বন্দীশিবিরে দেড় মাস : মাতামহের জবানবন্দী থেকে


প্রকাশিত: ০৬:০১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫

আশৈশব স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে একই ধরনের আলোচনা, স্মৃতিচারণ, নাটক সিনেমা দেখে বেড়ে উঠতে উঠতে রক্তস্নাত ভূমিষ্টকাল ’৭১ এর প্রতি নাড়ির টানটা কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছে। যথোচিত আবেগটাও পানসে ঠেকে; সলজ্জ স্বীকারোক্তি- এ যেন ফিকে একটা বোধ। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের উদ্যোগে সমচিন্তার সহযোদ্ধা ও অনুগামীদের অক্লান্ত সংগ্রামের ফসল আমরা ৪৪ বছর পর প্রথম যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্যকর হবার মাধ্যমে দেখতে পেলাম। তবুও অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে এই বিচার প্রক্রিয়াকে, এমনকি এর প্রয়োজনীয়তাকেও। শহীদ পরিবারদের স্বজন হারানোর ক্ষত তাতে আবারও রক্তাক্ত, আরো গভীরতর হচ্ছে। গভীর কষ্ট নিয়েই অনেকে বলেন, ‘মাত্র ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে বলেই এতো কম সময়ে ৩০ লক্ষ প্রাণের আত্মত্যাগও আমরা ভুলে গেছি’!

আজ তাই কালের পুরানে বিস্মৃতপ্রায় নিজের মাতামহের বন্দী শিবিরের জবানবন্দী প্রকাশ করলাম। যারা সব দেখেও ভুলে গেছেন, আর যারা আমার মত স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম, দেখেনি কিছুই, তারা যেন একটু ’৭১ এ ফিরে যেতে পারেন। মানতে শেখে কেন স্বাধীন বাংলায় ’৭১ আজীবন অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ’৭১ ভুলে গেলে সন্তান মায়ের প্রসব বেদনা ভুলে যাবে, মায়ের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ আর অস্তিত্ত্বকেই অস্বীকার করতে শুরু করবে।

শুরুতেই কিছু ভূমিকা আবশ্যক। আমার মাতামহ, অধ্যাপক ফজলুল করিম জন্মেছিলেন ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের উকিল বাবার ৯ সন্তানের পরিবারে প্রথম সন্তান হিসেবে; ৯ই জুন ১৯২৭ সনে। শুধু কৃতী ছাত্রই না- তিনি ছিলেন আমার দেখা একজন আদর্শ মানুষ । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (’৪৬ থেকে ’৫০) রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরে দুটো পরীক্ষাতেই প্রথম হয়েও জীবিকা হিসেবে শিক্ষকতার প্রতি অনুরক্ততায় বেছে নিলেন কলেজ শিক্ষকতা, কারণ তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেতন ঢের খানিকটা বেশি। এতে করে সংসারে ছোট ছোট ৮ ভাই বোনের প্রাণধারণের উপায় কিছুটা নিশ্চিত হয়।

আমার মাতামহের নিজ হাতে লেখা ‘বন্দীশিবিরের জবানবন্দী’ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কর্মস্থল (সহ- অধ্যক্ষ) চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের কলেজ ম্যাগাজিন ‘অন্বেষা’য় ১৯৭৩ সনে ( পৃষ্টা ৮৯- ৯৭) । প্রকাশিত সেই লেখা আর নানাভাইয়ের টাইপ রাইটারের ইংরেজি মুদ্রণ লিখন থেকে আমি নিজের ভাষায় বর্ণনা করছি।  

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন সিলেট এম,সি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, একই সংগে ছাত্র সংসদের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক। আবাস্থল ছিল সিলেটের শেখঘাট সরকারি কলোনী। ২৬শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের  ঘোষণার পর পরই সারা সিলেট শহরে সৈন্য বাহিনীর তান্ডব লীলা শুরু হয়ে যায়। এসময় সিলেট শহরের আশেপাশে ইপিআর, পুলিশ ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি জোয়ানদের নিয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। ছাত্রেরা তাঁদের সাথে যোগ দেয়। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে আকাশে স্যাবার জেট দেখা যায়। বিমানগুলি পর পর কয়েকদিন শহরে ও এর আশেপাশে এয়ার ষ্ট্রাফিং করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিগুলো তাঁদের লক্ষ্যবস্তু ছিল। এতে বহু লোক হতাহত হয়। ৪ঠা এপ্রিল হানাদার বাহিনী শহর ছেড়ে চলে যায় এবং সব সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র শালুটিকর বিমানবন্দরে কেন্দ্রীভূত করে। কিন্তু যাবার পথে তারা তদানীন্তন ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের ৯ জন পুলিশ প্রহরীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে চলে যায়। ঐদিন বেলা ১১টার সময় বিমান বাহিনীর ২টি বিমান গোটা শহরে ও আশেপাশে ষ্ট্রাফিং করে। বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তজায়গায় শেলিং করে।

এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ থেকে ৮ তারিখ পর্যন্ত সিলেট শহর মুক্তিযোদ্ধাদের অধীনে থাকে। ৮ই এপ্রিল ভোর সাড়ে আটটায় হানাদার বাহিনী পুনরায় শহর দখল করে। প্রথম দিকে হানাদার বাহিনী সংখ্যায় কম থাকায় বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি । কিন্তু এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রত্যহ পিআইএ প্লেনযোগে ৪/৫ বার করে ঢাকা থেকে সৈন্য এনে তারা তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে। শহরে প্রবেশ করে তারা সাধারণ বাঙ্গালী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে আরম্ভ করে। কোর্টবিল্ডিং ও সার্কিট হাউসে আড্ডা গাড়ে। শহরের উপকন্ঠে শালুটিকরের নিকটস্থ আবাসিক মডেল স্কুলে ‘ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার’ এবং একটি বন্দীশিবির স্থাপন করে। তাছাড়া খাদিমনগরেও আরেকটি সামরিক ঘাঁটি করা হয়। এসময় সুরমা নদীর দুই তীরে যত বাড়িঘড়, দোকান পাঠ ছিল তা পুড়িয়ে দেয়া হয় যাতে এসব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় না নিতে পারে। মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে চলে যায় এবং তাঁদের সঙ্গে শহরের তিন চতুর্থাংশ লোক গ্রামের অভ্যন্তরে আশ্রয় নেয়। অনেকে সীমান্ত পার হয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নেয়।

শেখঘাট সরকারি কলোনীতে বসবাসরত অস্থানীয় ছিল নানার পরিবারসহ মাত্র ৩টি পরিবার যারা বিবিধ কারণে শহর ছেড়ে যেতে পারেনি। উল্লেখ্য, কলোনীতে ৩৫টি বেসামরিক পরিবার ছাড়া একজন সামরিক কর্মকর্তার পরিবার ছিল; পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন খলীল, নিঃসন্তান, যিনি তার স্ত্রী শিরিনকে ২৫শে মার্চ ক্র্যাকডাউনের আগেই পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন খলীল জানতেন আমার নানাভাই পাকিস্তানি বাহিনীর নিশ্চিত লক্ষ্য এবং আমার নানাকেও শুভ্যানুধ্যায়ী তিনি ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বাধ্য হয়ে তাঁর স্ত্রী’র লিখে যাওয়া ইংরেজি চিঠিও আমার নানীকে দেখিয়ে বলেছিলেন “ ভাবী, ভাইসাব চালে কিউ নেহি গ্যায়ে?” । ক্যাপ্টেন খলীলের স্ত্রী আমার মা, খালা- মামাদেরও অনেক আদর করতেন। তাই অনুনয় করে স্বামীকে লিখে গিয়েছিলেন তিনি যেন আমার নানার পরিবারকে দেখে রাখেন। ক্যাপ্টেন খলীল সেই অনুরোধ রেখেছিলেন।

কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে প্রায় প্রত্যেক ছাত্রের সঙ্গে মাতামহের হৃদ্যতা থাকায় শহর যখন হানাদার বাহিনীর কর্তৃত্ত্বে ছিল তখন মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা প্রায়ই তাঁর খোঁজ নিতে আসতো। এটা দালালদের চোখে পড়ে যায়। স্থানীয় জাতীয় পরিষদের সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেবের সাথেও অনেক দিনের বন্ধুত্ব। ছাত্রদের সেমিনার এবং বিশেষ বিশেষ দিবসে তিনি অংশগ্রহণ করতেন।
 
এই প্রেক্ষিতে অপ্রাসঙ্গিকতার বিবাদ এড়িয়ে একটি কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে, ছাত্রদের আনাগোনা ছাপিয়েও পাক বাহিনীর কাছে নানা’র লক্ষ্যবস্তু হবার প্রধান কারণ ছিল বঙ্গবন্ধু আমার মাতামহের আত্মীয়, বড় ভাই, ছিলেন। দুজনার বাবারই পেশা, কর্মক্ষেত্র ছিল একই। গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইনে তাই এক সাথেই তাঁদের বেড়ে ওঠা- এক কাচারী ঘরেই পড়ালেখা, শৈশবের সাত রঙা সবরকম দুরন্তপনা। বঙ্গবন্ধু শেখঘাট কলোনীতে ‘৬৯ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে এবং ‘৭০ এ নির্বাচনে জয়ী হবার পরও কলোনী সংলগ্ন সাংসদ গাজী সাহেবের কর্মস্থল থেকে দেহরক্ষী মহিউদ্দীন সাহেবকে না নিয়ে একা নানার সাথে সাক্ষাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি টের পেয়ে তাঁকে দেখতে উপচে পড়া প্রতিবেশীদের ভীড় দালালদের নজরে এসে যায়। তাদের বিবেচনায় এটাই তাঁর মুখ্য দোষ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।

পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করা ছাত্ররাও খুবই অনুনয়/অনুরোধ করেছিলেন নানাভাইকে অন্যত্র চলে যাবার জন্য। এরইমধ্যে পুনরায় পাকিস্তানি বাহিনীর আগ্রাসনের তান্ডবে দেখা গেল শেকঘাট কলোনীর পেছনে সিলেটের বিশিষ্ট সমাজসেবী, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বিমলেন্দু দাস সাধু বাবুর বিশাল এলাকা জুড়ে আবাসস্থল, পেছনের বড় বাজার- সব পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে সরাসরি দূরের সুরমা নদী দৃশ্যমান! উল্লেখ্য, সাধুবাবু তৎকালীন সিলেটের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ২টি সিনেমা হলের মালিক ছিলেন;  নিজের ব্যাবসার কাজের ট্রাক, গাড়ী দিয়ে তিনি সিলেটের বহু মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে পার করেছিলেন। কারফিউ চলাকালীন সিলেটের তৎকালীন একমাত্র মসজিদ, যেখানে মাইক ছিল, ‘কাজীর বাজার মসজিদ’র ইমামকে আজান দেয়ার ‘দোষে’ সেই অবস্থায় হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করে।
    
অতঃপর ১৫ই এপ্রিল ভোরবেলা কারফিউ তুলে নেবার পর একটি জীপগাড়ী বাসার সম্মুখে দাঁড়ায়,  কয়েকজন সৈন্য ও একজন সামরিক অফিসার (লেঃ তালাত, পরে মুক্তিবাহিনী তাকে হরিপুরে হত্যা করে) এসে নানাকে ধরে নিয়ে যায়। ঐ জীপে উঠে তিনি দেখতে পান একজন বাঙ্গালী অফিসার সাদা পোশাকে বসে আছে। পরে জানতে পারেন তিনি ডিএসপি বাহাউদ্দীন ( ঢাকায় আসাদুজ্জামানের হত্যাকারী, বর্তমানে দালালীর অভিযোগে কারাগারে বন্দী)।

জীপে করে তাঁকে কোর্ট প্রাঙ্গনে কর্ণেল সরফরাজ মালিকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি তাঁকে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর বন্দীজীবন এবং অত্যাচারের কাহিনী। বন্দীশিবির আবাসিক মডেল স্কুলের ষ্টাফ কোয়ার্টারের পূর্বদিকের প্রথম বাড়িতে দোতলার একটি ষ্টোররুমে তাঁকে নাম, ধাম লিখিয়ে তালাবদ্ধ রাখা হয়। তিনি জানতে চান তাঁকে এখানে আনার কারণ। উত্তরে গার্ড জানায় যে পরে সবই টের পাবেন। হ্যা, পরে নিদারুণভাবেই তিনি সবই টের পেয়েছিলেন!  

ষ্টোররুমে ঐ অবস্থায় তাঁকে তিনদিন তিনরাত্রি থাকতে হয়। এই তিনদিনে খাবার জুটেছিল কেবল দুইবেলা। শুধু ভাত। সাথে আর কিছু ছিল না। সারা রাত চিৎকার শুনতে পেতেন । মনে হতো কারা যেন খুব গোঙাচ্ছে। বেতের আঘাতের শব্দও কানে আসতো। হঠাৎ চতুর্থ রাত্রে সিকিউরিটি অফিসারের লোক এসে রাত ৯টায় দরজার তালা খুলে অন্য কামরায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। তিনি শঙ্কিত হলেন,  হয়তো আর এই বন্দীশালা থেকে বের হতে পারবেন না!

সেন্ট্রি একটি বড় কামরায় নিয়ে গেলে ঢুকেই দেখলেন একজন সামরিক অফিসার। সামনে টেবিল, সেখানে কিছু কাগজ পত্র। দেওয়ালে মালাক্কার বেত একজোড়া ঝুলছে। জানালার পর্দা আঁটা। বাইরে সেন্ট্রি পাহারা। তিনি অফিসারকে সালাম দিয়ে দাঁড়ালেন। অফিসার জানতে চাইলেন শেখ মুজিবের সাথে নানা’র কতদিনের পরিচয়, কি রকম আত্মীয়তা। আরও জিজ্ঞাসা করলেন দেওয়ান ফরিদ গাজীকে চেনেন কিনা। তিনি কোন কথাই লুকাননি, কারণ এসব খবর এরা আগেই সংগ্রহ করেছে, স্রেফ সত্য বলেন কিনা যাচাই করে নেয়া। অফিসারটি ছিল পাঞ্জাবের, মেজর শওকত। পরদিন সকাল দশটায় মেজর শওকত আবার ডেকে পাঠান। জানতে চান কতদিন ধরে তিনি সিলেট কলেজে অধ্যাপনা করছেন। সাত আট বছর ধরে আছেন শুনে বলেন যে, ছাত্র মহলে তাঁর নিশ্চয়ই বেশ জানাশোনা আছে। এবং আরো জানতে চান যে কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের চার্জে কে আছেন। দুর্ভাগ্যবশত নানা যে এর দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক তা লুকাবার কিছু ছিল না, এর রেকর্ডপত্রও ছিল।

মেজর এবার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে বললেন যে সত্য না বললে সত্য কিভাবে বের করতে হয় সে উপায় তাদের জানা আছে। তিনি সমগ্র বাংলাদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিপথগামী বলে গালাগাল দেন এবং তার মতে এই শিক্ষকেরাই ছেলেদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপন করেছে। ছাত্ররা তাঁদের উস্কানীতেই আজ সরকার বিরোধী হয়েছে। মেজর অভিযোগ করেন নানা মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত। নানা একথার সত্যতা অস্বীকার করলে মেজর কয়েকজন ছাত্রের নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করেন যারা নানা’র বাসায় যাতায়ত করেছে তাঁরা প্রত্যেকেই মুক্তিসেনা এবং ছাত্রনেতা। নানা জবাব দেন যে, ‘এঁরা আমার ছাত্র কিন্তু মুক্তিসেনা কিনা আমি জানিনা’। উত্তরে মেজর ক্ষেপে যান। প্রথমে গালাগালি, অতঃপর মারধোর করে মেজর নানাকে চরম হুশিয়ারী দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে।  

আমার নানা বেঁচে আছেন কিনা বা তাঁর অদৃষ্টে কি আছে নানীকে তা কেউ জানায়নি। তিনি  কোথায় আছেন তাও পরিবারের কেউ জানতে পারেনি। আমার নানীও প্রবল ব্যাক্তিত্বময়ী একজন নারী ছিলেন, শিল্পকলা একাডেমীর গুনীজন সম্বর্ধনা প্রাপ্ত বেতারের প্রথম সারির শিল্পী । তিনি কর্নেল সরফরাজ খানের সাথে দেখা করতে যান, কিন্তু কর্ণেল দেখা করেন না। এসময় নানী’র উপর দিয়ে প্রচন্ড মানসিক বিপর্যয় যায়। আমার খালা ( তাঁদের জ্যৈষ্ঠ সন্তান, তখন ষোড়শী)  ও দুই মামাকে নিয়ে বাসায় একা থাকতে হয়, আমার মা তখন মা’র নানাবাড়ীতে, ঢাকায়। ভয়ে নানা’র বাসায় কোন লোক আসতো না। শুধু কয়েকজন গেরিলা ছাত্র ফেরীওয়ালার বেশে, মুচির বেশে এসে খবরাদি নিত। নানী ছেলে-মেয়ে নিয়ে শঙ্কিত এবং মান ইজ্জত নিয়ে বিব্রত হয়ে পরেন।

এক সপ্তাহ পরে আবার নানা’র ডাক আসে। এবার অন্য অফিসার , মেজর ভাট্টি। লোকটি খারাপ, চেহারা দেখেই নানা’র মনে হলো। তাঁর আলাপের শুরুই ছিল ‘যদি সত্য না বলো তবে তোমাকে শেষ করা হবে’। ভাট্টির অভিযোগ এই, যে, ‘ মাতামহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ষড়যন্ত্র করেছেন, যার মূল পরিকল্পনা কিভাবে অবাঙ্গালী ইপিআর, সামরিক বাহিনীর অফিসার ও তাদের সিলেটে অবস্থানরত পরিজনদের হত্যা করা হবে এবং কিভাবে বাংগালী পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও ছাত্রদের নিয়ে একটা মুক্তিবাহিনী গঠন করে সিলেটের কর্তৃত্ত্ব নিজেদের হাতে নেয়া হবে। নানা ছাত্র সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়েছেন।‘

নানা এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে অস্বীকার করবার সাথে সাথেই আরম্ভ হয় অকথ্য অত্যাচার। সে অত্যাচারের বর্ণনা দেবার ভাষা নানা’র ছিলনা । নানা কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান র জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তিনি নিজেকে স্টোর রুমে কম্বল মোড়ানো অবস্থায় পান। সারা শরীরে ব্যথা। নড়বার শক্তি নেই।  এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে জ্ঞান ফিরে পেলেও আতংকিত হতেন অন্য সহ যোদ্ধাদের ওপর পৈশাচিক চিৎকার শুনে। এর মধ্যে তাঁর মামা শ্বশুর, আনসার এডজুটেন্ট আশরাফ উদ্দীনকে ফ্যানে ঝুলিয়ে পেটানো হতো। অসম্ভব দীর্ঘদেহী তাঁর মামাশ্বশুর এবং অন্যদের কলজে কাপানো আর্তনাদে তিনি প্রার্থনা করতেন আবারও যেন তিনি অত্যাচারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন- তাতে অন্তত খোদার আরশ কাঁপানো এই আর্তনাদ সহ্য করতে হবে না। প্রায় সপ্তাহখানেক পরে শরীর একটু সুস্থ হয়।

বারান্দায় সবসময় সেন্ট্রি পাহারা দিত। একটা মাত্র বাথরুম- বারান্দা দিয়ে যাওয়া আসার সময় বড় বড় জালানার কাঁচের মধ্য দিয়ে কামরার প্রত্যেকেকে দেখা যেত। ইশারায় হাবভাবে কথার আদানপ্রদান হতো। পাশের কামরায় থাকতেন মেজর আবদুল্লাহ, অন্য পাশে ক্যাপ্টেন খালেদ, সামনের ছোট একটি কোঠায় সিলেটের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও চিন্তাবিদ আমিনুর রশীদ চৌধুরী। মাঝখানে দরজা, তাঁর পাশে আরেকটি ফ্ল্যাট। সেখানে ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন, কর্নেল জিয়াউর রহমান (সিলেট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ)। অন্য কামরায় মামা শ্বশুর আনসার এডজুটেন্ট আশরাফ উদ্দীন এবং তাঁর পাশে সিলেটের তদানীন্তন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুনসেফ আহমেদ। রাত হলেই আরম্ভ হতো প্রশ্ন করা এবং দৈহিক অত্যাচার। জেরার সাথে মারপিট এবং জ্বলন্ত সিগারেট স্পর্শকাতর অংশে চেপে ধরা।

একদিন দুপুরে আবার ডেকে সামনে একটা হাতে লেখা কাগজ দিয়ে তাঁকে নিজে হাতে সেটি নকল করে সই করতে বলা হলো। তিনি রাজী হননি, কারণ তিনি জানতেন মৃত্যু আসন্ন। তাই প্রস্তুত হচ্ছিলেন। মানসিক দিক থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই বসে ছিলেন। অফিসারটি ছিল একেবারে তরুন, নাম মেজর কায়মি। তাই নানা তাকে বললেন যে তাঁর কিছু অবাঙ্গালী বন্ধু আছে, এমনকি সামরিক বাহিনীতেও। একবার শুধু তাঁদের জিগেস করে যেন ব্যবস্থা গ্রহন করেন।

এসময় বাসায় দুবার খানাতল্লাসী করা হয়। সঙ্গে অফিসার থাকা সত্ত্বেও টাকা পয়সা, গয়না পত্র খোয়া যায়। সারা বাড়ীঘর তছনছ হয়। একটা ফাইল ছিল ‘বেতার ও প্রেস’ । এতে অনেক প্রবন্ধ, বিভিন্ন কাগজের সম্পাদকীয় ও নানা’র লেখা ও পঠিত কয়েকটি বেতার কথিকার নকল ছিল। আর্মি অফিসারটি এগুলি তল্লাসীর সময় নিয়ে যায়। বেতার কথিকার মধ্যে ছিল তদানীন্তন “পাকিস্তান সরকারের বৈদেশিক নীতি”, ‌‌‌‌‍‌‌“মরহুম লিয়াকত আলী খান- লাহোর প্রস্তাব ও তার রূপায়ন”, ইত্যাদি। ওরা এসবের ইংরেজী অনুবাদ করায় এবং তাতে ওদের মনের কিছু পরিবর্তন হয়। এরপর নানা’র উপর শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করা হয়। কিন্তু দু’বার শরীর থেকে রক্ত নেয়ায় তিনি খুব দুর্বল হয়ে পড়েন।

একমাস পর তাঁকে তাঁর বাড়ি থেকে একপ্রস্থ কাপড় এনে গোসল করতে দেয়া হয় । তখন আমার নানী জানতে পারেন যে নানা বেঁচে আছেন।  এসময়ে তাঁকে কলকাতার কয়েকটি বাংলা পাক্ষিক ও দৈনিকের বিশেষ বিশেষ অংশ অনুবাদ করতে দেয়া হয়। জগতবিচ্ছিন্ন তিনি সেই প্রথম জানতে পারলেন যে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার মুজিব নগরে স্থাপিত হয়েছে।

একরাতে মেজর কায়উম তাঁর কামরায় ডেকে নিয়ে মোট চারজন অফিসার ঘিরে তাঁকে একটি চেয়ারে বসতে দিলেন। তাঁর আশংকা হলো আজকে কিছু একটা হবে। তাঁরা জিগেস করলেন,’ আপনি ভোট দিয়েছেন কাকে?’ উত্তরে তিনি বললেন ,” আপনারা এমন প্রশ্ন করছেন যা কোনকালে কোন সরকার জানতে চায়নাই। ভোটের অধিকার মানুষের একটি মহান অধিকার, তাই গোপন ব্যালটের মাধ্যমে তা প্রয়োগ  করা হয়। আপনারা তাই জানতে চান? এটা আমার অধিকারে হস্তক্ষেপ। তবু বললাম, ভোট আওয়ামী লীগকে দিয়েছি। “তাঁরা আবার প্রশ্ন করলেন, “কেন আরও তো দল ছিল?”   

নানা বললেন, “ আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে দেশের দাবীর প্রতিধ্বনি দেখতে পেয়েছি। এবার নির্বাচনের উদ্দেশ্য ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনা করা। তাই এদেশ থেকে একটা দলই সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসেবে গেলে সংবিধান রচনা করতে দেরী হবেনা। আর আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আমি কোন অন্যায় করিনি। কেননা আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করা হয় নাই, ছয় দফাকে এলএফও নিষিদ্ধ করে নাই। একটা গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকের যে কোন দলের প্রতি সমর্থন দেবার স্বাধীনতা আছে। হঠাৎ আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করে রেস্পেক্টিভ এফেক্ট দিয়ে ভোটারদের শাস্তি দেয়া ন্যায় বিচারের পরিপন্থী।‘  

ক্যাপ্টেন জাফর রাগান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন যে পাকিস্তানে কি বিরোধী দলের দরকার নাই? নানা  বললেন,” নিশ্চয়ই আছে। পি,পি,পি’র সেই ভূমিকা পালন করার কথা। তাছাড়া পাকিস্তানে বিরোধী দলের ট্রাডিশন নেই বললেই চলে। প্রথম মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দল গঠন করলে লিয়াকত আলী খান সাহেব বলেছিলেন, ‘ উসকা সার কুচাল দেয়েঙ্গী। এর প্রভাব পরবর্তীকালে খুব খারাপ হয়েছিল। “ এরপর তাঁরা ছয় দফার ব্যাপারে মত জানতে চান। তিনি বলেন,” এর মধ্যে চারটা বিষয়ে পাকিস্তানের প্রায় সব দল একমত প্রকাশ করে। শুধুমাত্র মুদ্রা ও বৈদেশিক বিষয়ে মতভেদ আছে। এরমধ্যে একটা ঘটনা আকস্মিকভাবে তাঁর মুক্তির পথ খুলে দেয়। মে মাসের ২য় সপ্তাহে আকাশবাণীর ইংরেজী খবরে বলা হয় যে সিলেট সরকারী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপককে বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে পাক সেনারা হত্যা করেছে। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ থেকেও অনুরূপ বলা হয়। এসময় বিচারপতি ও তদানীন্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব বিলেতের তথা বিশ্বের লোকদের জানাচ্ছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করাচ্ছে ইয়াহিয়া সরকার। বিশ্ব জনমত এতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। মার্কিন রাষ্ট্রেও আলোড়ন ওঠে। হঠাৎ একদিন ব্রিগেডিয়ার রানা ইফতেখার নানাকে তাঁর কামরায় ডেকে পাঠান। ঢুকতেই তিনি চেয়ারে বসতে বলেন এবং পাকিস্তানের অখন্ডতার উপর একটা ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে জানান যে তাকে মুক্তি দেয়া হবে এবং এতোদিনের কয়েদী জীবনের জন্য দুঃখিত।

এরপর তাঁর আদেশে একজন ক্যাপ্টেন একটা টেপ রেকর্ডার এনে নানা’র মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরে বলেন যে একটা বিবৃতি দিতে হবে। তখন না করার কোন উপায় ছিলনা। ঐ বিবৃতির অনুবাদ করলে দাঁড়ায় যে “আমি ফজলুল করিম, সিলেট কলেজের অধ্যাপক বলছি যে আমি জীবিত আছি। ভারতীয় বেতার যে খবর বিশ্বকে জানিয়েছে তা মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পাকিস্তানকে দুনিয়ার সম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন করাই ভারতের উদ্দেশ্য। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছিল। পরে আমাকে মুক্তি দেয়া হয়। যদি ভারতীয় বেতার তাঁকে হত্যার কথা দুনিয়াকে না জানাতো তাহলে হয়তো তিনি আর দুনিয়ার আলো দেখতে পেতেন না।

নানার সম্মুখ দিয়ে যাঁদের নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের তালিকা দেশ স্বাধীন হবার পর সরকার ও জেনারেল ওসমানীর নিকট দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে সেনাবাহিনীর কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসার রয়েছেন। তাঁরা হচ্ছেন মেজর আবদুল্লাহ, ক্যাপ্টেন খালেদ, ক্যাপ্টেন আলাউদ্দীন, মেজর চৌধুরী। এদের সবাইকে পেছন দিক থেকে হাত ও চোখ বেঁধে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁরা আর ফিরে আসেনি। সিলেট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ কর্ণেল জিয়াউর রহমানকে তিনি শুধু একদিন ওখানে দেখেছেন। তারপর তাঁর ভাগ্যে কি হয়েছে তিনি জানেননি। সিলেটের বিশিষ্ট ঠিকাদার এবং সমাজসেবী বাবু বিমলাংশু সেন (পাচু সেন) কে তিনি দেখতে পান যাকে ২১ শে এপ্রিল বন্দী শিবির থেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। বন্দীশিবির থেকে মুক্তি পেয়ে পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছেন- এমন খুব বিরল ভাগ্যবানদের মধ্যে আমার নানা ছিলেন। পরম করুণাময়ের অনেকখানি মমতা ও কৃপা।  

এরপরেও ১২ই নভেম্বর খালার এপিন্ডিসাইটিসের অপারেশন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ায় স্বপরিবারে তিনি ঢাকায় হাতিরপুলে শ্বশুড়ালয়ে আসেন। আমার নানীর বাবা রেলওয়ে হাসপাতালের সার্জন ছিলেন। কাজেই দেশের সেই বিপন্নকালেও অপারেশন যতটুকু সম্ভব সুসম্পন্ন করা যাবে এই ভরসায়। এবং এই ঘটনাটিও নানাভাইকে আরেকবার নিশ্চিত মৃত্যু থেকে জীবন ছিনিয়ে দেয়।

সিলেটের সরকারী কলোনীর বাসায় গৃহকর্মী ফরিদকে খাওয়া, খোরাকী দিয়ে রেখে এসেছিলেন। ফরিদ বাইরে তালাবদ্ধ রেখে ভিন্ন পথে রাতে কখনো সখনো সংগোপনে বের হতো। ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকাভুক্ত হিসেবে নানাকে তুলে নিতে আলবদর বাহিনী আবারও বাড়ীতে হানা দেয়। তালাবদ্ধ ঘর দেখেও তার সন্দেহমুক্ত হয়নি। দরজা সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফরিদকে তারা প্রথাগত জিজ্ঞাসাবাদ করে অধ্যাপক ফজলুল করিম বাড়িতে নেই পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই ফেরৎ যায়।

জীবদ্দশায় আমার নানা কোনদিনই জাতির পিতার সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা আলোচনা করতেন না, পাছে লোকে সুবিধাভোগীদের পাল্লায় তাঁকে ভেবে বসেন এই আশংকায়। তাঁর উত্তরপুরুষরাও তা করেনি। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তাঁকে মস্কোর এডুকেশন অ্যাটাশে হিসেবে পাঠাতে চাইলেও তিনি বিনয়ের সাথে তা ফিরিয়ে দিয়ে সার্ভিসের নিয়মানুযায়ী চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের সহ-অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন এবং ‘৮৬ সনে খুলনা বিএল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে যান। নিয়মিত ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির স্থানীয় সক্রিয় সদস্য ছিলেন।    

আমৃত্যু তাঁর শরীরে বন্দীজীবনের ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়ালেও তাঁকে প্রশ্ন করলে চির মিতভাশী, রাশভারী গাম্ভীর্যপূর্ণ তিনি নীরবতায় কিংবা স্মিত হেসে এড়িয়ে যেতেন। বন্দীশিবিরের এই লেখাটি প্রকাশ না পেলে তাঁর সন্তান- সন্ততিরাও কোনোদিন জানতে পারতেন না তাঁকে এবং ৩০ লক্ষ শহীদদের আরো কত নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। আজীবন সশ্রদ্ধ সালাম সকল শহীদ, গাজী, বীরাঙ্গনাদের সর্বোচ্চ আত্মদানের-বিনম্র শ্রদ্ধা শহীদ পরিবারদের - যাঁদের সর্বস্ব ত্যাগে আজ স্বাধীন এক ভুখণ্ডে নিঃশাস নিতে পারছি।

‘‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে’’।

আমৃত্যু স্বপ্ন দেখে যাব, আমার দেশ যুদ্ধাপরাধীর কলঙ্ক মুক্ত হয়েছে, হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে প্রাপ্য হিস্যা বুঝে পেয়েছে, কবি সুকান্তের মত বলতে পারছি,

“সাবাস বাংলাদেশ! এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়;
 জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার; তবু মাথা নোয়াবার নয়! ”

লেখক: জাপানপ্রবাসী বিজ্ঞানী ও লেখক

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।