রোমান সাম্রাজ্যে রামকৃষ্ণের হানা
সাড়াদিন দৌড়-ঝাঁপ। খেলার মাঠে ছোটাছুটি। দুষ্টুমিতে সেরা। বিরক্ত বাবা-মা'র সিদ্ধান্ত এমন ছেলেকে বাড়িতেই রাখবেন না। এতই যখন খেলা খেলা করে তাহলে বিকেএসপিতেই ভর্তি করে দেওয়া ভালো। শেষ পর্যন্ত বিকেএসপিতেই ঠাঁই হলো দুষ্টু ছেলেটির।
আজ সেই ছেলেই দেশের অন্যতম সেরা আরচার। নাম রামকৃষ্ণ সাহা। সদ্য সমাপ্ত তীর জাতীয় আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ এককে স্বর্ণ জিতেছেন রামকৃষ্ণ। তারকা আরচার রোমান সানার ফেবারিট ইভেন্টে এখন দেশসেরা রামকৃষ্ণ।
ফরিদপুর শহরের উত্তর টেপাখোলার রামকৃষ্ণের বাবা এক সময় ব্যবসা করতেন। মা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। মায়ের পেনশনের টাকা ও রামকৃষ্ণের বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে প্রাপ্ত বেতনেই সংসার চলে তাদের।
দুই বোন ছিল, বিবাহ হয়েছে। মা-বাবাকে নিয়েই এখন রামকৃষ্ণদের সংসার। আরচারি খেলোয়াড় হিসেবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে চাকরি হয়েছে। এখন আরচারি খেলাই ধ্যানজ্ঞান রামকৃষ্ণের।
রামকৃষ্ণের বিকেএসপিতে ভর্তির বিষয়ে ভূমিকা রেখেছেন তার বড় বোন লক্ষ্মী রানী সাহা। তিনি ক্রিকেটার ছিলেন। ফরিদপুর জেলা দল এবং ঢাকা বিভাগীয় দলে খেলেছেন। তার উদ্যোগেই বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ।
‘আমার বোন একদিন বিকেএসপিতে গিয়ে আরচারি প্রশিক্ষণ দেখেছিলেন। তখন স্যাররা দিদিকে বলেছিলেন পরিচিত কেউ থাকলে যেন আরচারিতে ট্রায়াল দেওয়ায়। দিদি বাসায় এসে আমাকে বলেন। তার খুব পরিচিত ফরিদপুরের সাবেক ফুটবলার ও বর্তমানে ক্রীড়া সংগঠক মো. মাসুদুর রহমান চুন্নু স্যারের কাছে আমাকে দেন। তিনি আমাকে আরচারি ট্রেনিং করান। ২০০৯ সালে বিকেএসপিতে ট্রায়াল দেই এবং সবার মধ্যে প্রথম হয়ে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হই। ওই বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি আমি বিকেএসপিতে ভর্তি হই এবং ২০১৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বের হই' - বিকেএসপিতে ভর্তির গল্প বলছিলেন রামকৃষ্ণ সাহা।
তেজগাঁও কলেজে অনার্সে (সামাজকর্ম) ভর্তি হলেও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে চাকরি হওয়ায় পড়াশোনা আর করা হয়নি। তবে এবার উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন ইসলামী স্টাডিতে।
সাবজেক্ট নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিলেন। ‘আমার চার-পাঁচজন বন্ধু মিলে এখানে ভর্তি হয়েছি। বাসায় জানিয়েছি। মা বলেছেন এটা কোনো সমস্যা নয়। তুমি যে কোনো সাবজেক্ট নিয়েই পড়তে পারো। আমার বন্ধুরা বলেছে, যেহেতু আমি আরচারি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকি তাই তারা আমাকে নোট দিয়ে লেখাপড়ায় সহযোগিতা করবে'- ইসলামী স্টাডি সাবজেক্ট নেওয়ার কারণ জানালেন রামকৃষ্ণ।
বিমান বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে এক বছর চুক্তিভিত্তিক খেলেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে, এক বছর খেলেছেন তীরন্দাজ সংসদে। ২০০৯ সাল থেকে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ খেলছেন। সব মিলিয়ে ৮টা স্বর্ণ পদক আছে।
টিম ও মিশ্র ইভেন্ট ধরলে পদক আরও বেশি। এর মধ্যে রোমান সানার যে ইভেন্টে রাজত্ব সেই রিকার্ভ এককে তিনবার স্বর্ণ জিতেছেন রামকৃষ্ণ। যদিও ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় এখনো রোমান সানার সঙ্গে মুখোমুখি হননি তিনি। যে কারণে রোমান সানাকে হারানোও হয়নি এখনো।
রোমান সানা ও রামকৃষ্ণ কাছাকাছি সময়ে আরাচারি শুরু করেছেন। ‘রোমান বয়সে আমার এক বছর বড়। আরচারিতেও সে এক বছর সিনিয়র। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ এককে তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। তবে রোমান সানাকে কখনো ফেস করিনি। সে যখন বিদায় নিয়েছে অন্যদের কাছে হেরেই নিয়েছে'- বলছিলেন রামকৃষ্ণ।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় রোমান সানা ভালো ফলাফল করলেও বিগত কয়েক বছর ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারছেন না। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে রামকৃষ্ণ ধারাবাহিকভাবে সফল।
রামকৃষ্ণ এখন পর্যন্ত দুটি ব্রোঞ্জ পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও এশিয়ান গ্র্যাঁ প্রিঁ-তে এই দুটি পদক ছাড়া আর কোনো পদক নেই রামকৃষ্ণের। ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় ভালো করার কারণটাও জানালেন রামকৃষ্ণ, ‘জাতীয় পর্যায়ের খেলায় আমি খুব আত্মবিশ্বাসী থাকি। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আমাকে বেতন দেয়। যদি তাদের জন্য পদক জিততে না পারি কেমন হয়। আমি সেই আত্মবিশ্বাস নিয়েই খেলে ভালো করি।‘
জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের রিকার্ভ এককে বোর পদক জিতেছেন রাকিবকে হারিয়ে। বিকেএসপির দশম শ্রেণির ছাত্র রাকিব কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়েছিলেন রোমান সানাকে। যদি রোমান সানা ফাইনালে উঠতেন তাহলে কি কোনো টেনশন কাজ করতো?
রামকৃষ্ণের জবাব, ‘মোটেও না। রোমান আমার এক বছরের বড় হলেও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। একসঙ্গে থাকি, একসঙ্গে অনুশীলন করি। তাই সে ফাইনালে উঠলেও আমার কোনো টেনশন হতো না। বরং আমি চাই একবার রোমানের সঙ্গে আমার ফাইনাল পড়ুক। ফাইনালে যদি রাকিব না ওঠে রোমান উঠতো এবং তাকে হারিয়ে স্বর্ণ জিততাম তাহলে আরও ভালো লাগতো।'
ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় ভালো করা রামকৃষ্ণ এখন নজর দিয়েছেন আন্তর্জাতিক পদকে, ‘এখন আমার লক্ষ্য আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক জেতা। সামনে ইসলামী সলিডারিটি গেমস আছে, আছে ওয়ার্ল্ড কাপ স্টেজ-১। এখন আমি যত আন্তর্জাতিকব টুর্নামেন্টে অংশ নেবো সেখানে স্বর্ণপদক পাওয়ার চেষ্টা করবো।'
এক সময় যে বাবা-মা দুষ্টু বলে বাড়িতে রাখতে চাননি, এখন সেই বাবা-মা ছেলেকে নিয়ে গর্ব করেন। রামকৃষ্ণ বলেন, ‘আমার বাবা-মা আমাকে নিয়ে এখন হ্যাপি। তারা এখন গর্ববোধ করেন আমাকে নিয়ে। টিভিতে দেখালে কিংবা পত্রিকায় ছবি ছাপা হলে বাবা-মা সেগুলো অন্যদের দেখিয়ে বলেন- এই যে আমার ছেলের ছবি ছাপা হয়েছে, টিভিতে দেখিয়েছে।’
রোমান সানা তো অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করে খেলে তারকা হয়েছেন। আপনার কি ইচ্ছা? ‘আমারও ইচ্ছা অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করার। একজন ক্রীড়াবিদের কাছে অলিম্পিকে খেলার মতো বড় কিছু নেই। আমিও সেই স্বপ্ন দেখি। আমি রোমান সানাকেও ছাড়িয়ে যেতে চাই।’
আরআই/আইএইচএস/