গরু নিয়ে কাঁদছেন পঞ্চগড়ের খামারিরা
ভারত থেকে আসা রোগাক্রান্ত গরুর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে পঞ্চগড়ের বিভিন্ন খামারে। গত এক মাসে জেলার বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক গরু মারা যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন গরু খামারিরা। সংকট মোকাবেলায় জরুরী বৈঠকসহ প্রাণিসম্পদ বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল আক্রান্ত খামার পরিদর্শন করে নমুনা সংগ্রহ করেছেন। ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ১০টি ভেটেনারি মেডিকেল টিম গঠনসহ নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
সরেজমিনে আটোয়ারী ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গরুর খামার ঘুরে জানা গেছে, পৌরসভা এলাকার কামাতপাড়া মহল্লার প্রায় অর্ধশত উন্নতজাতের গরুর খামারের গরু এই রোগে আক্রান্ত। ওই মহল্লার ক্ষুদ্র খামারি জয়নুল হকের দুইটি উন্নত জাতের গরু ছিল। গরুর দুধ বেঁচে সন্তানের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালাতেন। ক’দিন আগে অজ্ঞাত রোগে একটি গরু মারা যায়। অন্য গরুটিও একই ভাইরাসে আক্রান্ত। মাস খানেক আগে প্রতিবেশি খামারি মোস্তাফিজুর রহমান মন্টুর দুইটি উন্নত জাতের গরু মারা গেছে। এর আগে একই রোগে তার খামারের আটটি গরু মারা যায়। এসব গরুর প্রতিটির মূল্য ৮০ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে দিশেহারা মোস্তাফিজুর রহমান মন্টু।
শুধু মন্টু আর জয়নুল নয় গত এক মাসে কামাতপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় অর্ধশত খামারের একশর বেশি গরু মারা গেছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগের পরামর্শে চিকিৎসা করেও কোনো কাজ হচ্ছে না দাবি খামার মালিকদের। গত ২০ দিনে শহরের অন্য মহল্লা কায়েতপাড়া গ্রামের একরামুল হকের তিনটি উন্নতজাতের গরু মারা গেছে। বেঁচে থাকা গরুও একই রোগে আক্রান্ত হওয়ায় দিশেহারা অন্য খামার মালিকরা।
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানায়, জেলার পাঁচ উপজেলায় মোট গরুর খামারের সংখ্যা ৪৮২টি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় রয়েছে ১৩৮টি উন্নত জাতের গরুর খামার। দেশি গরুর পাশপাশি উন্নত জাতের গরু বেশি আক্রান্ত এই ভাইরাসে।
স্থানীয় খামারিরা এই রোগকে খুড়ারোগ বললেও ভারত থেকে চোরাপথে গরু নিয়ে আসা ভাইরাসের কারণে বিশেষ করে খামারের গরু ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিস (এফএমডি) রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে দাবি প্রাণিসম্পদ বিভাগের।
সংকট মোকাবেলায় তারা ১০টি ভেটেনারি মেডিকেল টিম গঠন করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও সচেতনতামূলক পরামর্শ দিচ্ছেন। বিভিন্ন উপজেলায় প্রচারপত্র বিতরণ করছেন। এ ঘটনায় জয়পুরহাটের আঞ্চলিক প্রাণিরোগ অনুসন্ধান গবেষণাগারের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এসএম দৌলতানাসহ প্রাণিসম্পদ বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বিভিন্ন খামার পরিদর্শন করেছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে দিনরাত বিভিন্ন গরুর খামারে ছুটছেন প্রাণিসম্পদ বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে অবাধে আসছে ভারতীয় রোগাক্রান্ত গরু। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে এসব গরু স্থানীয় বাজারে তুলছেন চোরাকারবারীরা। রোগাক্রান্ত এসব গরুর ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে জেলার বিভিন্ন খামারে। গেল কোরবানির ঈদের আগে এই রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা দেয়।
সম্প্রতি শীতের আবহাওয়া শুরু হওয়ায় বিভিন্ন খামারে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পরে এই রোগের ভাইরাস।
ভাইরাস আক্রান্ত গরুর প্রথম দিকে মুখ দিয়ে লালা পরে এবং মুখ ফুলে যায়। পায়ের ক্ষুরায় ঘা দেখা দেয়। মুখ দিয়ে কিছু খেতে পারে না। আক্রান্ত গরু দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে মারা যায়।
শুক্রবার বিকেলে সরেজমিন কামাতপাড়া মহল্লার জয়নুল হকের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, আক্রান্ত গরুর পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন জয়নুল হক। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে চোখের পানি মুছে তিনি বলেন, দুইটি গরু ছিল। এর আয় দিয়ে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালাতাম। এক লাখ টাকার বেশি হবে এমন একটি গরু ক’দিন আগে মারা গেলো। পশু হাসপাতালের (প্রাণিসম্পদ বিভাগ) ডাক্তার সুবান স্যার এসে চিকিৎসা দিয়েছেন। কোনো কাজ হয়নি। একই রোগে অপর গরুটিও আক্রান্ত। এটি মারা গেলে পথে নামতে হবে। জানি না কপালে কি আছে। হে আল্লাহ এই গরুটিকে রক্ষা করো, কথা বলতেই আবারও কেঁদে ফেললেন জয়নুল হক।
প্রতিবেশি মনোয়ারা ডেইরি ফার্মের স্বতাধিকারী মনোয়ারা বেগম বলেন, ব্যাংক ঋণের টাকায় ১০ বছর ধরে খামার চালাচ্ছি। শুরুতে ভালোই ছিল। খামারে ১৭টি উন্নত জাতের গাভী ছিল। এক বছরে আটটি গাভী মারা গেছে। ক্ষুরা রোগে গত এক মাসের মধ্যে আরও দুইটি গাভী মারা গেছে। বর্তমানে তিনটি গাভী নিয়ে আতঙ্কে আছি।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. মো. আক্তারুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, চোরাপথে আসা ভারতীয় রোগাক্রান্ত গরু বাজারে তোলায় এফএমডি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভাইরাস অতি সংবেদনশীল এবং দ্রুত ছড়ায়। এজন্য কিছু গরু মারা গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমরা ১০টি ভেটেনারি মেডিকেল টিম গঠন করেছি। উচ্চ পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ দল বিভিন্ন খামার পরিদর্শন করে নমুনা সংগ্রহ করেছে। আমরা প্রয়োজনীয় টিকাদানসহ সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিলি করছি। এই রোগ এখনো খুব বেশি বিস্তার লাভ করতে পারেনি।
আঞ্চলিক প্রাণিরোগ অনুসন্ধান গবেষণাগারের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এসএম দৌলতানা বলেন, কোরবানির ঈদের আগে থেকে বিভিন্ন এলাকায় ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিস (এফএমডি) নামে এই রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা দিয়েছে। পাশের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে আগেই এই রোগ দেখা দেয়। ভারত থেকে যখনই গরু আসার পরিমাণ বেড়ে যায়, তখনই নানাভাবে এই রোগের ভাইরাস ছড়িয়ে পরে। এই ভাইরাসে সাত প্রকার উপাদান আছে। ভ্যাকসিন দিয়ে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। এছাড়া আক্রান্ত গরুর মুখ এবং পায়ের ক্ষুরা শডা দিয়ে ধৌত করলে রোগের প্রাদূর্ভাব কমে যাবে। অনেকেই আমাদের পরামর্শ না নিয়ে হাতুরি ডাক্তারের কথা শুনে ভুল করেছেন। গরুকে ইচ্ছে তাই খাওয়ার কারণে গরু মারা যায়। কিছু না খাওয়ালে সহজে গরু মারা যাবে না। চিকিৎসা প্রদানসহ রোগ প্রতিরোধে আমরা আমাদের মতো করে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এদিকে চিকিৎসকের পরামর্শ ও সপরিবারে গরুর যত্ন নিয়ে নিজের গরুর খামার ভাইরাসমুক্ত রেখেছেন সদর উপজেলার মালাদাম এলাকার খামারি আমিনার রহমান। তার খামারে উন্নত জাতের ছোটবড় ১৩টি গরু আছে। ক্ষুদ্র খামার মালিক মো. আমিনার রহমান বলেন, আমি দিনরাত গরুর পেছনে সময় দিচ্ছি। চিকিৎসকের পরামর্শমতে গরুর যত্ন নিচ্ছি। আল্লাহর রহমতে আমার কোনো গরু আক্রান্ত হয়নি।
এমএএস/পিআর