্যাটসম্যানদের ঠিক ক্ল্যাসিকাল বলা চলে না। শচীন, দ্রাবিড় কিংবা পন্টিংদের বিদায়ের পর তবুও তাদের শেষ প্রতিনিধি হিসেবে টিকে ছিলেন দু’জন। কুমার সাঙ্গাকারা আর শিব নারায়ন চন্দরপল। সাঙ্গাকারার উপস্থিতি ছিল বেশ সরব; কিন্তু ক্যারিবীয় ক্রিকেট বোর্ডের কারণে শিবনারায়ন চন্দরপলের উপস্থিতি ছিল বেশ নীরব। মিটি মিটি জ্বলছিলেন যেন তিনি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কথা না হয় বাদই দেয়া যাক, শুধুমাত্র ক্যারিবীয় ক্রিকেটের কথা ধরলেও শিব নারায়ন চন্দরপল থাকবেন দেশটির ক্রিকেট ইতিহাসের বিশাল একটা জায়গাজুড়ে। ব্রায়ান লারার বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই বলেছিল, ক্যারিবীয় স্বর্ণযুগের শেষ প্রতিনিধির বিদায়। লারা যদি হন ক্যারিবীয় স্বর্ণযুগের শেষ প্রতিনিধি, তবে চন্দরপলকে বলা উচিৎ, ক্যরিবীয় ক্রিকেটেরই শেষ প্রতিনিধি।
ক্যারিবীয় ক্রিকেট এখন যা টিকে আছে, আসলে সেটা মূল, কিংবা ক্ল্যাসিক্যাল ক্যারিবীয় ক্রিকেটের প্রতিনিধিত্ব করে না। এখনকার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটাররা অধিকাংশই টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা। গেইল, পোলার্ড, আন্দ্রে রাসেল থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেকটি ক্রিকেটারই এক একজন টি-টোয়েন্টির বিস্ফোরক। কেউ কেউ গেইলের কথা আলাদা করে বলবে, টেস্টে তার ৩টি ত্রিপল সেঞ্চুরির উদাহরণ দিয়ে; কিন্তু দিন শেষে গেইল টি-টোয়েন্টিরই সেরা বিজ্ঞাপন। টেস্ট ক্রিকেট এখন আর তার ব্যাটের ধারে-কাছেও নেই।
ক্রিকেটে একসময় রাজত্ব করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবীয় ক্যালিপসো সুরে সম্মোহিত হয়ে যেতো বাকি সব ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ। ক্লাইভ লয়েড, স্যারি সোবার্স, ডেসমন্ড হেইন্স, কালিচরন, গর্ডন গ্রিনিজ, স্যার ভিভ রিচার্ডসের মত ব্যাটসম্যান কিংবা অলরাউন্ডারদের যুগে বোলারদের কথা এখানে না হয় নাই বললাম। বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করেছেন এসব ক্রিকেটাররা। টি-টোয়েন্টির ধারনাও জন্মায়নি। ওয়ানডে ক্রিকেট থাকলেও, সেটা এখনকার মত এতটা বাণিজ্যিক হয়ে ওঠেনি। সুতরাং, ক্ল্যাসিক্যাল ক্রিকেটের ধারক-বাহকই ছিলো তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাদেরই শেষ প্রতিনিধি ছিলেন ব্রায়ান চার্লস লারা। ২০০৬ সালে তার অবসরের মধ্য দিয়ে সেই সোনালি অধ্যায়েরই সমাপ্তি দেখেছিলেন অনেকে।
কিন্তু, ১৯৯৪ সালে অভিষেক হওয়া শিব নারায়ন চন্দরপলের ব্যাটেও ক্যারিবীয় সোনালি যুগের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন অনেকে। নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে একেরর পর এক সেটাই প্রমাণ করে গেছেন তিনি। ক্রিকইনফোই তাকে নিয়ে একটা বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফেলেছে। যেখানে, তাকে বলা হয়েছে, ‘অ্যাকচুয়াল রান মেশিন।’ কিভাবে? প্রমাণও দিয়েছেন তারা।
২০০৮ সালে জ্যামাইকা টেস্টে ব্রেট লির বাউন্সারের সামনে যখন ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা একের পর এক অসহায় আত্মসমর্পণ করা শুরু করেছিল, তখন একা বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন চন্দরপল। শেষ পর্যন্ত সেঞ্চুরি এসেছিল তার ব্যাট থেকে। প্রতিপক্ষের সামনে ‘টার্মিনেটর’ হিসেই যেন বারবার আবির্ভূত হচ্ছিলেন তিনি।
চন্দরপলের সবচেয়ে স্মরনীয় ইনিংস ২০০২ সালে ভারতের বিপক্ষে খেলা টেস্ট ম্যাচটি। যেখানে তিনি টানা ২৫ ঘন্টা ব্যাট করে ১০৫০টি বল মোকাবেলা করার রেকর্ড গড়েন। পুরো ক্রিকেট বিশ্বই যেন তার এই কৃতিত্বে বিস্ময়াবিভূত হয়ে পড়েছিল। ২০০৪ এবং ২০০৮ সালে ১৭ ঘণ্টারও বেশি ব্যাট করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলেন চন্দরপল।
সর্বশেষ ২০১৫ সালে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছিলেন চন্দরপল। ওই সময় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩ টেস্টের হোম সিরিজে দুর্বল পারফরম্যান্সের জন্য বাদ পড়েন তিনি। ৪১ বছর বয়সী চন্দরপল প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে খেলেছেন ১৬৪টি টেস্ট। ২৮০ ইনিংস ব্যাট করে ১১৮৬৭ রান করেন তিনি। অপরাজিত ২০৩ রান করেছিলেন সর্বোচ্চ। সেঞ্চুরি ৩৩টি এবং হাফ সেঞ্চুরি ৬৬টি। ২৬৮ ওয়ানডে খেলে ৮৭৭৮ রান করেন চন্দরপল। সর্বোচ্চ ১৫০, সেঞ্চুরি ১১ এবং ৫৯টি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে তার।
আইএইচএস/জেডএইচ