স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও গেজেটে নাম ওঠেনি সুশীলের
স্বাধীনতার ৪৫ বছর কাটছে। এরপরও গেজেটে ঠাঁই মেলেনি মুক্তিযোদ্ধা সুশীল চন্দ্র দাসের। নিজস্ব ভিটেমাটি নেই। তাই একমাত্র মেয়ের আশ্রয়ে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলা ফাঁসিয়াখালীর এক দুর্গম গ্রামে বাস করছেন তিনি।
সেখানে অর্ধহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছেন মুক্তিযোদ্ধা সুশীল। তৎকালীন সাত কোটি বাঙালির স্বাধীন আশ্রয় লাভের বুকভরা আশা নিয়ে রণাঙ্গনে জীবনবাজি রেখেছিলেন যে যোদ্ধা, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে স্বাধীন দেশে তিনি নিজেই আশ্রয়হীন আজ।
স্বাধীনতার গান ‘হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লিখা রবে না’ এ উক্তির সঙ্গেই যেন সুশীল দাসের মিতালি। ইতিহাসে তার নাম নেই। কিন্তু সেদিনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী বীর সেনানিদের ১৭ কোটি বাঙালি এখনও যখন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তখন সুশীলও তাদের একজনের মাঝে পড়েন। আর ইতিহাসে নাম না লেখা অসংখ্য সুনীল দাসদেরকে মনে রাখবে কাল পরম্পরায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রজম্মের পর প্রজম্ম এমনটি প্রত্যশা ভাগ্যবিড়ম্বিত সুশীল দাসদের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের।
চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার কেওছিয়া গ্রামে ১৯৫৫ সালে ১০ আগস্ট জম্মগ্রহণ করেন সুশীল চন্দ্র দাস। তার বাবা উপনেদ্র লাল দাস ও মাতা যশদা বালা দাস। ১৯৭১ সালে নিজ জন্মস্থান দক্ষিণ চট্টগ্রামের রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন সুশীল চন্দ্র দাস। দেশ রক্ষা বিভাগ কর্তৃক ইস্যুকৃত (ক্রমিক নং- ১৯৭১৬৩, ভারতীয় তালিকা নং- এফ এফ ১৭৪) বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ও ১নং সেক্টর আঞ্চলিক অধিনায়ক রফিকুল ইসলামের যৌথ স্বাক্ষরিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্রটি শুধু স্মৃতি স্বাক্ষর হিসেব রয়েছে এই বীর সেনানির কাছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেট অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি ৭১ এর রণাঙ্গনের এই সৈনিক।
সুশীল চন্দ্র দাস জাগো নিউজকে বলেন, ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক স্বপন চৌধুরীর সঙ্গে মুক্তি বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি। তাদের সঙ্গে ভারতে গিয়ে তিন মাসের রণ প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বদেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হন।
১নং সেক্টরের আঞ্চলিক কমান্ডার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে জেনারেল এমএজি ওসমানীর দেয়া সনদ নিয়ে বাড়ি ফেরেন। দেশের প্রয়োজনে যুদ্ধ করে আবার নাম অন্তর্ভুক্তি করতে হবে এমনটি কখনো কল্পনাও করেননি তিনি। আবার ভাবেননি মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পাবেন। এমনটি কখনো ভাবনায় এলে হয়তো আজ ভিটেমাটিহীন পরাশ্রিত জীবন কাটাতে হতো না।
তিনি আরও বলেন, ২০১০ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ডাটা বেইজ ফরম পূরণ করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বরাবর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মাধ্যমে বাংলাদেশ গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্তির আবেদন করেন তিনি। সংশ্লিষ্ট দফতর আবেদনটি গোল সীলমোহর দিয়ে রিসিভও করে। কিন্তু তার আরেক সহযোদ্ধা মো. আইয়ূব গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্তি করাতে সংশ্লিষ্ট দফতরে লবিং করেছিলেন। সেই যোদ্ধাও ন্যায্যতার সংগ্রামে সমাজের কুলাঙ্গারদের দ্বারা অপমানিত হয়ে আত্মহুতি দেন। এরপর তিনিও আর এ বিষয়ে কোথাও যোগাযোগ করেননি।
অপরদিকে, জীবন সায়াহ্নে এসে এই বীর যোদ্ধা উপলব্দি করেছেন, যুদ্ধ করে স্বাধীনতা সনদপত্র নিয়ে বসে না থেকে আরেকটি যুদ্ধ করে হলেও গেজেটে নাম লেখা অপরিহার্য ছিল। এতে নিগৃহীত জীবনের কিছুটা হলেও লাঘব হতো। তবে তার পক্ষে সংশ্লিষ্ট দফতরে যোগাযোগ করার মতো কেউ নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তার এ নিবেদন গণমাধ্যমের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামনে তুলে ধরে তার (প্রধানমন্ত্রীর) হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সুশীল দাস।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লামা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা শেখ মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা বাছাই বা নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন সহসায় এ কার্যক্রম আবারও চালু হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা সুনীল চন্দ্র দাস নিজ উপজেলায় যোগাযোগ করে সহযোদ্ধাদের সহযোগিতা নিলে গেজেটে অন্তর্ভুক্তি হয়ে স্বীকৃতি পেতে পারেন।
লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খালেদ মাহমুদ জাগো নিউজকে জানান, এ ব্যাপারে আমার কাছে তথ্য আসলে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ আকর্ষণ করার প্রক্রিয়া চালাবো।
সায়ীদ আলমগীর/এমজেড/এমএস