প্রয়োজনে সক্রিয় হবে নিষ্ক্রিয় ট্রাইব্যুনাল
সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী। অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ মর্যাদায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর। ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার সময় থেকে কয়েকবার ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীরও সদস্য।
ট্রাইব্যুনালের সকল মামলায় সম্মিলিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। একইসঙ্গে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে মামলা পরিচালনা করেন তিনি। এর আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা মামলার অন্যতম প্রসিকিউটর ছিলেন। ছিলেন আলোচিত ইয়াসমিন হত্যা মামলার আপিলের আইনজীবী। ১৯৯৭ সালে বিভাগীয় স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর, ৯৮ সালে পাবলিক প্রসিকিউটর পরে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, নামজাদা আইনজীবী মাহমুদুল ইসলামের এবং শামসুদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মামলা পরিচালনা করেছিলেন। ২০০০ সালে ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সিমিতির সহ-সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন।
ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার আমরাবাদ গ্রামে শৈশব কাটে। পড়াশোনা ফজলুল হক ইনস্টিটিউট থেকে। সেন্ট্রাল ল’কলেজ থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি নেন। ছাত্র জীবনে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ছাত্রলীগ পরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী অধ্যাপক হোসনে আরা এবং এক ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন। ছেলে মেয়ে দু-জনেই বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে পড়াশোনা করছে। সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে।
জাগো নিউজ : ট্রাইব্যুনাল দুটো থেকে একটি সক্রিয় থাকায় বিচারে কোন প্রভাব পড়ছে কিনা?
সৈয়দ হায়দার আলী : ট্রাইব্যুনাল কমানো হয়নি। শুধুমাত্র একটি নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। এতে বিচার কার্যক্রমে কোন প্রভাব পড়ছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রয়োজনে যেকোনো সময় ট্রাইব্যুনালটি সক্রিয় করবে। আমাদের প্রসিকিউশন টিম পুরোপুরি কাজ করে যাচ্ছে। কলংক মোচনে অনেক পথ আমরা পাড়ি দিয়েছি।
জাগো নিউজ : বিচার ‘জরুরি’ ছিল, আপনার ব্যাখ্যা জানতে চাই।
সৈয়দ হায়দার আলী : আরো আগে বিচারটি করতে পারলে জাতি মুক্ত হতো। কিন্তু নানা কারণে তা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্বিচারে মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ, দেশান্তর, ধর্মান্তর, আগুন দিয়ে ঘড়-বাড়ি জ্বালানোসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের জন্য আওয়ামী সরকার সব সময় চেষ্টা করেছে। তাদের চাওয়াতেই ১৯৭৩ সালের মানবতাবিরোধী আইন (আন্তর্জাতিক অপরাধে ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট) তৈরি করা হয়। পরে মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এখন অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি।
জাগো নিউজ : বিচার থামানোর চেষ্টা হয়েছে কিনা?
সৈয়দ হায়দার আলী : ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতায় বসে খুনি মোস্তাক, তার পরে জিয়াউর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এদের কেউ এই বিচারের উদ্যোগ নেয়নি। বিচার যাতে না হয় সবাই সেই ষড়যন্ত্রই করেছেন। এমনকি ওই সব সরকার স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও অপরাধীদের আশ্রয় দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকা অবস্থায় ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী দালাল আইনে বিচারও শুরু হয়েছিল। প্রখ্যাত আইনজীবী মাহমুদুল ইসলামসহ চার আইনজীবী প্রসিকিউটর হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিচার কাজ অগ্রসর হওয়ার পরের মুহূর্তেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটে। তিনি মারা যাওয়ার পরে ক্ষমতাসীনদের জন্য বিচার থেমে যায়। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীরাই ক্ষমতায় ছিলেন।
জাগো নিউজ : শুরুর প্রেক্ষাপটটি বলবেন কী।
সৈয়দ হায়দার আলী : ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার শুরু করেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেন। তবে ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে খুব বেশি নজর দিতে পারেনি। কিন্তু ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকার মানবতাবিরোধী বিচারের উদ্যোগ নেয়নি। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি এবং ভিকটিম পরিবার বার বারই চেয়েছেন মানবতাবিরোধীদের বিচারের জন্য। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ষড়যন্ত্র আর ভয়ে জোড়ালো কোন ভূমিকা নিতে পারেনি। তখন বিচার তো দূরে থাক বিচারের দাবিও তুলতে পারেনি কেউ।
জাগো নিউজ : জনসমর্থন সঙ্গে নিয়ে বিচার শুরু কিনা?
সৈয়দ হায়দার আলী : ভিকটিম পরিবার, স্বাধীনতার স্বপক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মানবতাবিরোধী বিচারের জন্য ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতিহারে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মানবতাবিরোধীদের বিচার শুরু করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীতে সরকার গঠন করার পরেই বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে। বিচার কার্যক্রম দ্রুত করতে ২০১১ সালে নতুন আরো একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এখন সেটি নিষ্ক্রিয় তবে প্রয়োজনে আবার সেটি সক্রিয় করা হবে।
জাগো নিউজ : ট্রাইব্যুনালে আপনারা কতজন প্রসিকিউটর রয়েছেন?
সৈয়দ হায়দার আলী : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট ২০ জন প্রসিকিউটর সক্রিয় রয়েছি। এদের সবাই কম বেশি মামলা পরিচালনা করছেন। সবাই সবাইকে সহযোগিতা করছেন। তবে টিমে আমরা মোট ২৪ জন ছিলাম।
জাগো নিউজ : ট্রাব্যুনালে এ পর্যন্ত কতটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, এখন কতটি মামলা বিচারাধীন?
সৈয়দ হায়দার আলী : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত শীর্ষ মানবতাবিরোধী গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা এবং পলাতক চৌধুরী আশরাফ ও মঈনুদ্দিনসহ গুরুত্বপূর্ণ মোট ২১টি মামলার (নিষ্পত্তি) রায় হয়েছে। এখন সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার, নোয়াখালী, শরীয়তপুর, পটুয়াখালী, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার আরো ১৭টি মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলছে। এসব মামলা কোনটি অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে সাক্ষীগ্রহণ চলছে, অভিযোগ গঠনের জন্য চার্জ দাখিল করার জন্য, তদন্ত শেষে প্রতিবেদন এবং অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করার জন্যও রয়েছে।
জাগো নিউজ : সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার ট্রাইব্যুনালের কোন পর্যায়ে?
সৈয়দ হায়দার আলী : সংগঠন হিসেবে জামায়াতের মামলার বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বরাবর তদন্ত সংস্থা থেকে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। তখন থেকেই মামলাটি শুনানির অপেক্ষায়। তবে সংগঠনের শাস্তি কি হবে আইনে সেটি না থাকায় বিচারের কার্যক্রম শুরু হয়নি। তাই সরকার আইন পরিবর্তন করবে। আইন পরিবর্তন করার পর মামলায় বিচার করা হবে।
জাগো নিউজ : ট্রাইব্যুনালে মামলায় বিচারিক কাজে কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন?
সৈয়দ হায়দার আলী : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আগে যেমন সমস্যা ছিল এখনো তা বিদ্যমান। ১৯৭১ সালের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী, ভিকটিম এবং দালিলিক প্রমাণ পেতে খুব কষ্ট হয়। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের তখনকার পত্রিকা কাটিং, ঘটনার বিবরণ এবং সকল দালিলিক প্রমাণপত্র সরিয়ে ফেলেছে বার বার ক্ষমতায় আসা স্বাধীনতাবিরোধী সরকারের পক্ষ থেকে। তাই তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাসহ প্রসিকিউশনের সবাই কষ্ট করেছি।
জাগো নিউজ : আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ হায়দার আলী : জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।
এফএইচ/এসএইচএস/এএইচ/আরআইপি