বিজয়ের ৪৮ ঘণ্টা পর শত্রুমুক্ত হয় নওগাঁ

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৫:২০ এএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫

একাত্তরের ১৮ ডিসেম্বর নওগাঁ হানাদার মুক্ত হয়। দেশ স্বাধীন হবার পরও নওগাঁ মহকুমা হানাদারদের দখলে থাকে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরও পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় নওগাঁয়।

মুক্তিসেনাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয় মিত্রবাহিনী। অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রায় দুই হাজার পাকিস্তানি সেনা।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা যায়, নওগাঁয় মুুক্তিযোদ্ধা রয়েছে চার হাজারের অধিক। শহীদ হয়েছে ৪৬ জন। বর্তমানে ভাতা পাচ্ছেন তিন হাজার ১৮ জন। গণকবর রয়েছে নওগাঁ সদর উপজেলার ধামকুড়ি ও পার-নওগাঁ পূর্বপাড়া, মান্দা উপজেলার পাকুড়িয়া, মনোহরপুর ও কবুলপুর গ্রামে, বদলগাছী উপজেলার সেনপাড়া জঙ্গল ও লাবন্য প্রভা স্কুল, আত্রাই উপজেলার বান্দায়খাড়া, মিরাপাড়া ও সিংসাড়া গ্রামে, রাণীনগর উপজেলার আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামে, ধামইরহাট উপজেলার কুলফতপুর গ্রামে, সাপাহার উপজেলা সদর জিরোপয়েন্টে এবং পত্নীতলা উপজেলার নিরমইল গ্রামে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় নওগাঁয়। আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট বয়তুল্যাহকে (এমএনএ) আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। এ পরিষদের অন্যান্যের মধ্যে অন্যতম সদস্য মো. আব্দুল জলিল, আ.ন.ম মোজাহারুল হক (ন্যাপ ভাসানী), এমএ রকীব (ন্যাপ মোজাফফর), একেএম মোরশেদ প্রমুখ।

১৯৭১ সালে নওগাঁ ছিল ইপিআর ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনে। সেক্টরের অধীনে ছিল নওগাঁ, নবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, হিলি, রাজশাহী, পাবনা ও নাটোর অঞ্চল। এই সেক্টরের প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন গিয়াস, পরবর্তীতে মেজর নাজমুল হক এবং তার মৃত্যুর পর মেজর নুরুজ্জামান ছিলেন এই সেক্টরের অধিনায়ক।

১৮ মার্চের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন পাঞ্জাবী মেজর আকরাম বেগ। দু’জন ক্যাপ্টেনের মধ্যে একজন ছিলেন পাঞ্জাবী নাভেদ আফজাল, অন্যজন বাঙালি ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন। ২৫ মার্চের আগে মেজর আকরামের স্থলে বাঙালি মেজর নাজমুল হক নওগাঁয় ইপিআর এর কমান্ডিং অফিসার হিসাবে বদলি হয়ে আসেন। দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে লক্ষ রেখে মেজর বেগ তাকে চার্জ বুঝিয়ে দিতে অসম্মত হন। পরবর্তীতে কৌশলে ২৪ মার্চ মেজর আকরাম বেগ ও ক্যাপ্টেন নাভেদ আফজালকে গ্রেফতার করা হয়।

সেই সঙ্গে পশ্চিম পাঞ্জাবের ঝিলামের অধিবাসী নওগাঁ মহকুমা প্রশাসক নিসারুল হামিদকেও গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাররা বন্দী অবস্থায় স্বপরিবারে নিহত হন। ফলে নওগাঁ মহকুমা সদ্য ঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। এসময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ নওগাঁর প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করে।

২৫ মার্চ পাক হানাদারদের আক্রমণের শিকার হলেও নওগাঁ মুক্ত ছিল প্রায় এক মাস। ২২ এপ্রিল নওগাঁ পাক হানাদারদের দখলে চলে যায়। প্রায় সাড়ে ৭ মাস ধরে পাক হানাদার বাহিনীরা জেলার বিভিন্ন স্থানে চালায় হত্যা, লুট, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ।

দেশের অভ্যন্তরে প্রেরিত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ পরিকল্পনা রচনা, তাদের ব্যয়ভার বহন ও রসদপত্র সরবরাহের বিষয়ে মো. আব্দুল জলিল তত্ত্বাবধায়ক ও সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নওগাঁর দু’জন কৃতিসন্তান জালাল হোসেন চৌধুরী ও আখতার আহমেদ সিদ্দিককে সিঅ্যান্ডসি স্পেশাল প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ছাত্র-যুবকদের মধ্যে ছিলেন, মোখলেসুর রহমান রাজা, আফজাল হোসেন, মুনির আহমেদ, আব্দুল মালেক, আবু রেজা বিশু, আনিসুর রহমান তরফদার, মোজাম্মেল হক, মকলেসার রহমান চৌধুরী, শামসুল হক, ওহিদুর রহমান, হাসেম আলী, ময়নুল ইসলাম ময়েন, ময়নুল হক মুকুল, খায়রুল আলম, শফিকুল ইসলাম খান, আব্দুস সাত্তার মল্লিক, হাফিজুর রহমান, আব্দুল ওহাব, আব্দুর রাজ্জাক, মোয়াজ্জেম হোসেন, হারুন-অল-রশিদ, আখতারুজ্জামান রঞ্জু, অনিমেশ চন্দ্র দাস, সিরাজুল ইসলাম আনসারী, মোরশেদ তরফদার, আলমগীর  সিদ্দিকী, ইব্রাহিম হোসেন তারা, আবু তাহের, আব্দুস সালাম. মনিরুজ্জামান, জাহাংগীর হোসেন, খন্দকার ওয়ালিউল ইসলাম টুকু, জুলফিকারুল ইসলাম নার্গিস, আজাদ, জহুরুল ইসলাম স্বপন, এ বি এম ফারুক, এবিএম রফিকুল ইসলাম, গোলাম সামদানী, মকছেদ আলী, ডাঃ শাহ আব্দুল খালেক, হাবিলদার গোলাম রাব্বানী মুকুল, এসএম সিরাজুল ইসলাম, এএফএম নুরুজ্জামান নান্টু, আবু তালেব, খলিলুর রহমান, আবুবকর সিদ্দিক, আবুল হোসেন প্রমুখ।

Naogaon

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণের খবর শুনবার পর মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় কমান্ডার জালাল হোসেন চৌধুরী নওগাঁ সদরের গড়ের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পরের দিন সকাল ৭টার দিকে গড়ের বাড়ি থেকে প্রায় ৩৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নওগাঁ শহরের দিকে অগ্রসর হন।

১৭ ডিসেম্বর, শীতের সকাল। মুক্তিবাহিনী জগৎসিংহপুর ও খলিশাকুড়ি গ্রামে আসতেই পাকিস্থানি সেনারা মর্টার শেল ছোড়া শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা শহরের ভেতরে যতোই এগিয়ে যাচ্ছিলেন পাকস্তানি সেনাদের মর্টার শেল নিক্ষেপ ততোই বাড়ছিল। জালাল হোসেন চৌধুরীর নির্দেশ মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করলো। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। দুই বাহিনীর মধ্যকার দুরত্ব একেবারে কমে আসে। এ যুদ্ধে হতাহতের ঘটনা ঘটে। মাঝেখানে যমুনা নদী। রাত পর্যন্ত এ যুদ্ধ স্থায়ী ছিল।

১৮ ডিসেম্বর শনিবার। সকালে বগুড়া থেকে অগ্রসরমান ভারতীয় মেজর চন্দ্রশেখর, পশ্চিম দিনাজপুর বালুরঘাট থেকে নওগাঁ অভিমুখে অগ্রসরমান পিবি রায়ের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী নওগাঁয় প্রবেশ করে। হানাদার বাহিনীর তখন আর করার কিছুই ছিল না। ফলে সকাল ১০টার দিকে প্রায় দুই হাজার পাক সেনা নওগাঁ কেডি স্কুল থেকে পিএম গার্লস স্কুল ও সরকারি গার্লস স্কুল থেকে শুরু করে পুরাতন থানা চত্বর ও এসডিও অফিস থেকে শুরু করে রাস্তার দু’পাশে মাটিতে অস্ত্র রেখে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে আত্মসমর্পণ করে।

এসময় নওগাঁর বিহারী সম্প্রদায় স্বপরিবারে কেডি সরকারি স্কুলে আশ্রয় নেয়। তৎকালিন নওগাঁ মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীকে স্বাগত জানান। বর্তমান পুরাতান কালেক্টরেট (এসডি) অফিস চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেখানে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা পতাকার প্রতি সালাম জানিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। নওগাঁ হানাদারমুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর।

সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদ-নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক এমএম রাসেল জানান, নওগাঁয় এ পর্যন্ত প্রায় ২০টির মতো বধ্যভূমি বা গণকবর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। যার অধিকাংশ অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে। অর্ধেকের মতো বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিফলক নেই। আবার যেগুলোতে স্মৃতিফলক রয়েছে সেগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ নেই। সংগঠন থেকে এ পর্যন্ত ১০টির মধ্যে বধ্যভূমিতে যাওয়া হয়েছে। এগুলো আসলে কারা সংরক্ষণ করবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। অবিলম্বে এ বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা ও গণহত্যার দিনগুলো স্মরণ করার দাবি জানান।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ড হারুন-অল-রশিদ জানান, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হলেও নওগাঁয় অর্ধেকের বেশিরভাগ মুুক্তিযোদ্ধা অসহায় ও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেক মুুক্তিযোদ্ধা ভুল করে, কেউ ইচ্ছে করে কাগজ হারিয়ে ফেলেছেন। আবার মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লিখলে হয়তো মেরে ফেলবে এই ভয়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ পড়ে আছেন। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম না থাকায় তারা সরকার থেকে কোন সাহায্য বা সহযোগিতা পাইনি। মূলত তারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েও অসহায় ও মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

তিনি আরও জানান, স্বাধীনতার পর থেকে গণকবরগুলো প্রাচীরের অভাবে উন্মুক্ত গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। অনেক গণকবরগুলোতে অর্থের অভাবে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। সংস্কারের অভাবে এক সময় হয়তো গণকবরগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। যে গণকবরগুলো রয়েছে তাতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করে ও চারিধারে প্রাচীর দেয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানান।

আব্বাস আলী/এমজেড/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।