গান গেয়েই সংসারের খরচ


প্রকাশিত: ০৯:২৭ এএম, ১২ জানুয়ারি ২০১৬

‘এক সময় পালাগান গাইতাম। অ্যাহোন আর পালাগানের চল নাই। তাই জারিগান বান্ধি। এতেই সংসার চলে। মাঝে মাঝে সংসারে একটু-আধটু টানাটানি হয়। কি করুম? বোঝার পর থিক্যাই গানরে সঙ্গী কইরা লইছি। আর ছাড়তে পারি নাই। চার পোলারে দলে রাখছি। বাপ-বেটারা মিইল্যা দল চালাই। আমার সুখ তাতেই। বাউল সম্রাটের মত কইতে অয়- ‘আর কিছু চাইনা মনে গান ছাড়া।’ কথাগুলো বলছিলেন গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক আ. সাত্তার বয়াতী। তার পরিবারের সবাই শিল্পী। সংগীত তাদের একমাত্র আয়ের উৎস। গান গেয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। বিশাল এ পরিবারের ভরন-পোষণ জোগান তারা গানে গানে।

এক সময় গ্রামবাংলায় পালাগান, সারি গান, পুঁথি পাঠ, যাত্রাপালা ও জারি গান ছিল অহরহ। সে সব গ্রামীণ সংস্কৃতি এখন বহুলাংশে লোপ পেয়েছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে শিল্পীরা ছুটছে দিগ্বিদিক। কিন্তু মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার এনায়েতনগর ইউনিয়নের কাচারিকান্দি গ্রামে ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করা আ. সাত্তার বয়াতি তার পুরো পরিবার নিয়ে ধরে রেখেছেন সেই ঐতিহ্য। কেবল গান গেয়েই সংসারের খরচ জোগান তারা।

আ. সাত্তার বয়াতী এনায়েতনগর জে.এম উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। অর্থাভাবে আর লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি তার। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার ঝোক ছিল। তাই গানকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। ১৯৬৫ সালে ২০ বছর বয়সে ওস্তাদ জালাল বয়াতির সঙ্গে সারি গানের মাধ্যমে সংগীত জীবনে প্রবেশ করেন। তার সঙ্গে কাজ করেন ৫ বছর। এরপর নিজেই একটি গানের দল করেন। তার দলের নাম রাখেন ‘পল্লী­ কবিয়াল সাংস্কৃতিক দল’।

শুরুর দিকে পালাগান করতেন তারা। তখন শরীয়ত-মারেফাত, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, রাত্রি-দিনসহ একাধিক পালাগান গেয়েছেন। প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকতেন জালাল বয়াতি. সফিজদ্দিন বয়াতী, রশিদ বয়াতী, জয়নাল বয়াতী, মঞ্জুরানী সরকার, রেখা বয়াতী, রুনা সরকার ও মাকসুদা বয়াতী।

পালাগানের কদর কমে গেলে অনেক শিল্পী দল ছেড়ে চলে যান। আ. সত্তার বয়াতী শুরু করেন জারি গান। নিজের সন্তানদের শিক্ষা দিয়ে টিকিয়ে রাখেন গানের দল। এরপর থেকে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, এনজিও ও ব্যক্তি উদ্যোগে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, দুর্নীতি, বৃক্ষরোপণ বা বনায়ণ, কৃষি, মৎস্য, এইডস, মাদক, দেশাত্মবোধক ও বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির নির্বাচনী জারি গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন।

দলের বর্তমান শিল্পীরা তার পরিবারের সদস্য। চার ছেলে ও মেয়ের ঘরের নাতিকে নিয়ে বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ৬ জন। বড় ছেলে জামাল হোসেন হারমোনিয়াম বাদক এবং গায়ক। মেজ ছেলে রুবেল গান গাইতো। তিন বছর আগে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। স্ত্রী, ২ মেয়ে, ১ ছেলের দায়ভার এখন আ. সত্তার বয়াতীর ওপর। সেজ ছেলে আক্তার হোসেন ঢোল বাদক। চার নম্বর ছেলে সুজন বাজায় মন্দিরা। ছোট ছেলে আকাশ দেওয়ান শিশুশিল্পী। মেয়ের ঘরের নাতি পান্নাও তাদের দলের শিশুশিল্পী।

তারা এ পর্য়ন্ত ঢাকা, ঝালকাঠি, বরিশাল, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, খুলনা ও ভোলাসহ অনেক জেলা ঘুরে গান গেয়েছেন। প্রতিমাসে ৭-৮টা জারি গানের অনুষ্ঠান করেন। প্রতি অনুষ্ঠানে সর্বনিম্ন ২ হাজার ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পান। এছাড়া দুঃস্থ শিল্পী হিসেবে সরকারের কাছ থেকে একবছরে প্রতিমাসে ৭০০ টাকা করে ভাতা পেয়েছেন। বর্তমানে প্রতিমাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা পান। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ, কালকিনি এডিপি’র স্বাস্থ্য প্রকল্পের তালিকাভূক্ত গানের দল হিসেবে মাসে ৪টা অনুষ্ঠান করে প্রতি অনুষ্ঠানে ২ হাজার ২০০ টাকা করে মোট ৮ হাজার ৮০০ টাকা পান। তবে এ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে অভাব-অনটনে দিন কাটবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
 
গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারে আ. সাত্তার বয়াতী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এরশাদের আমলে গানের জন্য সাটিভেট (সার্টিফিকেট) পাইছি। বর্তমানে কিছুটা দুরবস্থার মধ্যে আছি। অনুষ্ঠান না পাইলে সংসার চালাইতে কষ্ট হয়। গান গাইয়া ছেলেগো ব্যবসা করার ব্যবস্থা কইরা দিতাছি। তবে আমার জীবন-মরণ গান। যতদিন আছি, গান লইয়াই আছি। মইরা গেলে পোলাপানে দল চালাইবো কি না জানি না।’

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।